জীবনের কথা, পর্ব-৩২
যা মানুষকে নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত করে
:: মো. রহমত আলী ::
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ জীবনযাপন ছাড়া একাকী জীবন যাপন করা মানুষের পক্ষে সহজ নয়। আবার পরিচিত সমাজের বাইরেও মানুষের পক্ষে চলা খুবই কঠিন। তাই পৃথিবীর সমাজবদ্ধ কোনো মানুষই সামাজিক বিপর্যয় কামনা করতে পারেন না। মানুষ সব সময় সুখ ও শান্তি চায়। শান্তি মানুষের একটি আরাধ্য বিষয়। কিন্তু এই প্রত্যাশিত সুখ-শান্তি নির্ভর করে সমাজবদ্ধ মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর। উঁচু-নিচু, ধনী-দরিদ্র এসব পার্থক্যই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং মানব সমাজের এই পার্থক্য সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার নিমিত্তেই। যেসব কারণে সমাজের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয়, সমাজ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হয়, সামাজিক মূল্যবোধ বিনষ্ট হয়, পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট হয়, তার মধ্যে অন্যতম কারণ হলো গীবত, যা মানুষকে নিকৃষ্টতম প্রাণীতে পরিণত করে।
গীবত শব্দটি হলো, পরনিন্দা, কুৎসা রটনা, গোপনে সমালোচনা করা বা দোষ বর্ননা করা ইত্যাদি। কারো অনুপস্থিতে অন্যের কাছে এমন দোষ বর্ননা করা যা সে শুনলে খারাপ লাগে, অপছন্দ করে বা অসন্তুষ্ট হয় তাকেই গীবত বলে। মুখে হোক আর লেখনীতে হউক। মুসলমানের নিকট হউক আর অমুসলিমের নিকট হউক। কেউ গীবত শুনলে তার অনুপস্থিত ভাইয়ের পক্ষ থেকে তা প্রতিরোধ করবে সাধ্যমতো। আর যদি প্রতিরোধের শক্তি না থাকে তবে তা শ্রবণ থেকে বিরত থাকবে। কেননা, ইচ্ছাকৃতভাবে গীবত শোনা নিজে গীবত করার মতোই অপরাধ।
আমাদের সমাজে অনেক লোক আছে যারা সব সময় এটা করে বেড়ায়। নিজে কি করছে বা নিজের পরিবারের কে কোথায় চলাফেরা করছে তার প্রতি কোন খেয়াল না রেখে অন্যদের সম্বন্ধে বা অন্যের ছেলে-মেয়ে সম্পর্কে কুৎসা রটনা করে দিন গুজরান করে। এ সমস্ত বিষয় শুধু বলে বেড়ানোতেই শেষ নয়, সময়-সূযোগে টেলিফোনেও দীর্ঘ সময় ধরে তা আলাপ করে থাকে। আজকালতো ফ্রি মোবাইলের যোগ। তাই ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে আলাপ করলেও অসুবিধা নাই। ঁেচাখে দেখুক আর না দেখুক শুনা কথাতেই মনের মাধুরি মিশিয়ে তারা তা আলাপ করে থাকে। আর এ আলাপ যে শুধু পুরুষরা করে তা নয়, অনেক মহিলা বিশেষ করে বয়স্ক মহিলা আছে যারা এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি, এক ঘর থেকে অন্য ঘরে, এক বাসা থেকে অন্য বাসায় গিয়ে পান-সুপারীর কথা বলে এ সমস্ত বাক্যালাপে সময় কাটায়।
বিলেতে প্রয়োজন ছাড়া কেউ কারো ঘরে যায় না। আর গেলেও অনেকের কাছে তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তুু এ ধরণের বহুমাত্রিক প্রাণীগুলোর কদর কমবেশী সব ঘরেই আছে। তারা যদি কোন ঘরে কদাচিৎ না যায় তবে সেই ঘরওয়ালারাই খবর দিয়ে বা টেলিফোন করে তাদের সন্ধান চায়। অনুরোধ জানায় একবার যেন তাদের ঘর ভিজিট করে আসে। তাদের কথাবার্তা এমনই যে, ভাত খাওয়ার পর যেভাবে পানসুপারী খাওয়ার বা ধূমপায়ীদের ধুমপান করার ইচ্ছা হয় ঠিক তেমনি এদের অনুপস্থিতি যেন অনেকের কাছে সে রকম তুষ্ণার্থ মনে হয়। আর এ কারণেই তারা সূযোগ পায় একজনের কথা অন্যজনের কাছে বয়ে নিয়ে যেতে। সত্য মিথ্যার কোন বালাই থাকে না তাদের কাছে। এখন কথা হলো, যারা এ সমস্ত লোকের কথায় অন্যকে খাটো মনে করে বা কারো প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করে তারা কি ভেবে দেখেছেন যে, সে যেভাবে অন্যজন সম্বন্ধে বলছে ঠিক সেভাবে কিন্তু তাদের সম্বন্ধেও অন্যখানে বলে যাচ্ছে। এখানে যেভাবে তিনি অন্যজনের সমালোচনা করায় তিনি তার কথা শুনছেন অন্য জায়গায় গিয়েও কিন্তু এই ব্যক্তি সম্পর্কে এভাবে বলছে। তা না হলে কেউ-ই তাকে ভালবাসবেনা। তাই প্রত্যেকের কাছে ভালবাসা পেতে এভাবেই কথা বলতে হয় তাদের। তারা মুখে ভালবাসা দেখায় বটে কিন্তু অন্তরে অনিষ্ঠ চিন্তা পুষন করে। প্রয়োজনে ক্ষতি করতেও দ্বিধা করে না।
দেশে হউক, আর বিদেশে হউক এই কুৎসা রটনা বা পরনিন্দা আমাদের সমাজে একটা জটিল ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে অনেক সময় একে অন্যের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি, ভুল বুঝাবুঝি এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা পর্যন্ত হয়ে থাকে। যা দেশ, সমাজ ও কমিউনিটি জন্য অত্যন্ত হুমকি স্বরূপ। এর প্রতিক্রিয়ায় অনেক সময় আত্মীয়তা বা পারিবারিক ক্ষেত্রে ধংশ নেমে আসে। বিস্তৃত হয় কলহের জের। তাই এ থেকে বাঁচার উপায় কি?
এ বিষয়ে পবিত্র হাদীসে আছে- “আর তোমরা একজন অন্যজনের গোপনীয় বিষয় অনুসন্ধান করো না এবং একে অপরের অসাক্ষাতে নিন্দা করো না। তোমাদের মধ্যে কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে চাইবে? প্রকৃতপক্ষে তোমরা তো এটাকে ঘৃন্যই মনে কর। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহ তওবা গ্রহণকারীর পরম দয়ালু।”
গীবত করার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে- মানুষ সব সময় নিজেকে বড় করে দেখে, এই আমিত্বের আরেক নাম আত্মপূজা। এটা শুরু হয়ে গেলে আত্মপ্রীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তখন তার আত্মত্যাগের মতো মহৎ বৈশিষ্ট্য দূরিভূত হতে থাকে। ফলে এ স্থানে দানা বাঁধে হিংসা-বিদ্বেষ। আবার হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই অপরের প্রতি কুধারণার সৃষ্টি হবে, যা মানুষকে গীবত করতে বাধ্য করে। সুতরাং আত্মপূজা, আত্মপ্রীতি, হিংসা-বিদ্বেষ, কুধারণাই মানুষকে গীবত করতে বাধ্য করে।
পরনিন্দা ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য। গীবত এরূপ জঘন্য পাপের কাজ হওয়ার কারণ: পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর কাছে তওবা করলে ব্যভিচারের কবিরা গুনাহও মাফ হয়ে যায়। কিন্তু গীবত বা পরনিন্দা হচ্ছে বান্দার হক। বান্দা তা মাফ না করলে কখনো মাফ হতে পারে না। এ জন্য নবীজী বলেছেন, তোমরা সর্বদা গীবত থেকে বাঁচার চেষ্টা কর। কেননা গীবতে তিনটি মারাত্মক গোনাহ রয়েছে (১) গীবতকারী ব্যক্তির দোয়া কবুল হয় না (২) তার কোন নেক আমল আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না (৩) তাকে অসংখ্য গোনার বোঝা বহন করতে হয়। তিনি আরো বলেন, রোজ কেয়ামতে চোগলখোর ব্যক্তির অবস্থা হবে খুবই নিকৃষ্ট। দুনিয়াতে কিছু লোকের কাছে এক রূপ বলত অন্যদের কাছে তার উল্টো বলে মানুষের মধ্যে ফেতনার সৃষ্টি করতো। এরূপ দুমুখো লোকদের শাস্থিস্বরূপ আগুনের দু’টি জিহবা হবে। নবীজী আরও ইরশাদ করেন- চোগলখোর লোক বেহেশতে প্রবেশ করবে না।
গীবত থেকে বেঁচে থাকা অত্যন্ত জরুরি। এ থেকে বাঁচার প্রথম উপায় হচ্ছে অপরের কল্যাণ কামনা করা। আত্মত্যাগ অর্থাৎ যেকোনো প্রয়োজনে অপর ভাইকে অগ্রাধিকার দেয়া, অপরের অপরাধকে ক্ষমা করে দেয়া ও মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী বেশি বেশি করে অধ্যয়ন করা। সৎ ও জ্ঞানী মানুষের সংস্পর্শে থাকা। সাথে সাথে ধর্মকর্মে নিয়োজিত থাকা। যারা এ সমস্ত নিন্দনীয় কাজে জড়িত থাকে তাদের এড়িয়ে চলা, ইত্যাদি। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com