প্রচ্ছদ

আমার ছেলেবেলা

  |  ১১:৪৯, এপ্রিল ১৪, ২০২২
www.adarshabarta.com

শফিক আলম মেহেদী :

মেঘে মেঘে বেলা কম হলো না! স্মৃতির জানালায় আজ বেলা-অবেলায় হাতছানি দেয় সুদূর অতীত-বিশেষ করে স্বপ্নময় শৈশবকৈশোর। আজ ভাবতেও অবাক লাগে, কবে কখন কেমন করে পেছনে ফেলে এসেছি ছেলেবেলার হিরন্ময় দিনগুলো! এর শিকড় সন্ধানে আমাকে ফিরে যেতে হবে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের আমি-তে। শৈশব ও কৈশোরের ফেলে আসা সে আশ্চর্য-সুন্দর সময় আজও যেন আমাকে ব্যাকুল হয়ে ডাকে-আয় ফিরে আয়! কিন্তু ডাকলেই কি আর ফিরে যাওয়া যায় একদা যাপিত জীবনে!
বাবার চাকরিসূত্রে শৈশবের কয়েক বছর কেটেছে নেত্রকোণা জেলার কেন্দুয়ায়। ১৯৬০-৬১ সালে ওখানেই আমার প্রাথমিক শিক্ষায় হাতেখড়ি। স্বর্গীয় বনমালী স্যার ছিলেন আমার জীবনের প্রথম শিক্ষাগুরু। তারপর আদি জন্মনিবাস কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে ফিরে আসা। কটিয়াদি তখন আড়িয়াল খাঁ নদীঘেঁষা ব্যবসাবাণিজ্যে রমরমা একটি বর্ধিষ্ণু মফস্বল শহর। বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় ও স্বনামধন্য লেখক নিরদ সি চৌধুরীর পূর্বপুরুষদের স্মৃতিধন্য। শৈশবে দেখা নদী, নদীর বুকে পালতোলা নৌকা, কাশবন, সবুজ ফসলের বিস্তৃত মাঠ, আদিগন্ত নীলিমা অপরূপ ছবি হয়ে এখনও আমার মন কাড়ে!
১৯৬৫-৭০ সাল পর্যন্ত কটিয়াদি হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। স্কুলে তখন লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কাউটিং করি, কবিতা লিখি ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে নিয়মিত অংশ নিই। সে সময় থেকেই পাঠ্যবইয়ের চাইতে পাঠ্যবহির্ভূত বইপত্রের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করতে থাকি। দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা একটু একটু করে ছায়াপাত করতে শুরু করেছে তখন আমার অপরিণত বোধ ও বিশ্বাসে। সে সময় আমাদের তৎকালীন কিশোরগঞ্জ মহকুমার অবিসংবাদিত রাজনৈতিক নেতা ছিলেন আজকের বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। তাঁর হাত ধরেই আমার মতো অনেকের ছাত্র-রাজনীতিতে আসা। দেখতে দেখতে এসে গেল ১৯৬৬ এর ছাত্র আন্দোলন। আমরা কয়েকজন প্রত্যক্ষ উদ্যোগ নিয়ে থানা সদরে নির্মাণ করি শহীদ মিনার। তারপর আসে ঊনসত্তরের উত্তাল গণআন্দোলন, যার রেশ রয়ে যায় অনেক দিন অবধি।
‘মা’ নিঃসন্দেহে সন্তানের জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ও অহংকার। আমার মা ছিলেন যেন শাশ্বত বাঙালি মায়ের সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। শৈশবে তিনি তাঁর বড় বোনের বাসায় থেকে ময়মনসিংহ শহরের একটি মিশনারী স্কুলে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়াশোনা করেছেন। মিশনারী স্কুলের ব্যতিক্রমী পটভূমির কারণে তাঁর জীবনাচার ও দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরণের রুচিস্নিগ্ধ উদারতা ও মাধুর্য ফুটে উঠতো। আমি তখন সবে কলেজে ভর্তি হয়েছি। এখনও আশ্চর্য হই, অমল-ধবল কৈশোরে একটি কিশোরী মেয়েকে আমার ভালো লাগার কথা মাকে জানানোর মুহূর্তেও তিনি ছিলেন আশ্চর্যরকম প্রশান্ত ও স্বাভাবিক!
আমার বাবা ১৯৩৯ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ব্রিটিশ আমলে আমাদের এলাকার প্রথম গ্র্যাজুয়েট আমার বাবার জন্য আমার খুব গর্ব হতো। মাত্র তিন বছর বয়সে পিতৃহারা সন্তানকে তাঁর মা কী অপরিসীম ধৈর্য ও মমতা দিয়ে মানুষ করেছিলেন, তা ভেবে আজো আমি অবাক হই। বাবা তাঁর মায়ের কাছ থেকে নিয়েছিলেন একটি সহজ ও শান্তিময় জীবনযাপনের দীক্ষা। আর সে কারণেই অনেক ভালো চাকরি লাভের সুযোগ থাকা সত্বেও সারাজীবন তিনি পোস্টমাস্টার-এর সাদামাটা জীবন বেছে নিয়েছিলেন। অথচ অন্তর্লোকে ছিলেন ভীষণ আত্মপ্রসন্ন ও আলোকিত! পুরো এলাকায় আমাদের বাড়িটি ছিল যেন একটি জ্ঞানপীঠ। নানা ধরনের পত্রপত্রিকা ও বইপত্রে ভরপুর। সাহিত্যানুরাগী ও জ্ঞানপিপাসু বাবার অনুপ্রেরণায় স্কুল জীবনেই ‘প্রবাসী’, ‘দেশ’, ‘সঞ্চিতা’, ‘সঞ্চয়িতা’ ‘Morning News’, ‘Reader’s Digest’, ‘BBC’, ‘VOA’ ইত্যাদির সমাহারে বিপুল জ্ঞান ভান্ডারের এক বর্ণিল জগতে আমার প্রবেশ ঘটে। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের অসংখ্য কবিতা বাবার মুখস্থ ছিল যা তিনি আবৃত্তি করে শোনাতেন। বাড়িতে ছিল হল্যান্ডে তৈরি একটি বড় ফিলিপস্ রেডিও ও একটি গ্রামোফোন। আমি ভালবাসতাম গান, কবিতা, নাটক। রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে কখনো কখনো যাত্রাপালাও দেখতে যেতাম। ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে পরিচয় করানোর মানসে আমার বাবা আমাকে PAF Public School Sargodha, PAF Public School Lower Topa, Military College Jhelum ও ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের মতো স্বনামধন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে উৎসাহিত করেন। শেষ পর্যন্ত কোথাও যাওয়া না হলেও এতে আমার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়। | PAF Public School Sargodha-তে ভর্তির জন্য চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষা দিতে গিয়ে ১৯৬৭ সালে পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়েছিল ফরিদুর রেজা সাগর নামে এক সৌম্যদর্শন ও লাজুক প্রকৃতির কিশোরের সাথে। ভাবতে ভালো লাগে, সেদিনের সেই কিশোর আজ বহুমুখী প্রতিভার শাখা-প্রশাখা পল্লবিত করে দেশজ সংস্কৃতির এক মহীরুহে পরিণত হয়েছেন। আমার কৈশোরের আরেক বন্ধু জামিলকে নবম শ্রেণী হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। পরবর্তীতে সিভিল সার্ভিসেও আমরা সহকর্মী ছিলাম। ব্যক্তিক বন্ধুত্বের সীমানা পেরিয়ে আমাদের সম্পর্ক দুজনের পরিবারের বৃহত্তর পরিসরে আজ সম্প্রসারিত। আলোকিত পরিবারে জন্ম নেয়া আমার আবাল্য ঐ বন্ধুর সাথে আমার জীবনের দীর্ঘ পথচলার অনেক মধুর স্মৃতি জড়িত।
আমাকে নিয়ে আমার বাবা অনেক স্বপ্ন দেখতেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সীমিত শক্তি ও সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটুকুই যেন তিনি আমার পেছনে বিনিয়োগ করেছিলেন। তাঁর একান্ত চাওয়া ছিল যেন আমি মানুষের মতো মানুষ হই। উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে তিনি আমাকে সাফল্যের শিখরস্পর্শী বিখ্যাত সব মানুষের বর্ণাঢ্য জীবনের গল্প শোনাতেন। সে সব ছিল আমার কাছে রূপকথার মতো। এখন বুঝি, সব অর্থেই আমার কাছে আমার বাবা ছিলেন একজন প্রকৃত‘friend, philosopher and guide’.
কিশোর বেলায় আমার বেশ কজন বন্ধু ছিল। সবার কথা আজ সমানভাবে মনে নেই। যাদের কথা আজো স্মৃতিতে অমলিন তাদের মধ্যে রয়েছে সুলতান, জিল্লুর, অনিমেষ, স্নেহাংশু, মোশতাক, মোহাম্মদ আলী, শীতল, দুলাল, মৃত্যুঞ্জয়, সত্য, হারু, শংকর, সৈয়দ মোস্তফা। বয়সে কিছুটা বড় হলেও মামাত ভাই গোলাপ, খালাত ভাই শান্তি, ফুফাত ভাই আবদুল্লাহ আমার সহপাঠী ও বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। আরেক সমবয়সী মামাত ভাই আজহারউদ্দিন ও ডাকঘরকর্মী রুকন ভাই তখন আমার প্রিয়বন্ধু। কটিয়াদি হাই স্কুল থেকে ১৯৭০ সালে আমরা মাত্র ৪ জন এস এস সি পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উর্ত্তীণ হই। মনে পড়ে, কৃতী ছাত্র হিসেবে স্থানীয় অফিসার্স ক্লাবের পক্ষ থেকে আমাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সেই স্মৃতি আজও আমার কাছে অত্যন্ত মধুর ও মূল্যবান।
১৯৭০ সালের শেষদিকে ভর্তি হই ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে। তখন বুঝতে না পারলেও এখন বুঝি, আমার বাবা কেন আমাকে কঠিন শৃংখলাবদ্ধ জীবনের মধ্যে দেখতে চেয়েছিলেন। কলেজ জীবনের প্রথম দিনেই ‘নজরুল ইসলাম হল’-এ সৌভাগ্যক্রমে রুমমেট হিসেবে পেয়ে যাই নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা নামের একজন হৃদয়বান ও প্রতিভাদীপ্ত তরুণকে। তাঁর দীপ্তিময় তারুণ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল দেশপ্রেম ও সমাজমনস্কতা। পরবর্তীতে আমরা ১৯৮২ সালের নিয়মিত ব্যাচে সিভিল সার্ভিসে যোগ দিই। পেশাগত জীবনের সর্বত্র সততা, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখে কালক্রমে তিনি সরকারের সচিব পদ অলংকৃত করেন।
কলেজে অধ্যয়নকালে আসে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহ একাত্তর। একাত্তরের ৭ই মার্চ সকালে কিশোরগঞ্জের মরতুজা ও বুলবুলসহ কলেজ থেকে পালাই এবং বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। সেখান থেকেই মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দেশের বাড়ি ফিরি ট্রেনে মাঝরাতে। তখন সারাদেশে চলছে ছাত্রযুবাদের নিয়ে অন্যরকম দিনযাপনের প্রস্তুতি। দেশমাতৃকার ডাকে আমরা বেশ ক’জন বন্ধু একাত্তরের মে মাসের শেষ দিকে চলে যাই আগরতলায়। ওখানে যোগ দিই ‘যমুনা যুব শিবিরে’। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন মহান স্বাধীনতা। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে মুক্তির লাল সূর্যকে ছিনিয়ে আনার অসম সাহসী সে লড়াই প্রত্যক্ষ করি কাছ থেকে। জীবন দেয়ার অঙ্গীকারে দ্রোহ-প্রেমে প্রবাদপ্রতিম সে ছিল এক অন্য অনবদ্য জীবন।
কৈশোর-যৌবনের অনিন্দ্য দোলাচলের স্বরিত সময়ে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান পরিবারের একটি মিষ্টি মেয়ে আমার হৃদয় কাড়ে। পড়াশুনো, নাচ-গান, খেলাধুলো- সবখানেই ছিল তার নক্ষত্রখচিত উজ্জ্বল উপস্থিতি। সরকারি উচ্চপদে চাকরি শেষে তাদের পরিবার সবে জেলা শহর ছেড়ে থানা সদরে এসে বসবাস করতে শুরু করেছে। অপাপবিদ্ধ কৈশোরিক আবেগে ‘স্বপ্না’ নামের সেই রুচিস্নিগ্ধ মেয়েটি তখন থেকেই হয়ে যায় আমার অনিবার্য নিয়তি, দিনরাত্রির কাব্য! বাকিটা ব্যক্তিগত; দীর্ঘ যুগলজীবনের এক অনুপম গল্প, অনন্য-অভিজ্ঞান!
লেখক: সরকারের সাবেক সচিব, কবি।