তালনিরাকের কবি মোস্তফা মঈন এবং কবিতার পরিপার্শ্ব
সাইফুর রহমান কায়েস
এ শহরে আর নেশা হয় না।
ইট পাথরের ঘষা খেতে খেতে
এ শহরে তোমার উপচে পড়া হাসিও এখন পাথর হয়ে যাচ্ছে। হৃদয় বলে যা কিছু ছিল-
দিগন্ত ব্যাপি তোমার দৃষ্টি গুম হয়ে যাচ্ছে প্রতিরাত।
তাই সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে নদী ধান ও পাখিদের উদ্দেশে উড়ন্ত চুমু।
আমি এ শহর ছাড়বই।
সাঁইডুলি নদীর ধারে গাঢ় লাল হয়ে ফোটে থাকা অশোক বৃক্ষের তলায় তোমাকে নিয়ে মাটির পাঁচিলে ঘেরা একটা ঘর বাঁধবই।
জ্যৈষ্ঠের আম কুড়ানির সুখ তুমি জানো?
উঠোনের কাঁঠালগাছতলায় বসে তালপাখা আর ভর দুপুরে হাঁড়ি ভরা মাঠা
আ! কী মজা!
পাটশাক আর টেপি চালের গরম ভাতে ননী তোলা কাঁচা ঘি।
আমার মন কোথায় যেন পড়ে থাকে।
বাড়ির দেউড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট বোন
অপরাজিতার ডাগর মেলা নীল চোখ।
সেই আমাদের পুকুরপাড়, তালগাছ, চালকুমড়োর মাচা, বাঁশের বেড়া, সাদা বকের গ্রীবাভঙ্গি, সবুজ ঘাস, ঝিঙেফুল, করমচা, ঘন হয়ে জমে থাকা থানকুনিপাতা, ফড়িঙ আর প্রজাপতিদের উড়াল…
বকুলগাছ তলায় ঝরে পড়া বকুলফুল। সার সার সুপারি গাছ-
ভরা বর্ষায় নদীর ঘাটে সাবান মাখা শরীর !
আ! চিত হয়ে সাঁতার কাটা মগড়া নদী…
তার তলপেটে ছড়াত ছড়াত বৈঠার ঘা- পালতোলা নৌকা আষাঢ় মাস নতুন বউ নাইওরি নেত্রকোণা।
গনেশ হাওরের শিঙড়া বিল কাঁপিয়ে বনঝোপে কোড়া পাখি ডাকছে ঠোভ ঠোভ ঠোভ…
এ শহরে আর নেশা হয় না।
তবু পেশার জন্য পড়ে থাকি ঘিঞ্জি গলির তেতলা বাড়িতে। উদ্দেশ্য তোমাকে নিয়ে জলবত তরলং বেঁচে থাকাই নয়, পেশা আর নেশাও এককথা নয়।
আমাদের বিলঝিল নদীনালা গাছে গাছে পাখিদের উড়াউড়ি ডাকাডাকি
আর অঘ্রানের আধাপাকা ধানখেতের আলে আলে কার্তিকশাইল রতিশাইল ও কালাজিরা ধানের ঘ্রাণে
যে নেশা হয় তা তুমি জানোই না! আমি এ শহর ছাড়বই।
পৌষের পুলি আর কলসি ভরা খেজুরের রস তুমি জানো? মাঘের হিমতোলা বাতাস
আর পাহাড়ের কোমর বেয়ে যখন কুয়াশা নামে কাঁথামুড়ি দিয়ে হাঁটে শীতের সন্ন্যাস
পাতায় পাতায় শিশিরে তখন সূর্যের হাসি!
তুমি তো জানোই না বসন্তবাউরি!
আর কি যে পরান কাড়া কোকিলের ডাকাডাকি কুউউ কুউউ কুউউ…
আমাদের বসন্ত উৎসব – উদলা গায়ে উঠোন জুড়ে হলুদ রং এর ছড়াছড়ি-
পরবে নাকি বাসন্তি রং শাড়ি? খোঁপায় গুঞ্জা ফুল? চলো নেচে গেয়ে পরস্পর গাঁটছড়া বাঁধি।
কামিনীগাছের তলায় শরতের জোনাকি ফোটা চাঁদনি সন্ধ্যা তুমি দেখবে?
আকাশে পরিব্রাজক মেঘের টুঙিঘর?
ভ্রমণের থেকে দৃশ্যমান কোনো কবিতাও আমি দেখিনি। চলো বেরিয়ে পড়ি…
আমি সেই ইট পাথরের সাংঘর্ষিক শহরে আর যাব না।
ভোরবেলা শেফালি গাছের তলায় গিয়ে ঝরে পড়া শিউলি ফুল তুমি তুলবে?
শিশির ছোঁয়া শিউলির মন কাড়া ঘ্রাণের আনন্দই আলাদা।
এসো-
নৌকার পাটাতনে শোয়ে ভাগাভাগি করে নিই কাঁচুলি খোলা শিউলির ঘ্রাণ!
এই ছইতোলা নৌকাটায় বসে শেঁওলাইত বিলের এক আঁজলা টলোমলো জল তুমি ধরো।
দেখো বালিহাঁসগুলো, আর এই অফুরন্ত জলধোয়া বিশুদ্ধ বাতাস
শাপলা শালুক আর থোকা থোকা কচুরি ফোটা বিল পানকৌড়ি নদী কিচকিচ আর গাংচিল
কী দারুণ! জলপারাবতেরা!
বর্ষায় ঝিঁউইড়া বিলে ঘাই মারা মাছের নেশা তুমি জানো?
আমি কোঁচ হাতে বেরিয়ে পড়েছি- এই যে ঘাটে বাঁধা ডিঙি নৌকাটা-
ভাদ্রের ভরা রোদের পর কী তাল নিরাক পড়েছে!
গণেশ হাওরের বড়বিলে শেঁওলাধরা ঘাসে খাজা খাওয়া মাছেরা…
শুধু তুমি পিঁড়িতে বসে পাটায় পিষে মসলাটা রাখ। এই আমি রুই মাছটা ধরে আনলাম।
গভীর এবং নিবিড় আবেগ মেশানো একটি দীর্ঘ কবিতা।এই কবিতা বলে দিচ্ছে আগামী দিনে বাংলা কবিতা আরো শক্ত অবস্থানে যাবে মঈন ভাইয়ের হাত ধরে।কবিতায় গ্রামীণ এবং লোকজ উপাদানগুলিকে তুলে এনে কবিতাকে মানবিক অবয়ব দান করেছেন।এই কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য কবিকৃতি।বিশ্বদর্শনের এক সমণ্বিত রূপ আমরা দেখি এর মাঝে যখন কবি বলেন-কামিনীগাছের তলায় শরতের জোনাকি ফোটা চাঁদনি সন্ধ্যা তুমি দেখবে?
আকাশে পরিব্রাজক মেঘের টুঙিঘর?
ভ্রমণের থেকে দৃশ্যমান কোনো কবিতাও আমি দেখিনি। চলো বেরিয়ে পড়ি…
আমি সেই ইট পাথরের সাংঘর্ষিক শহরে আর যাব না।
ভোরবেলা শেফালি গাছের তলায় গিয়ে ঝরে পড়া শিউলি ফুল তুমি তুলবে?
শিশির ছোঁয়া শিউলির মন কাড়া ঘ্রাণের আনন্দই আলাদা।
এসো-
নৌকার পাটাতনে শোয়ে ভাগাভাগি করে নিই কাঁচুলি খোলা শিউলির ঘ্রাণ!
এই ছইতোলা নৌকাটায় বসে শেঁওলাইত বিলের এক আঁজলা টলোমলো জল তুমি ধরো।
দেখো বালিহাঁসগুলো, আর এই অফুরন্ত জলধোয়া বিশুদ্ধ বাতাস
শাপলা শালুক আর থোকা থোকা কচুরি ফোটা বিল পানকৌড়ি নদী কিচকিচ আর গাংচিল
কী দারুণ! জলপারাবতেরা!
তালনিরাক একটি ভালো মানের কবিতা। এরপরে যদি তিনি কবিতা নাও লিখেন তবুও তাকে কবি বলে মানতে কোনো আপত্তি থাকবে না। অনায়াসে কবিতার ভূবনে রাজত্ব করে যেতে পারেন মঈন ভাই। অতো কষ্ট করে রোদ আর কচলে মাটি করার কি দরকার? কবিতায় বিল বাদাল উঠে এসেছে, জীবন, জীবনধারা এবং কবির সুগভীর জীবনবেদের ও বোধের সহ্নিবেশন ঘটেছে তালনিরাকের প্রতিছত্রে। এই তো আমাদের কবি মোস্তফা মঈন ভাই।
ভাটিবাংল তথা আবহমানকালের বাংলার ব্রত-কৃত্য-আচার এখানে উঠে এসেছে। হাওরের জলে ভেসে উঠে মায়ের মুখ। আঁজলা ভরে উঠে আসে ডানকিনে বা দ্বারিকা মাছ। এই সুখচ্ছবি কবির অন্তর্নিবিষ্ট দৃষ্টিতে উঠে আসে একজন সুনিপুণ শিল্পীর মোহনীয় ভঙ্গিমায়। কবির সমগ্র যাপিত জীবন এক অসমাপ্ত গানের বেদনা হয়ে ধরা দিলেও সেখানে আত্মতৃপ্তি আছে, আত্মাবগাহন আছে, স্তুতি আছে কিন্তু স্তাবকতা নেই। কবির হাড়ের পিয়ানো থেকে শুরু করে রোদকচলে মাটি কাব্যগ্রন্থ পর্যন্ত কবির পরিভ্রমণ আমাদেরকে কবিতায় মজে থাকার আনন্দকে উদ্ভাসিত করে তোলে। সাতটি কাব্যগ্রন্থের প্রত্যেকটিতেই কবি তার বঞ্চনার কথা, মায়ের কথা, দেশের কথা,ব্যক্তিগত জীবনের দ্বন্ধ ও অন্তর্দ্বন্ধের কথা খুব সাহসিকতার সাথে উচ্চারণ করেছেন। যাপিত সাত্ত্বিক জীবনকে ছেনি দিয়ে, বাটালি দিয়ে কারুশিল্পীর মতো দুঃখিনী বর্ণমালায় সাজিয়েছেন। যে কারণে একজন কবির জীবন আমাদের কাছে আরাধ্যমান হয়ে উঠে। তার কবিতা হয়ে উঠে সমকালের সারণি। কোনো দুর্বোধ্যতা পাঠককে তখন আর গ্রাস করে না। কবি তখন হয়ে উঠেন পাঠকান্তপ্রাণ, একটি সেতুবন্ধন রচনাকারী। চরম বিপদের দিনে তিনি বাঘিনীর দুধ পান করতেও তোয়াক্কা করেন না। কিন্তু ধূর্ত শেয়াল তার জীবনকে বেফানা করে তোলে। কবির কবিতার বিষয় নির্বাচন ও শব্দচয়নের কৃৎকৌশলগুলি পাঠকের দৃষ্টি এড়ায় না কখনো। সুখপাঠ্য অনুভূতির পুলকে পাঠককূল মথিত এবং অত্যাবশ্যকীয়ভাবে রোমন্থিত হন।
বন্ধুবৎসল কবি আমাদের মাঝে সকল জরা ও জড়তাকে উষ্টা মেরে ফেলতেও পিছপা হন না। যা কিছু সত্য তাই ধারণ করেন। যা কিছু মিথ্যা তাই বর্জনের নেশা কবিকে মোহমুক্তি দান করেছে। সীমিত আয়ূর ভেতরে কবি অসম্ভবকে সম্ভব করার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে উঠেন। আনাদেরও অনুপ্রেরণা দিয়ে যাচ্ছেন। জয়তু কবি মোস্তফা মঈন।
কালের অগ্রযাত্রার জয়ধ্বজা উঁচিয়ে রাখুন, উজিয়ে যান স্রোতের বিপ্রতীপে।
লেখক :
সাইফুর রহমান কায়েস
কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক।