স্মৃতিতে ভাম্বর আমার বাবা মহিউদ্দীন আহমদ
:: অধ্যাপক ড. কামালউদ্দীন আহমদ ::
আমার বাবা মহিউদ্দীন আহমদ -১৫ মার্চ আমার বাবা মহিউদ্দীন আহমদের মহাপ্রয়াণ দিবস।একজন আদর্শবান সফল পিতার সন্তান হওয়া খুবই ভাগ্যের ব্যাপার। এবং সেই আদর্শকে ধারণ করা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আরো কঠিন। স্বভাবত প্রশ্ন জাগে কি ছিল আমার বাবা জনাব মহিউদ্দীন আহমদের(১৯১৯-১৯৯০) সাফল্যের মূল ভিত্তি। এক কথায় এর উত্তর হল তার শৃঙ্খলিত জীবন। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অনেক কাজ করতেন। এর মধ্যে এক ছিল ফজরের নামায শেষে সুর করে কোরান তেলোয়াত। সেই সুরের আমেজে প্রতিদিন ঘুম ভাঙত আমার। এখন মনে হয়, সেই সুরের ভেতর নিহিত ছিল সমস্ত অলস পঙ্কিলতা দূর করার এক উদাত্ত আহ্বান। ওই আহ্বানের মন্ত্রণা ছিল সারাদিনের কর্মে অনুপ্রেরণা।
বাবা যখনই বাসায় আমাকে একা পেতেন কাছে ডেকে নিতেন। জীবন ও ভাগ্য সম্পর্কে অনেক কথা বলতেন। সবসময় নিজের জীবনের সংগ্রামের কথা বলতেন। একজন খানদানি পরিবারের সন্তান হিসেবে জীবন-জীবিকার জন্যে বাবার এতটা সংগ্রামের প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু He wanted to live a lifeÑ এমন জীবন-যাপন করতে চেয়েছিলেন যা হবে অর্থপূর্ণ। যে কারণে সংগ্রামকে তিনি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। দুঃসংবাদ তাঁকে গ্রাস করেনি। যে ঘরে বৃষ্টির সময় টিনের চালার ছিদ্র দিয়ে পানি পড়তো তার তো দুঃখ পাবারই কথা। দাদার সামান্য আয় দিয়ে সংসার চলতো না। উপরন্তু লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াও ছিল দুরূহ ব্যপার। দুঃখকে তিনি জেদে রূপান্তর করে পাড়ি দিয়েছিলেন মহাসাগরে। কুল-কিনারা কিছুই ছিল না। কুল-কিনারা তাঁকেই এক অনবদ্য সংগ্রামের মধ্যে খুঁজে নিতে হয়েছিল।
এই সংগ্রামে তিনি অনেকটা একাই ছিলেন। তবে এই সংগ্রামে জয়ী হবার দিক-নির্দেশনা তিনি অনেক পণ্ডিতবর্গের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এজন্য তাঁদের সাহচর্য ছিল তাঁর সারা জীবনের পাথেয়। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও সফল পুস্তক ব্যবসায়ী হয়েছিলেন নিজ গুণাবলি দিয়ে। এই সফলতা অর্জনে তিনি কখনো কোনো প্রতারণার আশ্রয় নেননি। সেজন্যই তো এখনো অনেক শুভাকাক্সক্ষীর কাছ থেকে শুনিÑ“বছর শেষে উনি লেখকদের পাওনা ঠিকমত মিটিয়ে দিতেন।” লেখকদেরও ছিল তার ওপর অগাধ বিশ্বাস। এই বিশ্বাসে চিড় ধরুক এটা উনি ব্যবসায়িক জীবনে কখনো চান নি। সবসময় বলতেন, “লেখকদের দিয়েই তো আমি বড় হয়েছি। তাদেরকে সঠিক মূল্যায়ন করতেই হবে।” আমার মনে হয় এরকম স্পর্ধা তখনকার দিনে গুটিকয়েক প্রকাশকই ধারণ করতে পেরেছিলেন। তাঁদের মধ্যে জনাব মহিউদ্দীন আহমদ অন্যতম।
তাঁর জীবন ভাবনার অন্যতম ছিল সরলতা। অর্থবিত্তের মালিক হয়েও বিলাসিতা বর্জন করেছেন সারাজীবন। মনে হতো অর্থ উপার্জন করছেন মানুষকে এবং সমাজকে বিলিয়ে দেবার জন্য। গাড়িতে চড়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু নতুন মডেলের অনুসন্ধানে ছিলেন না। পুরানো মডেলের গড়িটিকে ঠিকঠাক করে চলতেন। নতুন ঢাকার জীবনের চেয়ে পুরানো ঢাকার জীবনযাপনই তার পছন্দসই ছিল। জিন্দাবাহার, ইসলামপুর রোড, বাবুবাজার, আরমানিটোলা, বাংলাবাজারে তিনি ছিলেন সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। সেই তখনকার দিনে জিন্দাবাহারের ‘আহমদ পাবলিশিং হাউস’ ছিল এক মননের প্রতীক। সেখানকার অধিবাসীদের জন্য সেটি ছিল এক গর্বের বস্তু।
> ১৯৪৭-এর দেশবিভাগের পর অনেক লেখকের আনাগোনা ছিল সেখানে। এক ধরনের সৃষ্টিশীলতা আর আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ ছিল জিন্দাবাহারের আহমদ পাবলিশিং হাউস। অনেকের কাছে এখনো আব্বার অতিথেয়তার দিকটি শুনি। কোনোদিন কিছু না খেয়ে কেউ কোনোদিন আসেননি। নিজের পানের বাটা থেকে একটি পান বের করে দিতেন।
লেখকদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক তো ছিলই, এমনকি তাঁদের পরিবারের খোঁজখবরও তিনি রাখতেন। কবি বন্দে আলী মিয়াকে দেখে মনে হতো তিনি আমাদেরই একজন আত্মীয়। কবি বন্দে আলী মিয়া ছিলেন আব্বার প্রকাশক জীবনের প্রথম দিকের একজন বড় শুভাকাঙ্ক্ষী এবং পরামর্শদাতা। বন্দে আলী মিয়াকে সবসময় একই রকম দেখেছি। একবার রাজশাহীতে উনার বাসায় যাবার পর যেভাবে আপ্যায়িত হয়েছি তা কোনোদিনই ভুলবার নয়। আব্বার কাছে লেখক প্রকাশকের এই পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ছিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এর মধ্যে কোনো ফাঁকি ছিল না।
প্রকাশকের সন্তান হিসেবে অনেক লেখক, শিক্ষক ও চিত্রশিল্পীর কাছে গিয়েছি। সবার কাছেই আদর-স্নেহ পেয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনেকে আলাপ করতেন। আব্বার গুণাবলি প্রকাশ করতেন। অনেক সময় তাঁদের স্ত্রীদের সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দিতেন। এ ছিল সেই বয়সে আমার জন্য বিরাট পাওনা। কিছু ভদ্রতা আচার-ব্যবহার এভাবেই শিখেছি। আব্বাও চাইতেন এই সৃষ্টিশীল লোকগুলোর সঙ্গেই যেন আমার যোগাযোগ থাকে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আব্বা কি ভাবতেন সেটা নানাভাবে বোঝার চেষ্টা করেছি। অনেক সময় রাজনৈতিক আলাপ আলোচনায় আব্বার মতামত বোঝা দায় ছিল। মনে হত, উনার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা চলাফেরার মধ্যেই নিহিত ছিল। একবার এরশাদ আমলে ঢাকার ধানমন্ডি মোহাম্মদপুর আসনে ভোটাভুটির সময় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “কাকে ভোট দিলেন।” উত্তরে বলেছিলেন, “তোকে বলবো কেন?” রাজনীতি ছিল তার একান্ত নিজস্ব বিষয়। কখনো দেখিনি রাজনীতি নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনা করতে। তবে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় তাঁকে বিচলিত দেখতাম। একবার আব্বার সঙ্গে একটি রাজনৈতিক বিষয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লে তিনি বললেন- “তোরা তো কলকাতার রায়ট দেখিসনি। কিভাবে ছোটো ছোটো বাচ্চাকে ওপর থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছিল।” উনার এই মন্তব্যে আমি অনেকটা হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম এবং তখন এর অর্থ খোঁজারও চেষ্টা করেছিলাম।
এ ধরনের নৃশংসতা তাকে বেশ পীড়া দিত। এ ব্যপারে আব্বার সঙ্গে কখনো আলাপ হয়নি। এখন ভাবি এ বিষয়ে আব্বাকে প্রশ্ন করলে তিনি হয়তবা অনেক ঐতিহাসিক তথ্য দিতে পারতেন। তবে আব্বার সঙ্গে পরিচিত পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শ্রেণির গুণীজনদের তালিকা দেখলে মনে হয় তিনি সেক্যুলার দৃষ্টিসম্পন্ন একজন আধুনিক মুক্তমনের মানুষ ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ পাকবাহিনী কর্তৃক ঢাকা শহরে হত্যাযজ্ঞের পর সকাল বেলা আব্বার সঙ্গে পায়ে হেঁটে শাখারীবাজার গিয়েছিলাম। সেখানে একটি ঘরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা এক গাদা শিশুর মৃতদেহ দেখে কেমন আবেগ আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল আব্বার মুখখানা। সে মুহূর্তে কি মন্তব্য করেছিলেন মনে পড়ছে না। তবে এক ধরনের ভয়ভীতি তাঁকে ভর করেছিল। তাই তো হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে পাটুয়াটুলিতে মিলিটারি ভ্যান-এ অবস্থানরত এক পাক সেনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার বন্দুকটি কোথায় কখন জমা দেবে?
তিনি আরো বিচলিত ছিলেন এই ভেবে যে, তাঁর নাম বঙ্গবন্ধুর রিলিফ ফান্ডে চাঁদা প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গের মধ্যে আছে। শোনা যাচ্ছিল যে চাঁদা প্রদানকারী প্রত্যেকের বাসায় পাকবাহিনী হানা দেবে। বিকেল বেলা কারফিউ আরোপ করার পরপরই ইংলিশ রোডে পাকবাহিনী আগুন ধরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছিল আমাদের জিন্দাবাহারের বাড়ির পাশেই আগুন লেগেছে। আশেপাশের সকল প্রতিবেশীরা অন্যত্র চলে যাচ্ছিল। আব্বাকে অনেকে অনুরোধও করেছিলেন অন্যত্র সরে যেতে। তবে তাঁর কি প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মনে নেই। সেদিন রাতে লক্ষ্য করলাম, আব্বা বারান্দায় একা নিবিষ্ট মনে কি যেন ভাবছেন। জিন্দাবাহারের পুরো বাড়ির আলো নিভানো ছিল। আমি ভেতরে ঘরে বসে আমার এক দুলাভাইয়ের সঙ্গে অন্ধকারে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনছিলাম। ভাষণের পর বারান্দায় এসে দেখি আব্বা গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। বললেন আস্তে কথা বলতে। পরে শুনেছি বুটপরা কয়েকজন সেনা নীচতলার প্রধান ফটকে এসেছিল। কিন্তু আমাদের ব্যাপারটি জানাননি। পাকবাহিনীর এই অত্যাচার ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত আব্বাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। তাইতো জুনের মাঝামাঝির দিকে যখন আমাদের গ্রামের বাড়ির প্রতিটি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয় তখন পাকবাহিনীর হুংকার ছিলÑ“মহিউদ্দীন সাব কাহা হ্যায়?” মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি জয়ে তিনি উদ্বেলিত হতেন। ১৬ই ডিসেম্বর সকাল বেলা যখন গাড়ি নিয়ে তেজগাঁও এয়ারপোর্ট গেলাম তখন আব্বার হাসিমাখা মুখটি ছিল যুদ্ধজয়ের এক অনুকরণীয় প্রতীক। এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে এক মিত্রবাহিনীর সৈন্যকে জড়িয়ে ধরে কোলাকুলি করলেন।
অনেক কারণে তিনি ছিলেন এক অন্যরকম পিতা। মাথায় কিস্তি টুপি, কারুকার্যময় অবশ্যই। খুবই মসৃণ কাপড়ের সুতি পাঞ্জাবি, সাদা পাজামা। এ পোশাকেই দেখেছি সবসময়। জীবনাচারের ক্ষেত্রে এই ঐতিহ্য ধরে রাখলেও বাবা কোনোক্রমেই গোড়া ছিলেন না। সাদা পোশাকে এক অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। গলার কণ্ঠস্বর ছিল বেশ রাশভারী। অন্যায়ের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিতেন সিংহের মত। পুরোনো ঢাকায় জিন্দাবাহারের বাড়িতে উনার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার শব্দ ছিল ভয়ংকর একটা কিছু। কোথায় ডেইজি লুকাবে, কোথায় মায়া আপা লুকাবে, আর আমি তো চিরায়ত বই নিয়ে তাঁর শোবার ঘরে এক দরজার পাশে বসে পড়ছি। বোঝার উপায় নেই যে আমরা সকলে উনার ঘরে বসে টেলিভিশন দেখছিলাম।
আব্বাও নীচ তলা থেকে উপরে উঠে দেখতেন সব ঠিকঠাক। আমরা সবাই যার যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। ধর্মের ব্যাপারে কোনোদিন বাড়াবাড়ি দেখিনি। বহু দিন শুয়ে আছি। পাশেই আব্বা বসে কোরান পড়ছেন। সুর করে। অভূতপূর্ব উচ্চারণ।
আমাদের জন্য ইসলামপুর মসজিদের এক মোয়াজ্জিন সাহেব রেখেছিলেন। অপূর্ব কণ্ঠ। নাম ছিল জনাব জয়নাল, আমরা বলতাম কারী সাহেব। সেই যে সুরা তিনি ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন, সেই সুরা এখনো ধরে রেখেছি। সুরের চর্চা না হলে মনে হয় দিনটাই মাটি গেল। এ এক আত্মতৃপ্তির অনুভূতি। এই অভ্যেস নিজেকে অনেকটা শৃঙ্খলিত করেছে। যেমন শৃঙ্খলা লক্ষ্য করেছিলাম বাবার জীবনে।
একবার বেশ ক’জন হুজুর খুব সম্ভব চকবাজার মসজিদ থেকে এসেছিলেন আব্বার জিন্দাবাহারের কর্মস্থলে। তিনি সবাইকে তাঁর পানের কৌটা থেকে পান দিয়ে আপ্যায়িত করলেন। তারপর তাবলীগি ঢং-এ হুজুরেরা আব্বাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। আব্বা তাদেরকে বিব্রত করেননি। বরং নরম সুরে বললেন, “আপনারা আপনাদের এই প্রচার আমার কাছে না করে বরং হিন্দু, খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের করলে আরো ভালো হয়।” ধর্মের ব্যপারে উনি কোনো মতবাদ চাপিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। চলনে বলনে কথাবার্তায় কখনোই সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। সবসময় একটি উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে চলতেন।
তাইতো লক্ষ্য করতাম যখনই গ্রামের বাড়িতে কোনো মেজবানের আয়োজন করতেন তখনই সংখ্যালঘুদের ঘরপ্রতি দাওয়াত করতেন। তাদের জন্য ছিল তাদের উপযোগী খাবার। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে কিংবা কোনো মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। এর থেকে আমি এবং আমাদের পরিবার শিখেছি কীভাবে ভিন্ন ধর্মালম্বীদের শ্রদ্ধা জানাতে হয়। এখনতো ভোটের সময় বা তার পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের বেশ ভীতসন্ত্রস্ত দেখা যায়। অথচ বাবার আমলে তা ছিল একেবারেই অকল্পনীয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আব্বার নির্দেশে গ্রামের চেয়ারম্যান মেম্বারদের নিয়ে একটি শান্তিশৃঙ্খলা কমিটি গঠিত হয় সংখ্যালঘুদের জানমাল হেফাজতের জন্য, একবার দেখা গেল এক মেম্বারের নেতৃত্বে কিছু দুষ্কৃতিকারী হিন্দুদের বাড়িতে লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেটাকে আব্বা সহজভাবে নেননি। মনে পড়ে তিনি এক মেম্বারকে বিচারকার্যের মাধ্যমে জুতোপেটা করেছিলেন। এই নিঃস্বার্থ বিচারের ফলে স্বাধীনতা অব্দি এলাকায় সংখ্যালঘু নির্যাতন একেবারেই ছিলো না। পরবর্তীতে দেখেছি আব্বা রাতে বালিশের পাশে বন্দুক নিয়ে ঘুমাতেন।এভাবে আব্বা হয়ে উঠেছিলেন উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী এক উদার মনোভাবাপন্ন খাঁটি মুসলমান। তাইতো মৃত্যুর পর সকল সংখ্যালঘুদের আহাজারী ছিল এই বলে যেÑ “আমাদের আর কেউ নেই।”
কিন্তু সব শৃঙ্খলার শিকল উপড়ে ফেলে বাবা এত দ্রুত হারিয়ে যাবেন কে জানতো। সেদিন শবেবরাতের রোজা রেখেছিলেন। বাবা বরাবর নিজেই বাজারে যেতেন এবং কোনটা দিয়ে কি রান্না করতে হবে আম্মাকে বলে দিতেন। আম্মা সেভাবেই রাঁধতেন। কোনো সময় মনঃপুত না হলে রাগ করতেও দেখেছি। তবে রাগের পরিমাণ তেমন উগ্র ছিল না কখনোই। হয়ত কম খেতেন।
হয়ত সেদিন নিজেই বাজার করেছিলেন। শিং মাছ দিয়ে ঢেড়স। এই তরকারিটা বাবার খুবই প্রিয় ছিল। সারাদিন রোজা রেখে রাতে নিজের রুচিমত খাবার খাবেন, এটাই তো স্বাভাবিক। এশার নামাজ পড়ে খেতে বসেছেন। ওমনিই খারাপ লাগা। বাথরুমে গেলেন। এসে আরো ক্লান্তি অনুভব করলেন। তখন মেজ আপা, সেজ আপা বাসায় ছিলেন। বললেন, “আমার কোমর থেকে বুক পর্যন্ত কেমন যেন অসম্ভব ব্যথা।” আর খেতে পারলেন না। শুয়ে পড়লেন। বাসার সবাই আম্মা, আপা, পাশা সকলেই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কেন বাবা হঠাৎ করে এমন হয়ে গেলেন। হয়তবা সারাদিনের রোজায় দুর্বল হয়ে গিয়েছিলেন। সারারাত ব্যথায় নাকি কাতরিয়েছেন। অভিযোগ করেছেন আমাদের বিরুদ্ধে “তোদের কি কোন ডাক্তার বন্ধু নেই?” ভাবি, কেন বাবাকে তখনই অ্যাম্বুলেন্স-এ করে হাসপাতালে নেওয়া হল না! তাঁর শরীরে যা ক্ষতি তা সারারাতের ভোগান্তিতেই হয়ে গিয়েছে। এখন ভাবি যদি বাবা এখন বেঁচে থাকতেন তাহলে কত কিছুই না করার ছিল। নাতি ডাক্তার, নাত-বৌ ডাক্তার। বন্ধু ডাক্তার। হাত বাড়ালেই সাহায্য।
থাক, সবই নিয়তির পরিহাস। আমি আমেরিকা যাবার দিন সকাল বেলা যখন আব্বার দোয়া নিতে ঘরে ঢুকি তখন তিনি শুয়েছিলেন। কেঁদে বললেন, “আমাকে আর দেখবি না।” এই না-দেখার ভয় সার্বক্ষণিকভাবে আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে।
বিমানে ওঠার পর থেকে চোখের পানি অঝোরে ঝরছিল। মনে হচ্ছিল নেমে পড়ি। কিন্তু স্বপ্নের দেশের হাতছানি সেই চেষ্টা থেকে বিরত করেছিল আমাকে। তবে ফাহমির আদরমাখা মুখ, ডালিয়াকে অজানা বিরূপ পরিবেশে ফেলে আসা প্রভৃতি দুশ্চিন্তা বারবারই আমাকে ভাবিয়ে তুলছিল কেবল। আজ ১৭ বছর বাবাহীন পৃথিবী। বলতেন, “আমার মৃত্যু হলে বুঝবি।” ৩১টি বছর প্রতিটি পদে পদে সেটা বুঝতে পেরেছি।
তবে এই বন্ধুর পথ চলা লাইনচ্যুত হয়নি কখনও। বরং উনি যা চেয়েছেন, তা আঁকড়ে ধরে আছি। তাঁর স্বপ্নের অনেকটাই পূরণ হয়েছে, এখন আর খানিকটা কেবল বাকি…। সেটাও পূরণ হয়েছে সাম্প্রতিককালে। সেটা আব্বার বহু আকাক্সিক্ষত ছেলের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন। আব্বার প্রকাশক জীবনে অনেক প্রভাব ফেলেছিলেন- সৈয়দ আলী আহসান, ড. রফিকুল ইসলাম, ড. মাহমুদ শাহ কোরাইশী, কবি আবদুস সাত্তার, শহীদ মুনীর চৌধুরী, কবি মাহফুজউল্লাহ, জনাব ফজলে রাব্বী প্রমুখ গুণীজন। তাঁরা ছিলেন আব্বার আমৃত্যু সাথী, পারিবারিক/ব্যবসায়িক যে কোনো কাজ বা অনুষ্ঠানে তাঁদের সবার উপস্থিতি ছিল আব্বার কাম্য, গ্রাম থেকে কোনো কিছু আনা হলে আহসান স্যারের বাসায় তা পাঠাতেন। আমার মনে পড়ে দাউদকান্দি/মেঘনা ফেরী ঘাট থেকে ক্রয় করা বড় মাছটি পর্যন্ত আলী আহ্সান স্যারের বাসায় পাঠাতে দ্বিধা করেননি তিনি।
স্কুল পাঠ্যবই যখন সরকারের হাতে চলে গেল আব্বাকে দেখতাম আলী আহ্সান স্যারের পরামর্শে প্রকাশনা ব্যবসায় পরিবর্তন সাধনের প্রয়াস। লেখক ও সাহিত্যিক হিসেবে আলী আহসান স্যারের প্রকাশকের অভাব ছিল না। আমার ধারণা তাঁর লেখা প্রায় বইয়ের প্রকাশনার sole agent আব্বাই ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের কয়েকটি বই প্রকাশনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন আলী আহসান স্যারের প্রচেষ্টার ফলে। বইগুলো উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বিভিন্ন কলেজে পাঠ্য থাকায় আব্বা ব্যবসায়িকভাবেও লাভবান হন।
একদিন বাংলা একাডেমির সচিব মেজর (অব.) মাইনুল হাসানের সাথে কথা হচ্ছিল। সদস্য পদ নবায়নের জন্য চাঁদা দিতে গিয়েছিলাম। প্রসঙ্গক্রমে সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক কবি মনজুরে মাওলার কথা উঠে এল। বাংলা একাডেমির বর্তমান ঝকঝকে পরিবেশে উনার অবদান অনস্বীকার্য। নতুন নতুন বই প্রকাশ/বাৎসরিক সভার ব্যাপারে সাহিত্যিক মনজুরে মাওলার বেশ কিছু শর্ত ছিল। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলাতেও এক ধরনের শৃঙ্খলা ফিরে আসে। এই যে এখন পাইরেটেড বইমেলায় বিক্রয় করা যাবে না বলে যে নিয়মটি চালু আছে সেটি তাঁর আমলেই প্রবর্তন করা হয়। এককথায় উনি ছিলেন একজন সৃষ্টিশীল মানুষ। আমার সঙ্গে মেলার কারণেই পরিচয় হয়। একদিন হঠাৎ করে বাংলা একাডেমির পরিচালক জনাব হাবিবুল্লাহর মাধ্যমে আব্বার পুরো জীবন বৃত্তান্ত চেয়ে বসলেন। কেন তখন বুঝিনি পরে জানতে পারলাম প্রকাশনায় আব্বার ঈর্ষণীয় সাফল্যে তাঁকে বাংলা একাডেমি থেকে সম্মান প্রদান করা হবে। এটি ছিল আব্বার জন্য এক বিরল সম্মান। প্রকাশক হিসেবে তিনি বোধ হয় প্রথম যিনি এ ধরনের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছিলেন।
মাইনুল হাসান সাহেবের অফিস কক্ষে আলাপচারিতার মাঝখানে কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দ এলেন। তাঁর সঙ্গে সেরকম ঘনিষ্ঠতা আমার ছিল না। তবে সাহিত্যিক-সমালোচক হিসেবে তিনি আমার কাছে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। আমি তাঁর একজন শ্রোতা। কুশল বিনিময়ের পর উনার সঙ্গে পরিচিত হলাম। আব্বার কথা বললাম, বেশ অট্টহাসি দিয়ে তিনি বেশ মজা করে জিন্দাবাহারের আহমদ পাবলিশিং হাউসের স্মৃতি রোমন্থন করলেন। একবার কবি আল মুজাহিদীর সঙ্গে দেখা হয়। আব্বার সঙ্গে গিয়েছি বই প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজে। কথাবার্তার এক পর্যায়ে কবি আল মুজাহিদী বললেন, “আমরা একদিন আপনার বাসায় যাবো।” বেশ মজা করেই আব্বার কাছ থেকে দাওয়াতটা নিয়েছিলেন। যথারীতি দাওয়াতে কবি মুজাহিদী ও মান্নান সৈয়দ অংশগ্রহণ করেছিলেন। সেদিন নাকি বেশ সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থা ছিল।
এ ব্যাপারে আমার মরহুম মাকে স্মরণ না করে পারছি না। আম্মার সুস্বাদু রান্না অনেক কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক খেয়েছেন এবং অনেকদিন তার প্রশংসা করেছেন। কবি গোলাম মোস্তফার কন্যা ফিরোজা বেগম এবং তাঁর মেয়েরা পিঠা মৌসুমে আম্মার হাতের দুধ পিঠা খেতে আসতেন। যা হোক কবি মান্নান সৈয়দ বললেন, টেবিলে ঠিকমত খাবারদাবারের ব্যবস্থা করে দিয়ে মাঝে মধ্যে নাকি আব্বা উঠে পাশের ঘরে যেতেন। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “হয়তবা আমরা যাতে আরো সুখে তৃপ্তি সহকারে খেতে পারি তারই একটি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।” খাবারের পর dessert হিসেবে দেওয়া পেপের হালুয়ার তিনি বেশ প্রশংসা করলেন। খাবারের পর্ব শেষ হবার পর দুজনই তাদের দুটো বই প্রকাশের অনুরোধ করলেন। আব্বা বললেন, “ঠিক আছে।” কথাগুলো বলার সময় কবি মান্নান সৈয়দের মুখে ছিল এক প্রাণবন্ত হাসি। এ ঘটনাটি উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি লেখক-প্রকাশকের একটি নির্ভেজাল বন্ধনের দিকেই ইঙ্গিত দিলেন। এখন কি তেমনটি আছে?
লেখক: ট্রেজারার, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়