আজ নিভৃতচারী লেখক আবু সালেহ আহমদ-এর শুভ জন্মদিন
:: দেওয়ান মাসুদুর রহমান চৌধুরী ::
নিভৃতচারী একজন লেখকের নাম আবু সালেহ আহমদ। তিন যুগের অধিক কাল ধরে লিখলেও তার মূল্যায়ন আমাদের কাছে তেমন একটা নেই। অথচ গ্রাম ও গ্রামের মানুষকে আপন মমতা দিয়ে তিনি আলোকিত ও সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন লেখার শুরু থেকেই। আশির দশকে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা যেমন বিসৃষ্ট হয়ে পরেছিল, যখন শহরের সাথে গ্রামের যোগাযোগ ছিল কন্ঠকাকীর্ণ তখন তিনি সংগীয় কিশোরদের নিয়ে লেখক সৃষ্টির প্রয়াসে মনন নামে সাহিত্য সাময়িকী ধারাবাহিক প্রকাশ শুরু করেন। লেটার প্রিন্ট আর কখনো কাঠে খোদাই করে ম্যাগাজিন করা ছিল অনেক দুঃসাধ্য ব্যাপার। তার পরও তিনি হাল ছাড়েন নি। অনিন্দ্য সাহিত্যকর্ম, শ্রীময় সম্পাদনায় পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। সেই কবে এর হিসেব আমরা কখনো করিনি। উল্লেখ প্রয়োজন যে, আশির দশকে ছাত্র থাকা অবস্থায় মনন দেয়ালিকা সম্পাদনা করে জেলার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার লাভ করে ছিলেন। তারপর তাকে আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। সম্পাদনা করছেন স্মরণিকা, প্রত্যয়, প্রত্যাশা, জনপ্রবাদসহ অনেক সাহিত্য সাময়িকি।
স্থরে স্থরে আজ তিনি সাজিয়েছেন সাহিত্যের সম্ভার। ৯০ দশকে পরিচয় ঘটে এই লেখকের সাথে ন্যায়নিষ্ঠা, আন্তরিকা আর সরলতা দিয়ে আমাকে তিনি মুগ্ধ করেছেন, কাছে টেনে নিয়েছেন। এখন তিনি আমার আত্মার আত্মীয়। তার লিখা কবিতার বইও প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯৪ সালে। গ্রামের ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি কৃষ্টি-কালচার আর গুণীজনদের তুলে ধরার মামষে তিনি শুরু করেন লেখালিখি এতে নানা মন্তব্য ও প্রতিকূলতা হজম করে আজ তিনি হয়েছেন আমাদের গর্ব। আঞ্চলিক ইতিহাসে আমাদের গর্বের বানিয়াচঙ্গকে নিয়ে তার মতো এত কাজ আর কেউ করছেন বলে আমার জানা নেই। বলা চলে অঞ্চল বা গ্রাম বা উপজেলা ভিত্তিক গ্রন্থ রচনায় তিনিই এর পথ প্রদর্শক। ২০০৪ সালে গ্রামের গুণী মানুষকে নিয়ে তিনি লিখেন বানিয়াচঙ্গের শতজন গ্রন্থ। শত বছরের অধিক কাল ধরে বানিয়াচঙ্গ এর লোক কাহিনী নিয়ে চলে নানা টানাপোড়ন। খ্যাতিমান লেখক কেউ বলেন মনমনসিংহের আবার কেউ বলেন সিলেটের। তারা এ নিয়ে বইও লিখেছেন। আবু সালেহ আহমদ এটা মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি ছোট ছোট বই করে, অনবদ্য রচনার মাধ্যমে ও বিভিন্ন সভা সেমিনার করে, টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে প্রমাণ করেছেন এই কাহিনি গুলো বানিয়াচঙ্গের। অনেক কৃতি সন্তানদেরে প্রজন্মের মানুষ ভালো করে চিনতোনা তিনি তার লিখনি মাধ্যমে তা প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছেন। লিখেছেন “বানিয়াচঙ্গের নন্দিত জীবন” গ্রন্থ।
মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনী নিয়ে হয়তঃ তিনিই দেশে প্রথম লিখেছেন উপজেলা ভিত্তিক বানিয়াচঙ্গের “মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধা” নামক গ্রন্থে। বাংলা একাডেমি দেশের লোক- সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার মানষে সংগ্রাহক নিয়োগ করে লোক সংস্কৃতির সংগ্রহ মালা নামে গ্রন্থ প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমী, ঢাকা। আবু সালেহ আহমদ হবিগঞ্জ জেলার অন্যতম সংগ্রাহক। এই গ্রন্থে ৮০ ভাগ কাজই বানিয়াচঙ্গের উপর লিখা, যার সংগ্রাহক তিনি। ভালোবাসা ভালো নয়, ভালোবাসা অন্তর্নিহীত।,,,,,,,, ভালোবাসা করে আজকাল অনেক নির্যাতন থাকে। এসব বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন গ্রন্থ “ভালোবাসার বহিরাবরণ”। বানিয়াচঙ্গের ইতিহাস নিয়ে লিখা গ্রন্থ “কাব্যে বানিয়াচঙ্গের ইতিহাস” এটি একটি প্রথম অনবদ্য প্রকাশ।
এই লেখকের বইর সংখ্যা এখন ১৩ টি। আজ নিজ এলাকাতেই শুধু তাঁর পরিচিতি সীমাবদ্ধ নয়, এলাকা ছাড়িয়ে এখন পুরোদেশে বিস্তৃতি লাভ করেছে। এ যাবৎ অনেক গ্রন্থ ও পত্র পত্রিকায় তার জীবনী প্রকাশ পেয়েছে। মাছরাঙ্গা, ৭১ ” এস টিভি, তার ডকুমেন্টারী প্রকাশ করেছে। এই গবেষক যেমন সাদা মনের মানুষ তেমনি তিনি লিখেনও সহজ সরল ভাষায়, নিজস্ব স্টাইলে । ভাবের সাথে ভবের, কল্পনা নয় বাস্তবতার মিল রেখে লিখেন এক মনোমুগ্ধকর আবেশে। আমাদের বানিয়াচঙ্গের ঐতিহ্য-ঐতিহ্য বিনির্মানে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
তাঁর মূ্ল্যবান লেখালেখির স্বীকৃতি সরূপ পেয়েছেন সম্মাননা, সংবর্ধনা ও পুরস্কার। ২০১৫ সালে তাঁর গবেষনার স্বীকৃতি সরূপ আল হেরা ইসলামী গবেষনা পরিষদ হবিগঞ্জ তাকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান করে। লোক-সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশন সিলেট কর্তিক একুশে সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেন।
এই লেখকের পরিচয় পাঠকের কাছে নতুন করে দেবার কিছু নেই। ইদানিং প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নতুন বই “কুসংস্কারের গল্প”। বইটিও পাঠক মহলে জনপ্রিয়তা পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক মহলে বেশ পরিচিত ও আলোকিত এই মানুষটি অনেক প্রতিকুলতার ও ব্যস্থতার মাঝে থেকেও সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করছেন মনের আনন্দে৷
এই গুণী লেখক আবু সালেহ আহমদ-এর গ্রামের বাড়ি বানিয়াচঙ্গের শরীফখানী মহল্লায়৷ তাঁর গ্রন্থ সমুহ নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য আলোকিত এক আদর্শ হয়ে থাকবে এবং যুগে যুগে জ্ঞান পিপাসুরা উপকৃত হবেন। ইন শা আল্লাহ।
লেখক:সহ-সভাপতি, তরফ সাহিত্য পরিষদ, হবিগঞ্জ; মহা-সচিব, আল হেরা ইসলামী গবেষণা পরিষদ, হবিগঞ্জ।