তুরস্কের আন্টালিয়া নগরীতে সাত দিন
শিহাবুজ্জামান কামাল :
আল্লাহর সৃষ্টি রাজ্য নানা রূপ,সৌন্দর্য ও বৈচিত্রে ভরপুর। তিনি বিশ্বের একেক দেশকে সাজিয়েছেন অপরূপ সাজে। রয়েছে কতনা বিচিত্র প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং আবহাওয়ার নানা বৈচিত্রতা। একি সাথে সেই সমস্ত দেশের রয়েছে ভিন্ন ইতিহাস ঐতিহ্য,ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি এবং সভ্যতার নানা প্রচীণ ইতিকথা।
আর এ সমস্ত দেশ ভ্রমণ করে জানা যায় প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যের কথা।
সাম্প্রতিক বিশ্বের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ঘেরা এবং অনুপম লীলাভূমি পুর্ণ একটি দেশের নাম তুরস্ক। বিশ্বের ভ্রমণ পিপাসু মানুষের কাছে এই দেশটা বিশেষভাবে সুপরিচিত।
তুরস্ক: তুর্কি বা তার্কি শব্দ থেকে আগত। মুলত এটি তুর্কি জনগোষ্ঠীর ভুখন্ড। এই অঞ্চলে তুর্কি জনগোষ্ঠী হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করতো তাই দেশটির নাম হয় টার্কি বা তুরস্ক। এই দেশটির রয়েছে ভাঙ্গা গড়ার অনেক পুরনো ইতিহাস। দেশটির প্রধান ভাষা তুর্কি।
জন সংখ্যা ২০২১ সালের হিসাবে ৮৪.৭৮ মিলিয়ন।
আয়তন: ৭৮,৩,৫৬২ বর্গ কিলোমিটার এবং ৩,০২,৫৩৫ বর্গ মাইল। দেশটা চতর্ভূজ আকৃতির।
দেশটিতে একাধিক ভাষা রয়েছে। এর মধ্যে আরবী, কুর্দি, জর্জিয়া, জার্মানী,আদিগে,আজারবাইজান ও রোমামী অন্যতম। তবে দেশের ৯০ ভাগই মুসলিম জনগোষ্ঠী। এটি ধর্মনিরপেক্ষ একটি দেশ।
তুরস্কের রাজধানী আনাতোলিয়ার আঙ্কারায় অবস্থিত। দেশটির বাকী অংশের নাম পুর্ব বা তুর্কীয় থ্রাস। এটি ইউরোপের দক্ষিণ পুর্ব কোনায় অবস্থিত। এই অঞ্চলটি খুবই উর্বর উচু নীচু পাহাড় টিলা নিয়ে গঠিত। তুরস্কের রাজধানী বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুল অবস্থিত।
তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি পানিপথ এশিয়া ও ইউরোপ যে তুরস্ককে পৃথক করেছে সেগুলো হলো মার্মরা সাগর, বসফরাস প্রনালী এবং দার্দানেল প্রনালী। এই তিনটি পানি পথ একত্রে কৃঞ্চ সাগর থেকে এজিয় সাগরে যাওয়ার এক মাত্র পথ।
তুরস্কের সেরা শহর গুলোর মধ্যে ইস্তাম্বুল, আন্টালিয়া, বুর্সা ও সানলিউরফা অন্যতম।
তুরস্কের রাষ্ট্র প্রধানের নাম, বতর্মান বিশ্বের সাড়া জাগানো ব্যক্তিত্ব রেজেপ তাইয়িপ এরদোয়ান। তুরস্কের মুদ্রার নাম: লিরা। বর্তমানে ১পাউন্ড সমান ২৫ লিরা। তবে সেখানে ইউরো মুদ্রার ছড়াছড়ি।
তরস্কের আন্টালিয়া ভ্রমণ : গত ৪ঠা জুন আমার পরিবার নিয়ে তুরস্কের আন্টালিয়া শহরে বেড়াতে যাই। সাথে ছিলেন আমার শ্যালক গোলাম মোস্তফা জুবায়ের নূর ও তার পরিবার।
লন্ডনের গেট উইয়ক বিমান বন্দর থেকে রাত ১০ টায় তুর্কিয় এয়ার লাইন “ফ্রি বার্ড’ তুরস্কের উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করে।
তুরস্কের স্থানিয় সময় ভোর ৬টায় ‘আন্টালিয়া ইন্টারন্যাশনাল বিমান বন্দর’এ অবতরণ করে। বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশন শেষে ল্যাগেজ গুলো নিয়ে বাইরে যাই। সেখানে বুকিংকৃত গাড়ি আমাদেরকে নিয়ে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। চারিদিকের রাস্তাঘাট ছিমছাম। রাস্তার দুপাশে সারি সারি খেজুরের গাছ। থোকা থোকা ফুল আর পাতাবাহারী গাছ। প্রায় ৪৫ মিনিটের রাস্তা পেরিয়ে আন্টালিয়ার শহরের সেডর এলাকায় পৌছি। আমাদের হোটেলের নাম কাষ্টালিয়া হোটেল। সেখানে বিশ্রাম শেষে খাওয়াদাওয়া করি। সুন্দর রৌদ্র উজ্জ্বল দিন সুর্যের প্রখরতা ও বেশি। তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রী সেলসিয়াস।
পরদিন দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বিকালে সেডরের স্থানিয় এলাকায় বেড়াতে যাই। রাস্তায় পাওয়া যায় লোকাল বাস, টেক্সি। আমরা সেডর শহরের পাশে ‘ওয়াটর ফল’ এলাকা দেখতে যাই। সেখানে টিকেট কেটে ঢূকতে হয়। প্রাকৃতিক ভাবে উচু পাথরের পাহাড়ের গা ঘেঁষে শাঁ শাাঁ শব্দে দ্রুত গড়িয়ে পড়ছে স্বচ্ছ জলরাশি। মানুষ ক্যামেরা বন্দি করছে সেখানকার সুন্দর দৃশ্য গুলো। পরে আমরা মোটর জিপে সাফারি মাউন্টটেনে যাই। আমাদের সাথে ছিল প্রায় ৪০টি মাউন্টটেন জিপ। উচূ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা সুরু পথে ড্রাইভার বেপরওয়া গাড়ি চালিযে ছুটছিল।
দুপুরের লাঞ্চ সেরে আমরা সমুদ্র ভ্রমণে যাই। বোটে করে আমাদের ঘুরে ঘুরে স্থানিয় সামুদ্রিক এলাকা দেখানো হয়। পরে আমাদের গন্তব্যস্থলে নিয়ে আসে।
রাস্তার দুপাশে বিস্তর মাঠ।কখনো উচু নীচু পাহাড়ি এলাকা। সারিবদ্ধ খেজুর গাছ। থোকা থোকা গাছে পাকা কমলা লেবু। তবে একটা জিনিস নজরে পড়ে। রাস্তার দুরপাশে বিস্তৃত জমিতে দীর্ঘ লাইন ধরে টিন দিযে সেডের ঘর। জান যায় এগুলো হচ্ছে নার্সারি। সেখানে কলা ও অন্যান্য ফল ফুলের চাষ করা হয়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে টউরিষ্টদের জন্য রয়েছে বিলাশ বহুল বড় বড় হোটেল। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা ওখানে অবস্থান করেন। সেখানে রাস্তাঘাট লোক সমাগম কম। স্থানীয় মার্কেটে রয়েছে মোটরবাইক ও সিএনজির মত গাড়ি হ্যায়ারের ব্যবস্থা। আমরা দুইটি গাড়ি হ্যায়ার করে মার্কেটে বেড়াতে যাই। গাড়ির চালক লিবিয়ান মুসলিম। নাম আলী। সে আমাদেরকে বিভিন্ন স্থান গুলো ঘুরে দেখায়। আমরা আব্রান এলাকায় স্থানিয় মসজিদ আল আজওয়া এবং জেকে
অসহাটুন মসজিদ দেখতে যাই। খোলা মাঠের পাশে সুন্দর মসজিদ। আশপাশে তেমন বাড়ি ঘর নেই। মুসল্লি কম। দুরে রয়েছে রকমারী লম্বা দোকানের সারি। দোকানে ও কেনাকাটা কম প্রায় দোকান গুলো ফাঁকা। রাস্তাঘাট খুবই পরিপাটি। টউরিস্টদের থাকা খাওয়ার জন্য হোটেল গুলোতে থাকে আলীশান ব্যবস্থা।
আমাদের হোটেল ছিল ফাইভ স্টার। সকালে দেওয়া হত প্রায় ৪০/৫০ ধরনের নাস্তার আইটেম।সেই সাথে বিভিন্ন ধরনের কফি,চা, ফলের জুসসহ কত কিছু।
দুপুরে লাঞ্চ টাইমে দেয়া হতো হরেক রকমের চিকিন ও মিটকারি, হরেক রকমের সব্জি,মাছ অর্থাৎ এশিয়ান, তার্কিসহ বিভিন্ন দেশের রকমারি খাবারের সম্ভার। সেই সাথে রয়েছে সব ধরনের কেক ও মিষ্টান্ন দ্রব্য এবং সব ধরনের ফল। হোটেলের পাশে রয়েছে বার্গার পিজা,চিপস্, ফিসের দোকান। সবকিছুই ফ্রি। যার যা ইচ্ছা নিচ্ছে খাচ্ছে। মানুষের বিশ্রামের জন্য পরিপাটি করে স্থানে স্থানে রাখা সূফা, আরাম দায়ক চেয়ার টেবিল ইত্যাদি।
তবে একটি জিনিস নজরে পড়ে। আলীশান হোটেল হলেও সেখানে নামাজের সূব্যবস্থা নাই। ভেইসমেন্টের ছোট্ট একটি রুমে ২টি জায়নামাজ রাখা। রুমটা স্যাঁতস্যাতে, অপরিচ্ছন্ন। হোটেল ত্যাগের পূর্বে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করি।
অবশেষে আমাদের বিদায়ের পালা। সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর সময় কেটেছে। আমরা ১১ই জুন রাত ৮টায় লন্ডনের উদ্দেশ্যে তুরস্কের আন্টালিয়া বিমান বন্দর ত্যাগ করি। রাত প্রায় ১টার দিকে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরি। সময় সুযোগ হলে আপনারা পরিবার নিয়ে তুরস্ক বেড়িয়ে আসেন। আশা করি ভালো লাগবে।
লেখক : শিহাবুজ্জামান কামাল, কবি ও কলামিস্ট
লন্ডন :১৩ জুন ২০২৩ ইংরেজি