প্রচ্ছদ

গণমিছিল দ্রোহযাত্রায় উত্তাল দেশ

  |  ২২:৫৩, আগস্ট ০২, ২০২৪
www.adarshabarta.com

প্রাণহানী, সংঘর্ষ, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ার শেল
আদর্শ বার্তা ডেস্ক :

সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো ঝিরিঝিরি, কখনো মুষলধারে। এরমাঝে শুক্রবার। ছুটির এই দিনও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলনে ডাকা গণমিছিলে উত্তাল হয়েছে দেশ। রাজধানী ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, খুলনাসহ প্রতিটি বিভাগেই গণমিছিলে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা অংশ নেন। এই স্বত:স্ফূর্ত গণমিছিলেও বিভিন্ন জায়গায় পুলিশের গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। শিশু, শিক্ষার্থীসহ অসংখ্যজন গুলিবিদ্ধ ও আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
দেশজুড়ে গণমিছিলগুলো লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। সিলেটের আখালিয়ায় পুলিশ হামলা চালালে রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ মিছিলেও গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পুলিশ। একই চিত্র হবিগঞ্জেও। সেখানে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে গুলিতে।
অন্যদিকে, ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার যেন জনসমুদ্রে রূপ নেয়। স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠে। দ্রোহ যাত্রা পরিণত হয় জয়যাত্রায়। যাতে যোগ দিয়েছেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, মানবাধিকার কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীসহ আপামর জনতা। শিক্ষার্থীরা যখন হত্যাকান্ড, নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তখন অভিভাবকরাও দাবি করছেন তাদের সন্তানের নিরাপত্তা।
রাজধানীর উত্তরায় পুলিশ-আওয়ামী লীগ মিলে শিক্ষার্থীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। আওয়ামীলীগ দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। এতে ওই এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।খুলনায় শিক্ষার্থীদের ‘গণমিছিলে’ পুলিশ কাঁদানের গ্যাস শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুঁড়েছে। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সিলেট পুলিশের গুলি, শিশু গুলিবিদ্ধ :
সিলেটে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী আন্দোলনে নামলে টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড দিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করেছে পুলিশ। এসময় শিশু, সাংবাদিক সহ শিক্ষার্থীরা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আটকও হয়েছেন অনেকে।
শুক্রবার বিকেল ৩টা থেকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হন। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, লিডিং ইউনিভার্সিটি, মেট্রোপলিটন, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, এম সি কলেজে, সিলেট সরকারি কলেজ, মদন মোহন কলেজসহ সিলেটের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঁচ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বিক্ষোভে অংশ নেয়।
শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও মিছিলে অংশ নিতে দেখা যায়। মিছিলে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু, গণগ্রেফতার, নির্যাতনের প্রতিবাদে নানা স্লোগান দেন বিক্ষোভকারীরা। এসময় সরকারের প্রতি ক্ষোভ জানাতে দেখা যায় তাদের।
পরে ‘গণমিছিলটি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে সিলেটের মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের সামনে গেলে পুলিশ পেছন থেকে টিয়ারগ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এসময় শিক্ষার্থীরাও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। তাদের অনেকের হাতেই ছিল লাঠিসোঁটা।
রাত পর্যন্ত আখালিয়া, মদিনা মার্কেট ও পাঠানটুলা এলাকায় পুলিশের সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ অব্যাহত ছিল। বিনা উস্কানিতে পুলিশের হামলায় স্থানীয় মানুষজন চরম ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যায়। পুলিশ গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মানুষের বাসা-বাড়িতে প্রবেশ করে। এসময় ঘরে থাকা নারী শিশুদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘সারা দেশের মসজিদে জুমার নামাজ শেষে দোয়া, কবর জিয়ারত, মন্দির, গির্জাসহ সব প্রার্থনালয়ে প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’ শীর্ষক শিক্ষার্থীদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল আজ। এরই অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শাবিপ্রবির প্রধান ফটকে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন। তবে পুলিশের বাধার মুখে তাঁরা সেখানে অবস্থান নিতে পারেননি। এরপর আখালিয়া এলাকার মাউন্ট এডোরা হাসপাতালের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করতে চাইলে পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শটগানের গুলি ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
হবিগঞ্জে গুলিতে শ্রমিক নিহত :
হবিগঞ্জে পুলিশ-বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে একজন নিহত হয়েছেন। শুক্রবার বিকেলে হবিগঞ্জ শহরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম মোস্তাক মিয়া (২৪)। তিনি পেশায় শ্রমিক। এসময় আহত হয়েছেন শতাধিক। এদের মধ্যে অনেকেই গুলিবিদ্ধ বলে জানা গেছে।
মোস্তাকের সঙ্গে কাজ করেন মারুফ হোসেন। তিনি বলেন, মোস্তাক এখানে জুতা কিনতে এসেছিল। এসে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যায়। গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তিনি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) অস্থায়ী কর্মচারী ও সিলেটের টুকেরবাজার এলাকার বাসিন্দা বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খলিলুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু জানি না।
হবিগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মঈন উদ্দীন চৌধুরী বলেন, মোস্তাকের হাতে বড় ধরনের আঘাত ছিল। সেটা গুলি কি না, পরে জানানো যাবে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা গেছেন।
এর আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত ‘প্রার্থনা ও ছাত্র-জনতার গণমিছিল’-এর অংশ হিসেবে জুমআ’র নামাজের পর হবিগঞ্জে শহরের বোর্ড মসজিদের সামনে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, হবিগঞ্জ শহরের বোর্ড মসজিদ এলাকায় শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিলে পূর্ব টাউন হল এলাকায় অবস্থান নেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। একপর্যায়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মিছিলে যোগ দিয়ে সংহতি প্রকাশ করেন জেলা ছাত্রদল ও অন্য দলের নেতা-কর্মীরা।
এরপর মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে টাউন হল এলাকায় শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে সেখানে থাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে আগুন দেন আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া তারা স্থানীয় সংসদ সদস্য আবু জাহিরের বাসায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। এ সময় পুলিশ সেখানে এলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাঁদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালায়। একপর্যায়ে দুই দিক দিয়ে আন্দোলনকারীরা পুলিশের দিকে আসতে থাকেন।
রাজধানীর রাস্তায় হাজার হাজার ছাত্র-জনতা :
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি গণমিছিলে উত্তাল হয়ে উঠেছে রাজধানী ঢাকা। রাজধানীর সাইন্সল্যাব, উত্তরা, আফতাবনগর ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় হাজার হাজার শিক্ষার্থী ও জনতা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। রাজধানী জুড়ে পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশ মিছিলে বাধার চেষ্টা করলেও ছাত্র-জনতার স্রোত আটকানো যায়নি।
বাদ জুমা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের করেন মাদরাসা শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ সময় পুলিশ বেরিকেড দিয়ে মিছিলকারীদের আটকাতে চাইলেও ব্যর্থ হয়। বিক্ষোভকারীরা পল্টন মোড়, প্রেস ক্লাব ও মৎস্য ভবন হয়ে শাহবাগের দিকে যায়। মিছিলের সামনের সারিতে ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের দেখা যায়। এ সময় তারা কোটা আন্দোলনে নিহতদের হত্যার প্রতিবাদে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
জুমার নামাজের পর শিক্ষার্থীরা গণমিছিল বের করেন রাজধানীর সাইন্সল্যাব এলাকায়। মিছিলটি বায়তুল মামুর জামে মসজিদের সামনের রাস্তা থেকে শুরু হয়। পরে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনে হয়ে সায়েন্স ল্যাব মোড়ে যান। সেখানেই তারা অবস্থান নেন।
এদিকে, উত্তরায় বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। শুক্রবার বিকেলে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরে মাইলস্টোন কলেজের সামনে এ ঘটনা ঘটে। কর্মসূচি সামনে রেখে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের জমজম টাওয়ারের সামনে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা মাইলস্টোন কলেজের সামনে অবস্থান নেয়।
বিকেল সোয়া চারটার পর আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা মাইলস্টোন কলেজের দিকে থাকা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেন। শিক্ষার্থীরাও পাল্টা ধাওয়া দেন। এ সময় পুলিশও শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয় এবং সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
এ সময় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশ সদস্যরা জমজম টাওয়ারের সামনের সড়কে অবস্থান নেন। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা সেক্টরের বিভিন্ন সড়কে ছড়িয়ে পড়েন। পরে বিকেল ৫টার পরে আবার শিক্ষার্থীরা প্রধান সড়কে ওঠার চেষ্টা করেন। তখন আবার তাঁদের লক্ষ করে সাউন্ড গ্রেনেড ও কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে পুলিশ। এ সময় শিক্ষার্থীরা আবার ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
এই সময়ে বৃষ্টিতে ভিজে রাজধানীর আফতাবনগরে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, মহাখালিতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ও উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরে রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা গণমিছিল করে।
শিক্ষার্থীরা কোটা আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সংঘাতে হতাহতের ঘটনায় বিচার দাবি করেন। এছাড়া তারা গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’সহ নানা ধরনের স্লোগান দেন। মিছিলের সামনে ও পেছনে পুলিশ ছিল।
সকালে বৃষ্টি উপেক্ষা করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়ে ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন ও হয়রানির প্রতিবাদ জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। একই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নয় দফা দাবির প্রতি সংহতি জানিয়েছেন রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি মেডিকল কলেজের চিকিৎসক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
রাজধানীতে দ্রোহযাত্রায় জন স্রোত :
শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের ডাকা ‘দ্রোহযাত্রায়’ যোগ দিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। যাত্রাটি রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু হয়। পরে সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর ও টিএসসি হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। শুক্রবার বিকেল সন্ধ্যা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দ্রোহযাত্রায় অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন।
পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী দ্রোহযাত্রায় অংশ নিতে বেলা তিনটার আগে থেকেই জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানুষেরা উপস্থিত হতে থাকেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এক পর্যায়ে দ্রোহযাত্রা জনসমুদ্রে রূপ নেয়।
যাত্রার শুরুতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, তাঁদের দাবি এখন একটাই, এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। জনগণের ক্ষমতা জনগণের কাছে আনতে হবে। সরকারের কাছে কোনো কিছু চাওয়ার নেই। তবে অনেক বিচার বকেয়া রয়েছে। ‘জুলাই হত্যাকা-ের’ বিচার করতে হবে। আনু মুহাম্মদ আরও বলেন, এখন প্রধান এজেন্ডা (আলোচ্য বিষয়) বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রূপান্তর কীভাবে হবে।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে দ্রোহযাত্রাটি শুরু হয়। বিকেল সোয়া চারটার দিকে সেটি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পৌঁছায়। দ্রোহযাত্রায় জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সি আর আবরার, আসিফ নজরুল, উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষক মাহা মির্জা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
দ্রোহযাত্রা শেষে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাগীব নাঈম। তিনি বলেন, গণগ্রেপ্তার বন্ধ করতে হবে, গ্রেপ্তার সবাইকে মুক্তি দিতে হবে। রোববারের মধ্যে কারফিউ তুলে নিতে হবে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে। রোববারের মধ্যে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। এসব দাবি পূরণ না হলে রোববার বেলা তিনটায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে গণমিছিল শুরু হবে।
চট্টগ্রামে বাধা উপেক্ষা করে বিক্ষোভ :
চট্টগ্রামে নগরীতে বৃষ্টি উপেক্ষা করে রাস্তায় নেমে মিছিল করেছেন আন্দোলনকারীরা। শুক্রবার জুমার নামাজের পর চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা মোড় থেকে মিছিল শুরু করেন তারা। এদিন চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লা মোড় থেকে জুমার নামাজের পর মিছিল শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের। মিছিলটি নিউমার্কেট মোড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ অবস্থান নেন।
সেখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দেখে ভুয়া ভুয়া স্লোগানসহ সরকার বিরোধী নানা স্লোগান দেন তারা। এরপর মিছিলটি টাইগার পাস মোড়ে কিছুক্ষণ অবস্থান করে ওয়াসা হয়ে জিইসি মোড়ের দিকে যায়। সেখানে ওয়াসা মোড়ে ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মীকে দেখে আন্দোলনকারীরা ধাওয়া দেন। এতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন গলিতে প্রবেশ করেন।আন্দোলনকারীরা ওয়াসা মোড়ের পুলিশের একটি সাঁজোয়া যান লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়তে থাকেন । এ সময় ওয়াসা মোড়েরর একটি ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুর করেন তারা। এর একটু সামনে দামপাড়া পুলিশ লাইনে প্রবেশ মুখে ‘পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের’ নামফলক ভাংচুর করেন আন্দোলনকারীরা। এরপর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে বহদ্দারহাটের দিকে চলে যান। যাওয়ার পথে মুরাদপুর এলাকায় একটি ট্রাফিক বক্সে ভাংচুর করেন। পরে বহদ্দারহাটে গিয়ে কর্মসূচি শেষ হয়।
এদিকে, এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা ছিলো। তবে পুলিশ মিছিলে কোনো বাঁধা দেয়নি। চট্টগ্রাম মেট্রাপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মাসুদ আহমেদ বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে যাওয়ার পথে বিনা কারণে ওয়াসা ও মুরাদপুরের ট্রাফিক পুলিশ বক্স ভাঙচুর করেছেন।
খুলনায় সংঘর্ষ :
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ছাত্র-জনতার গণমিছিল কর্মসূচিতে খুলনায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে পুলিশ। শুক্রবার জুমার নামাজের পর খুলনা নগরে এ ঘটে। এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সংঘর্ষে সুমন নামে এক পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। তিনি পুলিশ লাইন্সে কর্মরত ছিলেন।
বেলা আড়াইটার দিকে মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা শিববাড়ী থেকে সোনাডাঙ্গা থানা মোড় হয়ে গল্লামারী আসেন। পরে বিকেল চারটার দিকে শিক্ষার্থীদের একটি দল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে অবস্থান করে। আরেকটি দল জিরো পয়েন্টের দিকে যেতে চাইলে পুলিশ মিছিল লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল ছোড়ার ঘটনা ঘটেছে। মিছিলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দাদেরও দেখা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে সোনাডাঙ্গা থানার সামনে এসে স্লোগান দিতে থাকেন। একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা থানার মধ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন। তবে পুলিশ এ সময় থানার ফটক বন্ধ করে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
সোনাডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ওয়াহিদুজ্জান বলেন, শিক্ষার্থীরা কিছু ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেছিলেন। তবে কেউ আহত হননি। এদিকে বিকেল চারটার দিকে জিরো পয়েন্টের দিক থেকে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে চাইলেও শিক্ষার্থীদের সরানো যায়নি। তাঁরা পুলিশের উদ্দেশে ‘ভুয়া’ ‘ভুয়া’ ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। এ সময় পুলিশ সাঁজোয়া যান নিয়ে শিক্ষার্থীদের সামনে এগোতে বাধা দেয়। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়। পুলিশ পিছিয়ে যায়, শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে গল্লামারী ব্রিজের দিকে এগিয়ে যান। বিকেল পাঁচটায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত বৃষ্টির মধ্যে শিক্ষার্থীরা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান নিতে থাকেন।
বরিশালে বৃষ্টির মধ্যেও শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ :
বরিশালে বৃহস্পতিবার থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি চলছে। শুক্রবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তা চলে একটানা। এরপর বৃষ্টি থেমে গেলেও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। এতে নগরের অনেক সড়কে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। এমন বৈরী
আবহাওয়া উপেক্ষা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা গণমিছিল কর্মসূচি পালন করেছেন বরিশালের ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে অংশ নেন হাজারো শিক্ষার্থী।
কর্মসূচির অংশ হিসেবে শুক্রবার জুমার নামাজের পর বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভের জন্য সমবেত হন। পরে তাঁরা নগরের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় যান এবং সেখানে সমাবেশ করেন। সমাবেশে তাঁরা ছাত্রহত্যার বিচার, গ্রেপ্তার করা ছাত্রদের মুক্তি ও হয়রানি বন্ধসহ ৯ দফা দাবি বাস্তবায়নের দাবি জানান। শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচি চলাকালে নগরের বিভিন্ন স্থানে পুলিশকে সতর্ক থাকতে দেখা যায়। তবে কর্মসূচি ঘিরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি।
রংপুরে বৃষ্টিতে ভিজে বিক্ষোভ :
রংপুরে বৃষ্টিতে ভিজে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও বিক্ষোভ সমাবেশ ও পদযাত্রা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এই কর্মসূচি শুরু হয়। পরে বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর ফটকের সামনে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে বক্তৃতা দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মতিউর রহমান, বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তুহিন ওয়াদুদ, বাংলা বিভাগের শিক্ষক সিরাজাম মুনিরা, মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাসুদ হাসান, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র অন্দোলনের সংগঠক জান্নাত সৃষ্টি, আশিকুর রহমান প্রমুখ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক রাফিউল আজম খান, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আলী রায়হানসহ আরও কয়েকজন শিক্ষক।
সমাবেশে শিক্ষকেরা বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে আবু সাঈদসহ সব হত্যাকা-ের বিচার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। বিনা অপরাধে সাধারণ শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার অভিযান বন্ধ করতে হবে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতিও সংহতি প্রকাশ করেন তাঁরা।
লক্ষ্মীপুরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সংঘর্ষ :
লক্ষ্মীপুরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়েছে। আজ শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে বেলা আড়াইটার দিকে শহরের উত্তর তেমহনী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। এ সময় এক যুবককে অস্ত্র হাতে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করতে দেখা গেছে। দুই পক্ষের সংঘর্ষের এ ঘটনায় অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শহরে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।
প্রকাশ্যেই অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করা ব্যক্তির নাম মো. সুমন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তিনি সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাউদ্দিন ওরফে টিপুর গাড়িচালক। টিপু লক্ষ্মীপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র এম এ তাহেরের ছেলে।
জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান এ কে এম সালাউদ্দিন বলেন, ‘অস্ত্রটি আমার লাইসেন্স করা। সংঘর্ষের পর গাড়িচালককে দিয়ে অস্ত্রটি বাসা পাঠিয়েছি। এ সময় কেউ একজন ছবিটি তুলেছেন। সংঘর্ষের জন্য অস্ত্রটি ব্যবহারের অভিযোগ সঠিক নয়। কিন্তু সংঘর্ষের পর একটি ভিডিওতে দেখা যায়, অস্ত্র হাতে সুমন নামের ওই যুবক শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করছেন।
কুমিল্লায় গণমিছিল :
কুমিল্লায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে দোয়া ও গণমিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর নগরীর ঝাউতলা ছাতা মসজিদ থেকে গণমিছিলটি শুরু হয়। পরে তা পুলিশ লাইনস রেসকোর্স হয়ে নগরীর শাসনগাছা এলাকা হয়ে আবার রেসকোর্স এলাকায় আসে। মিছিলে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দেন, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘আবু সাইদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না’, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’।
মিছিল-স্লোগানে উত্তাল বগুড়া :
বগুড়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা পদযাত্রা, গণমিছিল ও সমাবেশ করছেন। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বৃষ্টির মধ্যে শহরের রাস্তায় রাস্তায় শিক্ষার্থীদের ঢল নামে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন অভিভাবকসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।
বেলা দুইটা থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলে-স্লোগানে কার্যত উত্তাল বগুড়া শহর। শিক্ষার্থীদের কর্মসূচি ঘিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে আছেন। তবে কোথাও বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেনি। শিক্ষার্থীরা সাতমাথায় অবস্থান নেওয়া সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা জানান, বেলা দুইটার দিকে শহরের স্টেশন সড়কের বায়তুর রহমান জামে মসজিদ থেকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কিছু মুসল্লি গণমিছিল বের করেন। মিছিলটি সাতমাথায় এসে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে জলেশ্বরীতলা শহীদ আবদুল জব্বার সড়ক থেকে শিক্ষার্থীদের আরেকটি মিছিল কালিবাড়ী মোড় হয়ে সাতমাথায় এসে অবস্থান নেয়। শিক্ষার্থীদের আরেকটি অংশ জুমার নামাজের পরপরই শহরের করনেশন ইনস্টিটিউশনের সামনে অবস্থান নেয়। সাতমাথা থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বড়গোলা হয়ে করনেশন ইনস্টিটিউশনের সামনে গেলে দুটি অংশ একত্র হয়ে আবার সাতমাথায় ফিরে আসে।