জীবনের কথা, পর্ব-৩
তিন জেনারেলের সাথে ঘনিষ্ঠতার সূযোগ সৃস্টি হয়
:: মোঃ রহমত আলী ::
মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা কখনও ভুলা যায়না। কারণ সেসব স্মৃতি হৃদয়কে দোলা দেয় বা আন্দোলিত করে এবং বারবার তা ভেসে উঠে স্মৃতির পর্দায়। আমার জীবনের এমনই কিছু স্মরনীয় ঘটনা রয়েছে যেগুলি আমার মনে বিভিন্ন সময় ভেসে উঠে। কারণ আমি একজন সাধারণ ব্যক্তি হয়েও এমন অনেক ব্যক্তির সংস্পর্শে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম যা ছিল আমার জন্য কল্পনাতীত। তার কিছুটা উল্লেখ করছি এখানে। অবশ্য যাদের কথা এখানে উল্লেখ করছি তাঁদের নিয়ে অনেকের ভিন্নমত থাকতে পারে। কিন্তু আমার নিকট সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়, আমি তাদের সংস্পর্শে আসাটাকেই মূল বিষয় হিসাবে মনে করছি।
বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল মোহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর সাথে আমার পরিচয় ও ঘনিষ্টতা তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় জনতা পার্টির মাধ্যমে। আমি তখন কলেজে অধ্যয়ন করছি আর সে অধ্যয়নকালেই আমি এ জনতা পার্টির ছাত্র সংগঠন ‘জাতীয় ছাত্রফ্রন্ট’-এর সিলেট জেলা শাখার যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব লাভ করি। এ সুবাদে তাঁর সাথে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে যেতে হতো, অন্যদিকে সিলেটের বিভিন্ন কলেজে সংগঠনের সমাবেশে যোগদান করতে হতো। সাংগঠনিক কার্যক্রমে খুবই উদ্যমী ভূমিকা পালন করায় বঙ্গবীরের ঘনিষ্ট সাহচর্য পেতে সময় লাগেনি। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখতেন এবং তথাকথিত ছাত্ররাজনীতির যে নোংরা পরিমন্ডল তার বাইরে থেকে কাজ করার পরামর্শ দিতেন।
ওসমানী সাহেব সিলেটে অবস্থানকালীন অবসর মুহুর্তে সিলেটে তার নাইওরপুলের বাসায় (বর্তমানে ওসমানী যাদুঘর) আমরা যেতাম। তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা ও পরবর্তীতে ‘৭৫এর পট পরিবর্তনসহ নানা ঘটনা বর্ণনা করতেন। তিনি সব সময় বলতেন জীবনে ক্ষমতায় যাওয়ার অনেক সুযোগ ছিল কিন্তুু তিনি কখনও পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন না।
সেনাবাহিনীর লোক হলেও ওসমানী ছিলেন একজন খাটি গণতান্ত্রি দেশপ্রেমিক। তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ন ও অতিথি বৎসল। কেউ তার বাসায় গেলে সম্ভব হলে নিজের হাতে চা বানিয়ে দিতেন ও বিদায় নেয়ার সময় নিজে দরজায় এসে দাঁড়াতেন। জেনারেল ওসমানীর নাইওরপুলের বাসার কাছাকাছি তখন পলাশ নামে একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। দলীয় কার্যক্রম চালানোর সুবাদে প্রায় সময় নেতা-কর্মীরা সেখান থেকে ফ্লাক্সে করে চা নিয়ে আসতেন। তবে একদিন ওসমানী সাহেব বললেন যে, তিনি সবাইকে চা পানে আপ্যায়িত করবেন। এ কথা শুনে আমাদের মধ্যে চা পানের আগ্রহটা বেড়ে যায়। তবে চা নিয়ে আসতে কিছুটা সময় লাগার কারণে লোকজন ছিল ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তাই বারবার চা আনতে হয়েছিল। এভাবে বিকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চায়ের পালা চলে। এতে তার কয়েকশত টাকা চলে যায়। পরে তিনি অবশ্য এক ফাঁকে বলেছিলেন যে, তাঁর পকেটে সে সময় আর টাকা নেই। তাই মন চাইলেও সবাইকে শেষ পর্যন্ত আর চা পানে আপ্যায়ন করাতে পারেন নাই।
অনেকেই কৌতুহলী ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর আতাউল গণি ওসমানী কেনো বিয়ে করেননি। কিন্তু ওসমানীকে এ প্রশ্নটি করার মত সাহস হয়ে ওঠেনি কারো। আমি তখন যে কলেজে পড়তাম সে কলেজের কয়েকজন সহপাঠি ছাত্র ফ্রন্টের সাথে যুক্ত হতে আগ্রহী হলে তাদেরকে নিয়ে আমি গেলাম নাইওর পুলস্থ সে বাসভবনে। সাক্ষাৎ পর্বের এক পর্যায়ে আমার এক সহপাঠি ওসমানী সাহেবকে প্রশ্ন করে বসলো: ‘স্যার, যদি বেয়াদবী না নেন, তাহলে একটা প্রশ্ন করবো। আর প্রশ্নটা হলো, আপনি কেনো বিয়ে করেননি? প্রশ্ন শুনেই ওসমানীর বিগড়ে যাওয়া মেজাজ তাঁর অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠতে থাকলে সহপাঠি বেচারা আমতা আমতা করে ফের বললো: ‘স্যার, আমরা তো আপনার পার্টি করবো। কিন্তু পার্টির কাজ করতে গেলে নিশ্চিত যে, অনেকেই এ প্রশ্নটি আমাদের করবে। তখন কি জবাব দেবো মনে করেই প্রশ্নটা করলাম। আমার তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি’ অবস্থা। কারণ আমি এখানে তাদের নিয়ে গিয়েছি। তাই তারা চলে যাবার পর আমাকে এ জন্য খেসারত দিতে হবে। কিন্তু ওসমানী সাহেব তখন কিছুটা ভাবগম্ভির সুরে আমার সহপাঠিকে জিজ্ঞেস করলেন ‘তোমার নাম কি? তুমি কোন কলেজে পড়ছো? এরপর বললেন, রাজনীতি করতে এসেছো, সুতরাং রাজনীতির প্রশ্ন করো-ব্যক্তিগত প্রশ্ন কেন করবে? আমি তখন সে মুহুর্তে হাফ ছেড়ে বাঁচলেও কয়েকদিন তাঁর সামনে যাইনি।
এবার অন্য একটি ঘটনা। সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার একটি গ্রামে আমারই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন জেনারেল ওসমানী। ওসমানীর মেজাজ-মর্জির কথা জানেন না এমন এক ব্যক্তি বিয়ে বাড়িতেই হঠাৎ সেই প্রশ্ন করে বসেন- স্যার, এখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন? ওসমানী খটমট করে লোকটার দিতে তাকিয়ে বললেন,‘বিয়েতে এসেছি, রাজনীতি করতে নয়। ভাগ্যিস সে লোকটা যদি অন্য কোন প্রশ্ন করে বসতো তা হলে অবস্থা কী দাঁড়াতো!
জেনারেল এরশাদ
১৯৮০ এর দশকে যখন বাংলাদেশে ছিলাম তখন একরাত্রে একটি স্বপ্ন দেখে এর বাস্তবতা নিয়ে খুবই দ্বিধাদ্বন্ধে ছিলাম। আমার কাছে তখন এ স্বপ্নটি খুবই বিস্ময়কর মনে হয়েছিল। সে যাই হউক, সে সময় বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল হুসেইন মোঃ এরশাদ। আর আমি ছিলাম স্থানীয় হাইস্কুলের একজন শিক্ষক। কিন্তু স্বপ্নে দেখি যে, আমার বাড়ীর পার্শ্বে প্রেসিডেন্ট এরশাদ হেলিকপ্টার যোগে অবতরণ করছেন আর আমি তাকে রিসিভ করছি। তবে স্বপ্নটি দেখার পর এ ধরণের কোন আশাই করিনি যে, তার সাথে কোদিন আমার সাক্ষাৎ হবে। কিন্তুুু দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর পর লন্ডনে তার সাথে প্রথম সাক্ষাতের মাধ্যমে আমার এ স্বপ্নটি পূর্ণ হয়। যদিও তিনি তখন সাবেক প্রেসিডেন্ট। আমি তখন লন্ডনের সাপ্তাহিক সুরমা পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম। তাই আমার ইচ্ছা হলো তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নেয়ার। আমি তখন যুক্তরাজ্য জাতীয় পার্টির তৎকালীন সভাপতি মোঃ মুজিবুর রহমানের সহযোগিতায় সেন্ট্রাল লন্ডনের হিলটন হোটেলে পৌছি। সেখানে আমি একটি সাক্ষাৎকার নেই এবং এরপর থেকেই তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায়। এরপর যতবারই তিনি লন্ডন এসেছেন ততবারই তিনি আমার খোঁজ করেছেন। এক সময় এখান থেকে একটি পত্রিকা বের করার ব্যাপারেও তিনি ধারণাপোষন করেছিলেন। আর এ ধারণা থেকে আমার উপর দায়িত্ব পড়েছিল এ পত্রিকা প্রকাশের। আমাকে সম্পাদক ও যুক্তরাজ্য জাতীয় পার্টির এক নেতাকে প্রধান সম্পাদক করে এ পত্রিকাটি প্রকাশের একটি চুক্তিপত্রও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আমার শারিরীক কারণে সেদিকে অগ্রসর হইনি। তাই যুক্তরাজ্য জাতীয় পার্টির নেতা যিনি বর্তমানে জাপার কেন্দ্রীয় নেতা তার সম্পাদনায় সে পত্রিকাট বের হয়।
জেনারেল মইন ইউ আহমদ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমদ। সরাসরি ক্ষমতা দখল না করলেও তার মাধ্যমেই প্রায় দু’বছর দেশের শাসনকার্য পরিচালিত হয়েছে । বিশেষ করে ফখর উদ্দিন সাহেবের তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে।
জেনারেল মইন ইউ আহমদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি পায় তার শশুরবাড়ীর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, তার শ্বশুড় বাড়ী ছিল বৃহত্তর সিলেটের মৌলভীবাজারের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। সে সূত্র ধরে বিভিন্ন বিষয়ে আমি তার সাথে যোগাযোগের সুযোগ পাই। আর এ যোগাযোগের সূত্র ধরে আমার কাছে তার ব্যক্তিগত ই-মেইল হস্তগত হয়। তিনি অবশ্য এটি তাঁর সেই আত্মীয়ের মাধ্যমে আমার নিকট প্রেরন করেছিলেন। তাই অনেক সময় স্ব-প্রণোদিত হয়ে আমি স্থানীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও কমিউনিটি বিভিন্ন বিষয়ে তাকে অবহিত করতাম।
এক সময় যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশে গিয়ে ব্যারিষ্টার রেজওয়ান হোসেন ঢাকা এয়ারপোর্টে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। এ বিষয়ে দেশে-বিদেশে এর প্রতিবাদে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এর প্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার রেজওয়ান যুক্তরাজ্যে ফিরে এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে তার উপর নির্যাতনের ছবিসহ ঘটনার বর্ণনা উপস্থাপন করেন। আমি তার এ বর্ণনাটি ছবিসহ সরাসরি জেনারেল মইন ইউ আহমদের ই-মেইলে পাঠিয়ে দেই। যার ফলে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি সার্বিকভাবে অবহিত হতে পারেন। তাই কমিউনিটি সংগঠন সমুহের আন্দোলন এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবি ও হিউম্যান রাইটস এন্ড পীস ফর বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় প্রেসিডেন্ট এডভোকেট মনজিল মোরসেদ এ ব্যাপারে হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের এর কারণে বিষয়টি গুরুত্ব পায়। অবশেষে সামরিক কোর্ট মার্শাল অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে কয়েকজনের সাজা হয়। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক।