শিক্ষা আন্দোলন: প্রেক্ষিত জৈন্তা-কানাইঘাট
সরওয়ার ফারুকী:
জৈন্তা। প্রাচীন রাজতান্ত্রিক হিন্দু রাজ্য। ১৮৩৫ সালে স্বাধীন জৈন্তা রাজ্য ব্রিটিশ শাসনভূক্ত হলে জৈন্তার আধুনিক পর্ব শুরু হয় এবং সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসে। আজকের কানাইঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলা সাবেক জৈন্তা রাজ্যেরই অংশ, ইতিহাস ঐতিহ্যও একই সুতোয় গাঁথা। এখানকার শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাসও তা-ই। রাজতান্ত্রিক শাসনামলে জৈন্তায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্রমের কোন দলিল নেই। এ অঞ্চলের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-ইতিহাস একেবারেই নবীন এবং মুসলিম আগমনের সাথে সম্পৃক্ত।
শাহজালাল (র.)-এর সিলেট শুভাগমন পরবর্তী জৈন্তায় ইসলামের প্রচার তাঁরই ক’জন সঙ্গীর আহবানে যদিও ইসলামের প্রসার এখানে সিলেটের অন্যান্য এলাকার মত গতিশীল ছিল না। জৈন্তার বিস্তীর্ণ অনাবাদী, উর্বর কৃষিজমির মোহনীয় টান সিলেটের অপরাপর এলাকার মানুষকে এ অঞ্চলে বসতি স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করে। সুতরাং, যেসকল মধ্যবিত্ত মুসলিম শ্রেণী জৈন্তায় বসতি গড়েন তারা উচ্চ শিক্ষার লক্ষ্যে আসেন নি, নিজেরাও উচ্চ শিক্ষিত হয়ে আসেন নি, তারা এসেছিলেন মূলত কৃষিজমির লোভে। জৈন্তার বিস্তীর্ণ ভূমি ছিল অনাবাদি। সহজ শর্তে রাজ দরবার থেকে জমি বন্দোবস্ত নেয়া যেত ব্রিটিশ সরকারের মতো কঠিন শর্তে বা জমিদারের জালে বন্দী ছিল না জৈন্তার ভূমি। তাই, সিলেটের অপরাপর এলাকা থেকে মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায় এসেছেন, রাজ দরবার থেকে জমি গ্রহণ করেছেন, স্থায়ী বসতি গড়েছেন, কৃষিকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। রাজ দরবার থেকে সহজে শর্তে জমি বরাদ্ধ নেয়ার ফলে সকলেই ছিলেন সরাসরি ভূমির মালিক, তাই বৃহত্তর জৈন্তা অঞ্চলে রায়ত শ্রেণীর উপস্থিতি নেই। এছাড়াও হাতে গোনা ক’জন ধর্মপ্রচারক এসেছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে। এসকল মুসলিমের শুভাগমনে জৈন্তা ক্রমশ মুসলিম জামানায় প্রবেশ করে এবং নতুন চিত্র-চরিত্র ধারণ করে।
শাহজালাল (র.) সিলেট আগমনের প্রায় সাড়ে চারশো বছর পর জৈন্তার রাজধানী নিজপাটে প্রথম মসজিদ স্থাপিত হয়। রাজা বড় গোসাইর ভাগ্নে সেনাপতি ফতেহ খাঁ ১৭৬৫ সালে রাজধানী নিজপাটে এ মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। সেনাপতি ফতেহ খাঁ ছিলেন ঢাকার নবাব নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের পুত্র নবাব আলীবর্দি খানের জামাতা। ঢাকার নবাব নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের শাসনাধীন ছিল তৎকালীন সিলেট। জৈন্তা-সিলেট সীমান্ত-বিরোধ দেখা দিলে সেনাপতি নওশেরওয়ান সৈন্যসহ জৈন্তা অভিমূখে মার্চ করেন, কিন্তু রাজা বড় গোসাই যুদ্ধে জড়াননি, বরং সন্ধি স্থাপন করেন এবং নবাব নওয়াজিশ মোহাম্মদ খানের জন্যে রেওয়াজ অনুযায়ী উপটৌকন সহ আপন ভাগ্নী ভৈরবী কুয়ারিকে উপহার পাঠান। পরবর্তীতে রাজকুমারী ভৈরবী কুয়ারির গর্ভেই ১৭৪১ সালে জন্মগ্রহণ করেন সেনাপতি ফতেহ খাঁ এবং তার হাতে ১৭৬৫ সালে রাজধানী নিজপাঠে প্রতিষ্ঠিত হয় জৈন্তার প্রথম মসজিদ। মূলত এ সময়কাল থেকেই সাধারণ মুসলিম জনতার আগমন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়, সুরমা তীরবর্তী গ্রামসমূহ গড়ে ওঠে, যাদের প্রায় সকলেই সিলেটের অপরাপর উপজেলা থেকেই অভিবাসী। সুরমার তীর ঘেষে গড়ে ওঠা প্রতিটি গ্রামের নামকরণের দিকে তাকালেও তা সুস্পষ্ট হয়। নবাগত মুসলিম শ্রেণী ধর্মীয় দায়ে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অনুপস্থিতিতে জীবনাচারন হয়ে ওঠে ক্রমশ আচারনির্ভর। কালেমা পাঠ, মাথায় টুপি, গরুর মাংস খাওয়া, দাফন, খৎনা, আকীকা চর্চায় সীমাবদ্ধ ছিল ইসলামী জীবন। মৃতের আত্মীয়স্বজন ফাতেহা, চল্লিশা, বছরকি, মেজবানি, আশুরায় মাতমজারি, মোকামে ‘চেরাগি’ প্রজ্জ্বলন ছাড়াও ধর্মের বাহ্যিকাবরণে বন্দি ছিল মুসলিম মানস। রাজ দরবার থেকে মোকামের জন্য ‘চেরাগী’ নামে নিষ্কর জমিও পেতেন তারা।
১৭৬৫ সালে প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী একশো বছরের অধিক কাল পর্যন্ত জৈন্তা অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি বরং এ দীর্ঘ সময় জৈন্তার প্রতিটি মহল্লায় প্রতিষ্ঠিত হয় পাঞ্জেগানা বা জামে মসজিদ। তখন মসজিদের ইমামকে সম্মানজনক উপনাম ‘কাজি সা’ব এবং হজ্বফেরত হাজীদের ‘মোল্লা’ নামে ডাকা হত। অনেকেই পায়ে হেটে হজ সমাপ্ত করে দেশে ফিরেন এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষাসমূহ দিতে থাকেন। এসকল কাজী অথবা ‘মোল্ল’-দের হাত ধরেই শুরু হয় জৈন্তার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাপর্ব। মূলত পারিবারিক শিক্ষাপর্বের বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অস্তিত্ব জৈন্তা অঞ্চলে ছিল না।
দেওবন্দী শিক্ষাধারায় জৈন্তা-কানাইঘাট:
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হলে উপমহাদেশীয় আলেম সমাজের উল্লেখযোগ্য অংশ সশস্ত্র সংগ্রামের দুর্বলতা খুঁজতে গিয়ে শিক্ষা আন্দোলনের দিকে ঝুকে পড়েন। দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা, আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় তেমন চিন্তার ফসল। এ দুটো প্রতিষ্ঠানের সরাসরি প্রভাবে প্রভাবিত ছিল ভারতবর্ষীয় মুসলিম মানস জৈন্তাও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এ সময় বনেদি পরিবারসমূহে উচ্চশিক্ষার বাসনা তৈরি হয়। হজ-ফেরত ‘মোল্লা’ অথবা পারিবারিক প্রচেষ্টায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তির পর অনেকেই লেখাপড়া করতে যান ফুলবাড়ি আজিরিয়া মাদ্রাসায়, আবার কেউকেউ ভারতবর্ষের কোথাও।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি আজিরিয়া মাদ্রাসা সিলেটের অন্যতম প্রাচীন মাদ্রাসা। আজিরিয়া মাদ্রাসার পাঠপর্ব সমাপ্তির পর উচ্চশিক্ষা অর্জনের একটি অদম্য স্পৃহা অনেকের মনেই জেগে উঠত তারা ছুটে যেতেন ভারতের অন্য কোনো উল্লেখযোগ্য শিক্ষাঙ্গনে। এ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ফুলবাড়ি আজিরিয়া মাদ্রাসার ব্যাপক অবদান রয়েছে। ফুলবাড়ি শিক্ষা সমাপ্তির পর অনেকেই যেতেন কলকাতা, দিল্লী, দেওবন্দ, রামপুরের সর্বভারতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহে। ইলম অর্জনের অদম্য প্রেরণা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতেন তারা। বিশেষ করে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হলে পুরো উপমহাদেশব্যাপী যে জাগরণ ওঠে তার আঁচ থেকে জৈন্তা-কানাইঘাটও মহরুম থাকে নি। উচ্চশিক্ষার স্বপ্নে বিভোর যুবকেরা ভারতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সাফল্যের সাথে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন, নানান খেতাব বা উপাধি অর্জন করে অনেকেই সর্বভারতীয় পরিচিতি লাভ করেন। বিষ্ময়কর সত্য তারা ইচ্ছের গোলামি করেন নি, বরং আপন কওমের চিন্তায় পেরেশান হন। সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা সহ, নানান প্রাতিষ্ঠানিক পদে চাকুরির লোভনীয় প্রস্তাব পেলেও তারা ফিরে আসেন, এলাকায় শিক্ষা আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখেন। তাদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে মসজিদ-আঙিনায় মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন, প্রাক-প্রাথমিক থেকে শিশুদের নিয়ে শিক্ষা আন্দোলন শুরু করেন। এ বিষ্ময়কর কোরবানি জৈন্তা এলাকার স্বকীয় সত্ত্বা নির্মানে অনন্য ভূমিকা রাখে। সিলেট প্রেসক্লাবের সবেক সভাপতি মুকতাবিস-উন-নুর বলেন, “অন্তত পঞ্চাশের অধিক আলেম এই সময়ে জন্মগ্রহণ করেন যারা সমকালীন বিশ্বের যেকোনো ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানের যোগ্যতা ধারণ করেও এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে জীবনের সকল সুখ বিসর্জন দেন, ক্বওমের জন্য আত্মত্যাগের বিস্ময়কর নজরানা পেশ করেন। একই সময়ে কানাইঘাটে এত সংখ্যক আলেমের জন্ম হয় যে অনেক সময় একটা দেশেও এ মানের এত সংখ্যক আলেম একসাথে পাওয়া দুষ্কর হতে পারে।” মাওলানা তাহের সিলেটি, মাওলানা আব্দুল বারি, মাওলানা ইসমাইল আলম, মাওলানা ইবরাহিম তশ্না, মাওলানা ইবরাহিম চতুলি, ইবরাহিম দরিয়া, মাওলানা আবুল ফজল কামিল, মাওলানা আবু ইউসুফ ইয়াকুব আলী, মাওলানা পীর শফিকুল হক, বাহরুল উলুম মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন, মাওলানা আব্দুর রহিম চড়িপাড়ি, মাওলানা ফয়জুল হক বায়মপুরি, মাওলানা আব্দুল আজিজ, মাওলানা নিসার আলী, মাওলানা আনজব আলী শওক, মাওলানা মোশাহিদ বায়মপুরি, মাওলানা শফিকুল হক বুলবুল সহ এক ঝাঁক আলেম জন্মগ্রহণ করেন যারা শিক্ষায়, প্রজ্ঞায় সমকালীন ভারতবর্ষে মশহুর ছিলেন।
মাওলানা আবদুল বারী মীরমাটি (রহ.) উত্তর প্রদেশের মাযাহেরুল উলুম সাহারানপুর থেকে শিক্ষা সমাপ্তির পর অধিকতর শিক্ষা গ্রহনের জন্যে ভর্তি হন দারুল উলুম দেওবন্দ-এ। শিক্ষাজীবন শেষে তিনি দেশে ফিরেন এবং তারই ত্যাগ ও মাওলানা আব্দুর রহিম, মাওলানা ইবরাহিম (রহ.)-দ্বয়ের সহযোগিতায় ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠা হয় জৈন্তা অঞ্চলের প্রথম দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘ঝিঙ্গাবাড়ি হাই মাদ্রাসা’। লক্ষ্যণীয়; প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠার ১১৭ বছর পর জৈন্তায় প্রথম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উদ্বোধন হয়। মাওলানা তাহের দিল্লি, বর্ধমান শিক্ষা পরবর্তী সময়ে কলকাতার কালুটোলা মাদ্রাসার মোহাদ্দিসের আসন ছেড়ে চলে আসেন। মাওলানা আবদুল আজীজ ও তার ভাগ্নে মাওলানা নিসার আলী একইসাথে কলকাতা আলীয়া থেকে ১৯৩০ সালের কামিল পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম ও ভাগ্নে নিসার আলী প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। দুজনেই কলকাতা আলীয়ায় শিক্ষকতার সুযোগ উপেক্ষা করে নিজ গ্রাম ‘ঝিঙাবড়ি মাদ্রাসা’য় যুক্ত হন। এসকল ট্যালেন্টদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠানকে দ্রুতই জনপ্রিয় করে এবং সিলেট অঞ্চলে ইসলামি শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৮৮৯ সালে কানাইঘাট ইসলামিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়, পরবর্তীতে যা মনসুরিয়া নাম ধারণ করে। ১৯৫০ সালে তৎকালীন মুহতামিম মাওলানা আবদুর রব ক্বাসেমীর প্রচেষ্টায় বড়বন্দ-বাসী আহমদ আলী সাহেব জমি এবং ভবন বানিয়ে দিলে টাইটেল ক্লাস চালু হয়। এ সময় আল্লামা মোশাহিদ বাইওমপুরি গাছবাড়ি জামেউল উলুম মাদ্রাসা থেকে কানাইঘাট মাদ্রাসায় যোগদান করলে অভূতপূর্ব গতি সঞ্চার হয়। ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে ইমদাদুল উলুম উমরগঞ্জ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন মাওলানা ইবরাহিম তশ্না (রহ.)। তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার কৃতি ছাত্র। সর্বভারতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে ছিল তার বিচরণ। দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনিও পেছনে পড়া আপন এলাকায় শিক্ষা আন্দোলনের লক্ষ্যে সক্রিয় হন। এ ব্যাপারে তশ্নার বুদ্ধিদৃপ্ত একটি বক্তব্য পাওয়া যায়, ১৮৯৮ সালে এলাকায় সামাজিক বৈঠক ডেকে তিনি প্রস্তাব করেন, দীর্ঘ নয় বছর সফর করে আপনাদের জন্য কিছু খেজুর এনেছি, আজ এ বৈঠকে খেজুরগুলো বিলাতে চাই। লোকজন তার হাতের দিকে তাকায়, তখন তিনি বলেন, এ খেজুর ইলমে দীনের খেজুর, আজ এখানে ইলমে দীনের একটি খেজুরবৃক্ষ রূপন করতে চাই, যা কেয়ামত পর্যন্ত এ এলাকায় ইলমে দীনের ফসল ফলাতে থাকবে এবং সেদিন প্রতিষ্ঠিত হয় ইমদাদুল ইলুম উমরগঞ্জ মাদ্রাসা। এভাবেই জৈন্তা এলাকায় একেকজনের একেকরকম সাহসী উদ্যোগে দ্রুতগামী অশ্বের মতো চলতে থাকে জৈন্তার শিক্ষা আন্দোলন। মাওলানা জামালুদ্দিন দেওবন্দ-এর কৃতি ছাত্র। ১৯০১ সালে ক্বারী আতাহার আলী (র.)-র উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত গাছবাড়ি জামেউল উলুম মাদ্রাসার প্রথম শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। মাওলানা জামালউদ্দিন ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানতুভি (রহ.)-এর অন্যতম ছাত্র। গাছবাড়ি জামেউল উলুম মাদ্রাসার প্রথম সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দেওবন্দ-ফেরত আলেমে দ্বীন মাওলানা আব্দুল বারী ঘড়াইগ্রামী। মাওলানা আবদুল বারী (র.)-কে দারুল উলুম দেওবন্দ কর্তপক্ষ অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন, তার কবর জেয়ারতের উদ্দেশ্যে একাধিকবার এসেছিলেন সর্বভারতীয় রাজনৈতিক নেতা মাওলানা হোসেন আহমদ মাদানী (র.)। মাওলানা কামিল উত্তর প্রদেশের রামপুর মাদ্রাসা থেকে হাদিসের সনদ লাভ করে গাছবাড়ি জামেউল উলুম মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ভারতবর্ষের সেরা প্রতিষ্ঠানের সেরা ছাত্ররা শিক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকায় সফলতার মাত্রা প্রত্যাশা ছাড়িয়ে যায়। পর্যায়ত্রমে; দারুস সালাম লাফনাউট মাদ্রাসা, মদিনাতুল উলুম খরিলহাট মাদ্রাসা সহ জৈন্তা-কানাইঘাটে যত মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয় সবগুলোই দেওবন্দী ওলামাদের অবদান। ১৯শতকের আগে উচ্চশিক্ষাফেরত যে কয়জন আলেমের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় তারাই মূলত জৈন্তা অঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীকালে সিলেট জেলার প্রায় প্রতিটি ইসালামী প্রতিষ্ঠানে এসকল উলামার ব্যাপক প্রভাব ও অবদান অনস্বীকার্য হয়ে ওঠে।
নারীশিক্ষা আন্দোলন:
এ অঞ্চলে নারী শিক্ষা আন্দোলনের ইতিহাস একেবারেই নবীন। নারীশিক্ষার ব্যাপারে জনসচেতনতা ছিলই না। বনেদি পরিবার সমূহে পারিবারিক তত্ত্বাবধানে নিরেট দ্বীনি শিক্ষার যেটুকু শেখানো হতো তাই ছিল নারীর পাথেয়। কোরআন শেখা, নামাজ-ওজু-গোসলের মাসয়ালা শেখার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল জ্ঞান চর্চা। পূর্ব পাকিস্থানের সাবেক রাজস্ব মন্ত্রী আবদুস সালাম স্মৃতিচারণ করেন, “আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে বিবাহের আগেই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে এম. এল. এ হয়ে গেলাম। বাবা বিবাহ দিবেন, কিন্তু জৈন্তা-কানাইঘাট-জকিগঞ্জ কোথাও মেট্রিক পাশ মেয়ে পাচ্ছেন না। কেউ একজন আব্বার কাছে খবর দিলেন গোয়াইনঘাটের জনাব হাসন আলীর মেয়ে করিমুন নেসা মেট্রিক পাশ করেছেন। জনাব হাসন আলী তখন পুলিশের ইন্সপেক্টর। অবশেষে ১৯৩৭ সালে সেখানেই বিয়ে।” বৃহত্তর জৈন্তার কোথাও মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। মাওলানা নিছার আলী (র.) ১৯৩০ সালে এলাকায় ফিরে ১৯৫৫ সালের দিকে মেয়েদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে একটি কার্যক্রম চালু করেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলাদের শিক্ষাদানের একটি কার্যক্রম চালুর কিছু দিনের মধ্যেই মাওলানা নিসার আলীর ওফাত হয়। পরবর্তীতে তারই সুযোগ্য মুরিদ মাওলানা ওলিউর রহমান হাল ধরেন এবং উমরগঞ্জ মাদ্রাসায় সাপ্তাহিক মহিলা ইজতেমার আয়োজন করে প্রাতিষ্ঠানিকিকরণের চেষ্টা করেন। প্রতি বুধবার তিনি মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট করেন। কুরআন শিক্ষা, দৈনন্দিন জীবনের ইসলামি বিধিবিধান সহ প্রয়োজনীয় দোয়াদরুদ শেখান। এখানে কোনো বয়সের বিধিনিষেধ ছিল না, যেকোনো বয়সের নারী এসে তার মাদ্রাসায় পড়তে পারতেন, সেখানে কোনো শ্রেণী বিন্যাস ছিল না। সমকালীন আলেম সমাজের অনেকেই এ কার্যক্রমের সাথে একমত হতে পারেন নি। মহিলাদের জন্য আলাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জায়েজ কী জায়েজ নয় এমন একটি দ্বন্ধ তৈরি হয়। আল্লামা মোশাহিদ বায়মপুরি (রহ) বলেন, “তিনি ওলি মানুষ, এই ফেতনার যুগে মহিলাদেরকে বাইরে নিয়ে আসা ঠিক হচ্ছে না।” নারীশিক্ষার ব্যাপারে সচেতনতা তৈরি পাশাপাশি ওলিউর রহমান ‘ইসলাহুন নেসওয়ান’ ‘তালিমুন নেসওয়ান’ সহ কতিপয় পুস্তিকা প্রকাশ করেন। ১৯৮১ সালে জৈন্তা অঞ্চলের প্রথম মহিলা মাদ্রাসা ‘মাদ্রাসাতুন বানাত, উমরগঞ্জ’ নামে মহিলা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করলে কানাইঘাট দারুল উলুম মাদ্রাসার শিক্ষক, প্রবীণ আলেম মাওলানা ফয়জুল বারি (র.) উমরগঞ্জ মাদ্রাসার বার্ষিক জলসায় এমন উদ্যোগের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। বীরদল আনওয়ারুল উলুম মাদ্রাসার জলসায় শাইখুল হাদিস আবদুল্লাহ হরিপুরি (র.) ওলিউর রহমান রহ-এর কাজের ব্যাপারে ‘চেঙও উজাইন ব্যঙও উজাইন, খইয়া-পুঁটি তাইনও উজাইন’ মন্তব্য করলে ওলিউর রহমান মাহফিল বয়কট করেন। এ বিব্রতকর সময়ে পাশে দাঁড়ান দেওবন্দ ফেরত আরেকদল ওলামা মাওলানা শফিকুল হক বুলবুল, মাওলানা ইদ্রিস আহমদ শিবনগরী, মাওলানা আবদুল গফফার মামরখানি (র.)। গাছবাড়ি জামেউল উলুম কামিল মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রহিম বলেন, “মাওলানা ওলিউর রহমান (র.) যখন নারীশিক্ষার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তখন যদি উলামায়ে কেরামের সহযোগিতা করতেন, তাহলে ইসলামি শিক্ষা এ অঞ্চলে অনেক দূর এগিয়ে যেত।” ফুলবাড়ি আজিরিয়া মাদ্রাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল্লাহ বলেন, “ওলিউর রহমান রহ-এর দূরদর্শী চিন্তা সমকালীন উলামায়ে কেরামের অনেকেই বুঝে ওঠতে পারেন নি, তিনি সবসময় দূরের কথা চিন্তা করতেন, জীবদ্দশায় তাঁর কদর করা যায় নি।”
সহশিক্ষার আইনগত সুবিধা নিয়ে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা হলেও এ এলাকার মুসলিম মানস তা দ্রুত গ্রহণ করে নি। মসজিদ, মাদ্রাসা, ইসলামি জলসায় সহশিক্ষার কুফল নিয়ে ব্যাপক কথাবার্তা হয়। ফলে স্কুলশিক্ষায় মেয়েরা এগিয়ে আসতে পারেন নি। ব্রিটিশ বা পাকিন্থান আমলে জৈন্তা-কানাইঘাট এলাকায় আধুনিক শিক্ষিতার সন্ধান পাওয়া ছিল দুরূহ। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে বৈশ্বিক প্রবণতা এবং সরকারি উদ্যোগের ফলে নারীশিক্ষায় ব্যাপক সচেতনতা তৈরি হয়। ১৯৮৭ সালে জৈন্তাপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং একই সালে কানাইঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান এম.এ রকিবের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠত হয় রামিজা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। ১৯৯৩ সালে তিনসতি গ্রামের জনাব আব্দুল খালিকের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত হয় হাজি আব্দুল খালিক মহিলা মাদরাসা। —জন ছাত্রি ও —জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করে আব্দুল খালিক মহিলা মাদরাসা। এভাবে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার নানান বাঁধ ভেঙে জৈন্তা-কানাইঘাটে নারী শিক্ষার প্রাথমিক পর্ব শুরু হয়।
আধুনিক শিক্ষা আন্দোলন:
শিল্পবিপ্লব পরবর্তী পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থার যে রূপ উপমহাদেশে তা-ই আধুনিক শিক্ষা হিসেবে পরিচিত। কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা, কাশী সংস্কৃত কলেজ ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে এদেশে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের গোড়াপত্তনকারী বলে বিবেচনা করা হয়। ১৮৩৫ সালে লর্ড ম্যাকেল ‘মিনিট অন এডুকেশন’-এ প্রস্তাব করেন যে, ভারতেবর্ষে শিক্ষা প্রসারের মাধ্যম হবে ইংরেজি। ফলশ্রুতিতে ১৮৩৫ সালেই গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশন অ্যাক্ট’-এ ইংরেজি ভাষাকে প্রধান মাধ্যম বলে অনুমোদন দেন। লর্ড ম্যাকলে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিকে অন্য দেশের সংস্কৃতির তুলনায় কী পরিমাণ বড় করে দেখতেন তা মিনিট অন এডুকেশনের লেখাতেই ফুটে ওঠে তিনি বলেন, “ভালো একটা ইউরোপীয় লাইব্রেরীর বইয়ের একটি শেলফে যে পরিমাণ সাহিত্যজ্ঞান আছে, পুরো ভারত আর আরব সাহিত্যেও সেরকম জ্ঞানের প্রাচুর্যতা নেই”। এমন আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির ফলশ্রুতিতেই ইংরেজি হয়ে ওঠে ভারতবর্ষের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিস্তারের প্রধাণতম ভাষা।
জৈন্তা অঞ্চলে শিক্ষা আন্দোলনের সুচনায় দেওবন্দী শিক্ষাধারা জনপ্রিয় হলে, এবং এ আন্দোলনে প্রভাবশালীদের অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগ যুক্ত হলে, পাশ্চাত্য বা আধুনিক শিক্ষাধারা প্রভাবশালী হতে পারে নি। এ পরিস্থিতিতে বাস্তবদর্শী অনেকেই স্কুল শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন এবং প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯০৫ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন এবং স্থানীয় জনগণের সহযোগীতায় কানাইঘাটে সরকারি মধ্য ইংরেজি স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়। পর্যায়ক্রমে স্কুলশিক্ষা জনপ্রিয়তা পায়। গবেষক ফজলুর রহমান শিক্ষাব্যবস্থার প্রাথমিক পর্বের বর্ণনা লিখেন, “বাংলা ও ইংরাজি শিক্ষায় জৈন্তার লোক অদ্যাপি পশ্চাতে। কারণ পূর্বে ইহার কোন ভাল বন্দোবস্ত ছিল না এবং আরবি, ফার্সীরই বিশেষ প্রচলন ছিল। ইংরেজ আমলের প্রথম ভাগে দলীল পত্রাদি ফারসিতে লেখা হইত। মুসলনানেরা বাংলা শিখিতে পশ্চাতপদ ছিলেন। জৈন্তায় উচ্চ ইংরেজি স্কুল ছিল না। এই কারণে জৈন্তাবাসী উচ্চশিক্ষায় আজ পশ্চাতে। গবর্নমেন্টের নিকট বহু আবেদন নিবেদন করিয়াও কোন ফল পাওয়া যায় নাই। স্থানীয় কতিপয় ব্যক্তির আপ্রাণ চেষ্টায় ও স্থানীয় অর্থ সাহায্যে ১৯৩২ ইং হইতে কানাইঘাটে জৈন্তা হাই স্কুল নামে একটি হাই স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রসঙ্গে মৌলবী হাতিম আলী নাজির, মৌলবী আম্বর আলী তহশীলদার, মৌলবী মাং ইউনুছ সেক্রেটারি জৈন্তা আঞ্জুমান, হেলিম মিয়া চৌধুরী, মুজফফর আলী, বাবু জগন্নাথ চৌধুরীর নাম উল্লেখযোগ্য।” জৈন্তা অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে মৌলবী আম্বর আলীর অবদানকে গবেষক মুহাম্মদ শামসুদ্দন স্যার সৈয়দ আহমদের সাথে তুলনা করেছেন। এ সময়ে ঝিঙাবাড়ি হাই মাদ্রাসার সরকারি অনুমোদন থাকায় উচ্চশিক্ষার দ্বার কিছুটা সহজ হয়। ঝিঙাবাড়ি হাই মাদ্রাসা ইসলাম ও আধুনিক শিক্ষার যোগসূত্র হিসেবে কাজ করে। গবেষক ফজলুর রহমান ১৯৬০ সাল পর্যন্ত জৈন্তা অঞ্চল থেকে আটান্ন জন গ্রাজুয়েটের একটি তালিকা প্রণয়ন করেছেন। ৯০দশক পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রিন্সিপাল সিরাজুল ইসলাম আধুনিক শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখছেন। কানাইঘাট সরকারি ডিগ্রি কলেজ, কানাইঘাট মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠা সহ আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে আত্মত্যাগের অসামান্য নজির পেশ করছেন। আধুনিক শিক্ষায় যারা জৈন্তা অঞ্চল থেকে জাতীয় পর্যায়ে নানান বিভাগে খ্যাতি অর্জন করেছেন, স্থানীয় শিক্ষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে তারা ততটা সক্রিয় থাকেন নিÑ যতটা সক্রিয় ছিলেন দেওবন্দী উলামায়ে কেরাম। দেওবন্দী আলেমসমাজ যেভাবে এলাকায় ফিরে শিক্ষা আন্দোলনের পেছনে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন, উচ্চ শিক্ষিত আধুনিক সমাজ সেভাবে এলাকায় ফিরেন নি। এমনকি; ব্যতিক্রম ছাড়া তাদেরকে জন্মভূমির সাধারণ জনগণ দেখতেও পায় নি। এখানেই দেওবন্দী শিক্ষা এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থার একটি মৌলিক তফাৎ। দেওবন্দী শিক্ষাব্যবস্থা যতটা আত্মত্যাগী প্রজন্ম তৈরি করেছে, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা ততটা আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতা তৈরি করেছে। দেওবন্দী শিক্ষা আন্দোলনের চরিত্র ছিল নিজেকে বিসর্জন, বিপরীতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ধারার চরিত্র ছিল কেবল নিজেকে গঠন। দু শিক্ষাধারার এই চরিত্রগত পার্থক্য জাতীয় চিন্তাভাবনায় বিস্তর মতপার্থক্য তৈরি করছে, জাতিও তার খেসারত দিচ্ছে।
লেখক: একজন প্রবন্ধিক এবং সমাজকর্মী, কানাইঘাট