প্রচ্ছদ

কানাইঘাট উপজেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্য

  |  ১০:৫১, অক্টোবর ১৩, ২০২২
www.adarshabarta.com

সাদেকুল আমিন:

বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী হিসাবে খ্যাত সিলেট জেলা। আর এ জেলার অন্যতম আধ্যাত্মিক এলাকা হিসাবে পরিচিত কানাইঘাট উপজেলা।

কানাইঘাট এলাকার মানুষের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তা হল এই এলাকার অধিকাংশ মানুষ গভীরভাবে ধার্মিক এবং তারা তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি আন্তরিকতার সাথে পালন করে। এখানে বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে স্থানীয় ও অন্যান্য এলাকার শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে এবং সাধারণ জ্ঞান লাভ করছে। আর এ অঞ্চলের মানুষ বিশেষ করে ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকায় তারা এতে গর্ববোধ করে।

যুগে যুগে কানাইঘাটে প্রখ্যাত আলেম, বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, পেশাজীবী, জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছে। পালাক্রমে অনেকেই এই ক্ষণস্থায়ী পার্থিব পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং যারা বেঁচে আছেন তাঁরা দেশে ও বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। আর তাঁরা তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মানুষের সেবা করে যাচ্ছেন।

আমরা আশা করছি কানাইঘাটের  ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদের মেধা বিকাশের মাধ্যমে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এলাকার মানুষের, দেশ ও মানবতার কল্যাণে অবদান রাখবে।

কানাইঘাট হল আদি জৈন্তিয়া রাজ্যের একটি ভূখণ্ড যা আসামের একটি প্রাচীন পার্বত্য রাজ্যের অংশ ছিল। জৈন্তিয়া রাজ্য ছিল একটি মাতৃতান্ত্রিক রাজ্য যা মহাকাব্য, পুরাণ এবং তান্ত্রিক সাহিত্যে উল্লেখ করা হয়েছে। সিলেট এবং এর বাইরে জৈন্তাপুরীদেরকে নিয়ে বহুল প্রচলিত একটি ক্যাচফ্রেজ আছে। আর তা হল; পান, পানি ও নারী – এই তিনে জৈন্তাপুরী।

আজ থেকে প্রায় ২৬৩ বছর আগে,  ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব মির্জা মুহাম্মদ সিরাজ উদ-দৌলা তাঁর রাজত্ব হারান। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবকে পরাজিত করে। নবাবের প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খানের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ব্রিটিশদের এই জয় নিশ্চিত হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাফল্যের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যা ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করেছিল।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০১ বছর ভারতের একটি বৃহৎ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করেছিল। তারপর ব্রিটিশ ক্রাউন ১৮৫৮ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮৯ বছর ভারত শাসন করে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ব্রিটিশ ক্রাউন একসাথে প্রায় ১৯০ বছর এই উপমহাদেশ শাসন করে।

পলাশীর যুদ্ধের ৭৮ বছর পর, ১৮৩৫ সালের ১৬ই মার্চ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিলেটের জৈন্তিয়া রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের প্রথম গভর্ণর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের অধীনে ছিল। ১৮৩৬ সালে, জৈন্তিয়া রাজ্যকে সিলেট জেলা কালেক্টরের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জৈন্তিয়া এলাকায় শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির স্থানীয় প্রশাসন প্রাথমিকভাবে জৈন্তাপুর এবং কানাইঘাটের মুলাগুল পরগণা এলাকায় দু’টি থানা (পুলিশ স্টেশন) স্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

পরে, ১৮৪১ সালে, মুলাগুল পরগণার লক্ষীপুর মৌজার ঝর্ণার টিলাতে একটি থানা প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে, ৩৯ বছর পর, ১৮৮০ সালে, মুলাগুল ভিত্তিক থানাটি কানাইঘাটে স্থানান্তরিত করা হয়। আজ অবধি এখান থেকেই থানার নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আর, কানাইঘাট থানা প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৪২ বছর হয়ে গেছে।

লর্ড কার্জন যখন ভারতের ভাইসরয় ছিলেন (১৮৯৯-১৯০৫), তখন কানাইঘাটে ‘আধুনিক শিক্ষা’ বা ‘ইংরেজি শিক্ষা’ ব্যবস্থা শুরু হয়। এই ব্যবস্থার ফলস্বরূপ, ১৯০৫ সালে ‘কানাইঘাট সরকারি এম ই’ স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর এই এম ই স্কুলই কানাইঘাটের প্রথম ‘আধুনিক শিক্ষা’ বা ‘ইংরেজি শিক্ষা’ প্রতিষ্ঠান। তবে, কানাইঘাটে এম ই স্কুল প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকেই আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষা শুরু হয়। মসজিদ ভিত্তিক অনেক খানকা ও মক্তব স্থানীয় লোকদের জন্য প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করত। তবে, এর পাশাপাশি কানাইঘাটে অনেক স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উচ্চ স্তরের ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান শুরু করে বেশ আগে থেকে। এ সব প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে প্রখ্যাত কয়েকটি হল; ঝিংগাবাড়ী আলিয়া মাদ্রাসা (প্রতিষ্ঠা কাল ১৮৭৪), উমরগঞ্জ ইমদাদুল উলূম মাদ্রাসা (১৮৯৮), মনসুরিয়া মাদ্রাসা যা পরে কানাইঘাট মনসুরিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা (১৮৮৯/১৯০০), কানাইঘাট দারুল উলূম মাদ্রাসা এবং গাছবাড়ী জামিউল উলূম মাদ্রাসা (১৯০১)।

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ থেকে প্রত্যাহার করার আগে, তারা দু’টি পৃথক ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র তৈরি করেছিল। রাষ্ট্রগুলি হল ভারত – যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের এবং পাকিস্তান – যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ছিল মুসলিম সম্প্রদায়ের। একই সময়ে, স্বাধীন পাকিস্তান ভৌগলিকভাবে দুটি পৃথক অংশে বিভক্ত ছিল; পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান। আর ভৌগলিকভাবে এ দু’টি অংশের দূরত্ব ছিল প্রায় এক হাজার মাইল।

১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ বিভক্তির সময়, কানাইঘাট সহ সিলেট ছিল আসাম প্রদেশের একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলা যা ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা। এ কারণে সিলেটের জনগণকে একটি বিভাজন গণভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আসামের সাথে থাকবে নাকি পূর্ব পাকিস্তানে যোগ দেবে। সিলেটের পাশাপাশি কানাইঘাটের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের জন্য ১৯৪৭ সালের ৭ই জুলাই গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। সিলেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে ভোট দেয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রায় ২৪ বছর এক রাষ্ট্র ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে নয় মাস যুদ্ধের পর, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়। ফলে সিলেট বাংলাদেশের অংশ হয়।

২৩শে ডিসেম্বর ১৯৮২ সালে,  তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার স্থানীয় সরকার (থানা পরিষদ ও থানা প্রশাসন পুনর্গঠন) অধ্যাদেশ ১৯৮২ জারি করে। আর এই অধ্যাদেশের অংশ হিসাবে, পূর্বে পরিচিত প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান ‘থানা’ যা ‘উপজেলা’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। ১৯৮৩ সালে, প্রতিষ্ঠার ১০৩ বছর পর, কানাইঘাট থানা একটি উপজেলায় পরিণত হয় এবং ‘কানাইঘাট উপজেলা’ নামকরণ করা হয়।

কানাইঘাট বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের সিলেট জেলার একটি উপজেলা। উপজেলাটির আয়তন ৪১২.২৫ বর্গ কিলোমিটার। ভৌগোলিকভাবে এর পশ্চিমে জৈন্তাপুর ও গোলাপগঞ্জ উপজেলা, পূর্বে ভারতের মেঘালয় রাজ্য, দক্ষিণে বিয়ানীবাজার ও জকিগঞ্জ উপজেলা এবং উত্তরে জৈন্তাপুর উপজেলা ও ভারতের মেঘালয় রাজ্য।

১৯৬০ সালের প্রথম দিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ইউনিয়ন পরিষদ চালু করে। এই প্রবর্তনের ফলে কানাইঘাট ৯টি ইউনিয়ন পরিষদে বিভক্ত হয়। ইউনিয়ন পরিষদগুলো হল: পূর্ব লক্ষ্মীপ্রসাদ, পশ্চিম লক্ষ্মীপ্রসাদ, পূর্ব দীঘিরপার, সাতবাক (পশ্চিম দীঘিরপার), বড় চতুল, কানাইঘাট, দক্ষিণ বাণীগ্রাম, ঝিংগাবাড়ী ও রাজাগঞ্জ।

২০০৫ সালে কানাইঘাট সদরকে পৌরসভা ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে উপজেলাটি ১টি পৌরসভা ও ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে গঠিত। আর কানাইঘাট পৌরসভা ৯টি ওয়ার্ড এবং ২৬টি মহল্লায় বিভক্ত। একইভাবে,  কানাইঘাট উপজেলা ৯টি ইউনিয়ন পরিষদ ৮১টি ওয়ার্ড, ১৯৮টি মৌজা এবং ২৬২টি গ্রামে বিভক্ত।

বাংলাদেশের আদমশুমারি ও গৃহগণনা ২০১১ অনুসারে, কানাইঘাট উপজেলার জনসংখ্যা হল ২৬৩,৯৬৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৮.৯৯% এবং মহিলা ৫১.০১%।  জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৬৭৪ জন। আর মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২৫৪,৯৪০ জন মুসলমান, ৮৭৩০ জন হিন্দু, ২৪৮ জন খ্রিস্টান, ৬ জন বৌদ্ধ এবং ৪৫ জন অন্যান্য। গড় সাক্ষরতার হার ৪৩.৫%। (বাংলাদেশের জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর ফলাফল এখনও প্রকাশ হয় নাই।)

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের ৩০০টি সংসদীয় আসন রয়েছে। কানাইঘাট উপজেলা হল ২৩৩ নম্বর নির্বাচনী এলাকা যা সিলেট ৫-এর অন্তর্ভুক্ত। কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট ৫ আসন।

পরিশেষে, এই লেখাটি কানাইঘাটের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান তুলে ধরার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র। আমরা আশা করি, এটি অন্যদেরকে কানাইঘাট উপজেলা নিয়ে আরও বিস্তারিত লেখা উপস্থাপন করতে উৎসাহিত করবে। তদ্ব্যতীত,  এখানে উল্লিখিত তথ্য ও পরিসংখ্যান আমাদের সকলের, বিশেষ করে তরুণদের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য উপকারী হবে এটাই প্রত্যাশিত।

 

লন্ডন, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২

************************