জীবনের কথা, পর্ব-২৯
লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ফেরদৌসের সাথে সাক্ষাৎ এবং তারপর
:: মোঃ রহমত আলী ::
চিত্রনায়ক ফেরদৌস বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় অভিনেতা। এর পাশাপাশি তিনি মডেলিং, টিভি উপস্থাপনা ও টিভি নাটকেও অভিনয় করে থাকেন। এজন্য তাঁর ভক্ত শ্রোতার সংখ্যা অনেক। আর এ ভক্ত অনুরাগীর সংখ্যা শুধু দেশে নয় বিদেশে পর্যন্ত তা বিস্তৃত। সে হিসেবে তিনি পৃথিবীর যেখানেই যান, তাঁর নাম শুনলে এক নজর দেখার জন্য ভক্ত-অনুরাগীরা ছুটে আসেন। আমি নিজেও তাঁর একজন ভক্ত। সে হিসাবে দেশে তাঁর সাথে দেখা হওয়ার কোন সূযোগ না হলেও একদিন লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে আকস্মিকভাবে দেখা হওয়ার সূযোগ হয়ে যায়। আর সেটা হয়েছে প্রায় সাড়ে আট মাস আগে। এরই মধ্যে কয়েকবার তাঁর সাথে ফোনে যোগাযোগও হয়েছে। আর সে স্মৃতি নিয়েই আজকের লেখা।
২০১৯ সালের ১৫ অক্টোবর দুপুরে আমি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে গিয়েছিলাম একটি বিশেষ কাজে। আমার অফিস থেকে ট্রেনে সেখানে যেতে আধা ঘন্টা সময় লাগে। এরপর অন্তত ১০ মিনিট পায়ে হেঁটে যেতে হয়।
আমি সেদিন ট্রেন থেকে নামার পর হাঁটতে শুরু করি। হাইকমিশনের একেবারে কাছাকাছি যাওয়ার পর দেখলাম অন্যান্য মিশ্রবর্ণের লোকদের সাথে দু’জন বাঙালি লোক সামনের দিকে হেঁটে চলেছেন। আমি মনে করলাম তারাও হয়তো হাইকমিশনে কোন কাজে যাচ্ছেন। তবে যেহেতু আমার তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে তাই আমি একটু দ্রুত হেঁটে তাদের পাশ কাঠিয়ে রাস্তা অতিক্রম করি। এরপর হাইকমিশনের সামনের দরজার কাছাকাছি গিয়ে কলিং বেল টিপলাম। আমার নাম পরিচয় জানার পর দায়িত্বরত লোকজন দরজা খুলে দিলেন। আমি ঠিক ভিতরে ঢুকতে যাবো এ সময় সে দু’জন লোকও আমার কাছাকাছি চলে আসেন। তাই দরজা খোলা হওয়ায় তাঁরা আর কলিং বেল টিপ দেয়ার প্রয়োজন না পড়ায় আমরা তিনজন একত্রে ভেতরে ডুকলাম।
সেখানে পৌঁছার পর দায়িত্বরত সিকিউরিটির একজন লোক একটু হন্ত-দন্ত হয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, আপনারা কি সবাই একত্রে এসেছেন? আমি তখন স্বভাবতই না সূচক উত্তর দিলাম। এরপর আমি ও তারা একত্রে রিসিপশনে বসতে যাচ্ছি, তখন দেখলাম উপস্থিত সবাই আমার সাথে থাকা দু’জনের মধ্যে একজনকে সালাম করার সাথে সাথে হাত মেলানোর চেষ্ঠা করছে। আমি তখনই চিনতে পারলাম যে, তিনি তো চিত্রনায়ক ফেরদৌস। আমি তখন অন্যান্যদের মত হাত মেলাতে কিছুটা ইতস্ততঃবোধ করছিলাম। কারণ এতক্ষন একসাথে আসলাম আর তখনও আমি খেয়াল করলাম না যে, তিনিই সে চিত্র নায়ক- যিনি এ যাবৎকালে বাংলাদেশের জনপ্রিয় শিল্পিদের অন্যতম একজন। তা ছাড়া যখন আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো ‘তারা আমার সাথের কিনা’ তখনও আমি না সূচক উত্তর দিলাম। সুতরাং একটা অস্বস্থিকর অবস্থায় পড়ে যাই। আর না হয় যদি তখন আমি একটু খেয়াল করতাম আর বলে নিতাম যে, তারাও আমার সঙ্গি। তখন উপস্থিত লোকজনের কাছেও আমি আলাদা একটা মর্যদার অধিকারী হতাম- এ কারণে যে, তারা মনে করতো চিত্র নায়ক ফেরদৌস আমার ঘনিষ্ট বন্ধু। এ সূযোগটা আমি নিজেই খেয়াল না হওয়ার কারণে হারিয়েছি বলে মনে হলো।
সে যাই হোক, এরপর তাঁর সাথে আমি হাত মিলাই ও ছবি তুলি। এ সময় যদিও আমার মনের মধ্যে একটা সংকোচ ছিল তবুও তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে আমার সাথে কথা বলেছেন। না হয় অন্য কেউ হলেতো মুখে কথা বল্্লেও অন্তরে অন্তরে থাকতো যে, বেটা- তুমিতো তখন অবজ্ঞাসূচক ভাব দেখিয়েছো। আমরা তোমার সাথে আসলেও তুমি না দেখার ভান করেছো। তারপরও এখন কথা বলছো।
যাই হউক, এরপর আমরা একসাথে হাইকমিশনার এর রুমের পাশের কামরায় কিছু সময় বসলাম। এসময় ফেরদৌস ভাই’র লন্ডন আসার উদ্দেশ্য নিয়ে আলাপ হলো। তিনি জানালেন, বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে যুক্তরাজ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানের জন্য একটি শর্ট ফিল্ম করার ব্যাপারে মাননীয় হাই কমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম এর আমন্ত্রণে তিনি এখানে এসেছেন।
আমি তখন তার কাছে এর আগে কতবার যুক্তরাজ্য সফর করেছেন তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা একাধিকবার। তবে তার মধ্যে একটি সফর তাঁর কাছে খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল। সেটি হল, লন্ডনের বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক জিএম ফুরুকের “যদি আরেকটু সময় পেতাম” নামক পূর্ণদৈর্ঘ্য একটি ছবিতে অভিনয় করা। তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেছেন হলিউডের নায়িকা সেলিন বেরন। এ ছবিতে প্রডিউসর ছিলেন, ওসমান, সেলিম খান ও কদরুল। সহযোগি হিসাবে আরো কয়েকজনের নাম তিনি উল্লেখ করেন।
লন্ডনে ছবিটির মহরত অনুষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ ও লন্ডনে এটির চিত্রধারণ করা হয়। চলচ্চিত্রটির কাহিনি বিলেতে বসবাসরত বর্তমান তৃতীয় প্রজন্মের দিন যাপন ও পরিচয় সংকট নিয়ে। তারা কী ব্রিটিশ না বাঙালি? এমনই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে। এ চলচ্চিত্রের মূল অভিনেত্রি সেলিন বেরনের পিতা ডেনমার্কের অধিবাসি ও মা কলকাতার বাঙালি হওয়ায় সেলিন বেড়ে উঠেন মিশ্র সংস্কৃতির মাধ্যমে। আমেরিকার টেক্সাসে জন্ম নেয়া এ অভিনেত্রী নাচ দিয়ে তার ক্যারিয়ার শুরু করলেও পরবর্তীতে অভিনয়ে জড়ান। তখন পর্যন্ত তিনি হলিউডের ১৩টি স্বল্পদৈর্ঘ্য ও বেশকিছু টেলিভিশন কাহিনিচিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
তারা যখন দেশে শুটিং করতে যান তখন এক সাক্ষাৎকারে ফেরদৌস বলেন, “আমার আমন্ত্রণেই সেলিন বেরন লন্ডন থেকে এখানে উড়ে এসেছে। এদেশে এটাই ওর প্রথম আসা। আমরা ঢাকায় কিছু শ্যুটিং করবো, ছবির বেশিরভাগ শ্যুটিংই লন্ডনে হবে”।
চিত্রনায়ক ফেরদৌস এর স্ত্রীর বৈমানিক তানিয়া। ২০০৪ সালের ৯ ডিসেম্বর তানিয়ার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ছেলে রেজা ও দুই কন্যা নুজহাত ফেরদৌস ও নামিরা ফেরদৌসকে নিয়ে তার সুখের সংসার। ফেরদৌসের শশুড় হলেন, যশোহরের সাবেক এমপি জনাব আলী রেজা রাজু।
‘ফেরদৌসের স্ত্রী তানিয়া রেজা বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন। পেশাগত ব্যস্ততার কারণে আজ এ দেশে তো কাল আরেক দেশে। এভাবেই কেটে যাচ্ছে তাদের সংসার। বিমান যেমন বাতাসে ভেসে এগিয়ে চলে, তেমনি বিশ্বাসের ওপর ভেসে এগিয়ে যাচ্ছে, দ’ুজনের সংসার। ফেরদৌসের অভিনয়জীবনে ছিল অনেক চড়াই-উৎরাই। সেই সময়গুলোতে স্ত্রী তাঁকে সমর্থন জুগিয়েছেন। একবার কী কারণে যেন অভিনয়ের ওপর খানিকটা মন খারাপ হয়েছিল ফেরদৌসের। তখন তানিয়া বলেছিলেন, ‘চাইলে তুমি অভিনয় ছেড়ে দিতে পারো। আমি তোমার সঙ্গে আছি।’ স্ত্রীর কাছ থেকে এমন সমর্থন পাওয়াটাও একটা বড় ব্যাপার বলে মনে করেন ফেরদৌস। তিনি জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩ তম অধিবেশনেও যোগ দেন প্রধামন্ত্রি শেখ হাসিনার সাথে।
ফেরদৌস বলেন, সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমরা দু’জন যে বিষয়টার দিকে গুরুত্ব দিই, তা হচ্ছে বিশ্বাস। একজন আরেকজনকে বিশ্বাস করি। আমি যে অঙ্গনে কাজ করি, আমাকে সারাক্ষণই নায়িকা কিংবা সহশিল্পীদের সঙ্গে সময় কাটাতে হয়। এ ক্ষেত্রে সে (তানিয়া) যদি আমাকে বিশ্বাস না করত, আমি ঠিকমতো কাজই করতে পারতাম না।’
সন্তানদের সম্পর্কে ফেরদৌস বলেন, ‘আমার সন্তানদের কখনোই বুঝতে দিই না যে, আমি নায়ক। আজও যেমন বাচ্চাদের নিয়ে মাঠে এসেছি, তখন অনেক অভিভাবক আমাকে বলছেন, আপনার বাচ্চাদের দেখে মনে হয় না, তারা “স্টার কিড”। ওদের কখনো এই অনুভূতি হোক, তা আমি চাই না। ফেরদৌস বলেন, ‘আমি অনেক কষ্ট করে অভিনেতা হয়েছি। আমার মা-বাবাও আমাকে আর দশজন সাধারণ সন্তানের মতোই মানুষ করেছেন।
এবার এই করোনা পরিস্থিতি আলাদা করেছে তাদের। ফেরদৌস জানান, সম্প্রতি লন্ডনের এক ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন তানিয়া। এরপর থেকে গুলশানের একটি বাসায় কোয়ারেন্টাইনে আছেন তিনি ও সন্তানদের নিয়ে বনানীর বাসায় থাকছেন ফেরদৌস। ওরা মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলে। এটা সবার জন্য আমাদের ত্যাগ।
এক সময় বিশ^সুন্দরী প্রতিযোগিতার আসরে বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন এ চিত্রনায়ক। সাথে ছিলেন, চিত্রনায়িকা মৌসুমী এবং ফারনাজ আলম। আয়োজক অমিকন এন্টারটেইনমেন্টের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান, এক্সপার্ট প্রোভাইডারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অপু খন্দকার, এক্সপোজারের সিওও সজীব রশীদ প্রমুখ। এখান থেকে নির্বাচিত দেশ সেরা প্রতিযোগীই মিস ওয়ার্ল্ডের আসরে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অনবদ্য অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র অভিনেতার পুরস্কারে ভূষিত করা হয় তাকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একজন শিল্পীর জন্য এটা রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। মাননীয় ধানমন্ত্রী শেখ প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনার হাত থেকে এমন পুরস্কার গ্রহণ করতে পেরে আমি সত্যিই আনন্দিত। এটা কতটা সৌভাগ্যের, কতটা গর্বের- তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
তিনি বলেন, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের মঞ্চে আমি ও পূর্ণিমা একসঙ্গে উপস্থাপনা করেছি। এটা আমাদের জন্য বাড়তি পাওয়া। বিশেষ করে আমার জন্য। আগে শুধু পুরস্কার গ্রহণ করতেই মঞ্চে উঠেছি, এবার উপস্থাপনাও করেছি। আমাকে এমন একটি সুযোগ দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাই।
ফেরদৌস এর জন্ম ৭ জুন ১৯৭৬ কুমিল্লার তিতাশ উপজেলায়। তার পুরো নাম ফেরদৌস আহমেদ। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। পড়াশোনা শেষ করেই জড়িয়ে পড়িয়েছিলেন মডেলিংয়ে। সেই সূত্রেই প্রবেশ করেন চলচ্চিত্রে। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com