প্রচ্ছদ

জীবনের কথা, পর্ব-৩৪

  |  ১৫:৩৩, জুলাই ১৫, ২০২০
www.adarshabarta.com

৪৮ ঘন্টার পর আট বছরেও সুরাহা হয়নি সাগর-রুনীর হত্যাকান্ডের বিষয়টি

:: মো. রহমত আলী ::

মেঘের কুলে রোদ হেসেছে
বাদল গেছে ছুটি
আজ আমাদের ছুটি ও ভাই
আজ আমাদের ছুটি।

ছোটবেলায় এ কবিতাটি মূখস্থ করেছিলাম। কিন্তু তখন এর যথার্থতা তেমন উপলদ্ধি করতে পারিনি। এরপর আর কখনও এ কবিতাটি স্মরণ করার প্রয়োজন পড়েনি। তাই এতদিন এ কবিতাটি আমার মূখস্ত করা অন্যান্য কবিতার মতই হালখাতা হিসাবে রয়ে গেছে। আজ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হঠাৎ তা আবার মনের মধ্যে বেশ কৌতুহল সহকারেই উদয় হলো। তাই লেখার শুরুতে সেটি তুলে ধরলাম।
কবি তার কবিতায় বাদলা দিনে মেঘে ভরা আকাশে যখন হঠাৎ সূর্য্য উকি মারে আর সাথে সাথে পৃথিবীটা আলোকিত হয়ে যায় সেটাই বুঝাতে চেয়েছেন। এর সাথে আরেকটি বিষয়ের তুলনা করা যায়। তা হলো মানুষের জীবনের দুঃখ যখন অমানিষার অন্ধকারে ঘনিভূত হয়, আর তখন যদি কোন আশার বাণী শুনা যায় তবে সে দুঃখ বেদনা ক্ষনিকের জন্য হলেও প্রশমিত হয়। অন্যান্যদের বেলায় যাই হোক, প্রয়াত সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনির একমাত্র জীবিত সন্তানের জীবনের মর্মান্তিক কাহিনী সবাই জানেন। পিতামাতাকে হারিয়ে সে এখন নিঃস্ব। মামার আশ্রয়ে সে বড় হচ্ছে। সে বিয়োগান্ত ঘটনা যখন ঘটে তখন তার বয়স ছিল ৬ বছর আর এখন হয়েছে ১৪। বিগত ৮ বছর তার পিতামাতার খুনের ঘটনার বিচার প্রক্রিয়ার তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। তা হলে কী “বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতেই রয়ে যাবে”। মেঘ কি কোনদিন আর আশার বানী শুনবে না তার পিতা-মাতার বিচারের ব্যাপারে।
সে যাই হোক, মেঘের কোলে রোদ হেসেছে হিসাবে বর্তমানে আরো একটি আশার আলো দেখা যাচ্ছে। যা হলো হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সংস্থাটির প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ এর সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আবারো তা আদালতে দাখিল করেছেন বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের বেসরকারি টিভি চ্যানেল মাছরাঙার বার্তা সম্পাদক সাগর এবং এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার তার স্ত্রী রুনি ২০১২ সালের ১১ ফেব্রæয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে তাদের ভাড়া বাড়িতে নিহত হন। এই দম্পতির শিশু মাহির সারোয়ার মেঘ তখন বাড়িতেই ছিলো। ঘটনার পর শেরেবাংলা নগর পুলিশ এবং গোয়েন্দা শাখার তদন্তের পর, র‌্যাব এই মামলার তদন্ত শুরু করে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল। এ পর্যন্ত মামলাটি তদন্ত করেছেন সাতজন কর্মকর্তা।
এদিকে সদ্য প্রয়াত সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ওই ঘটনার পর ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের ধরার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পার হয়ে ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত সাগর-রুনি হত্যার কোনও সুরাহা হয়নি। ধরা পড়েনি হত্যাকারীরা। ওই হত্যাকান্ডের পর আরও দু’বছর সাহারা খাতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। তবে এ ব্যাপরে সাহারা খাতুন জীবদ্ধশায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, ‘আমি কথাটা ঠিক ওইভাবে বলিনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আদেশ দিয়েছিলাম ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও আমার এই কথাটা ‘টুইস্ট’ করেছেন আমার সাংবাদিক ভাইয়েরা।’ সে যাই হোক, তিনি এখন পরলোকগত তাই আর কোন মন্তব্য করা সমিচিন হবে না। তবে বর্তমানে যিনি বা যারা এ দায়িত্বে রয়েছেন তাদের কাছেই বিষয়টির ভার তুলে ধরতে হয় বার বার। সে হিসাবে এ ব্যাপারে প্রচেষ্ঠা চালানো হয় বিভিন্ন সময়।

আমি ২০১৫ সালের জানুয়ারী মাসে আমি অনেক কষ্ঠ করে ঢাকায় গিয়ে মেঘের সাথে দেখা করি। তাকে খুঁজে বের করাটাও ছিল বেশ কষ্ঠসাধ্য। আমি একসময় এডভোকেট মনজিল মোরসেদ সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে যাই। হঠাৎ মাছরাঙ্গা টেলিভিশনের একজন ক্যামেরা ম্যানকে তার সন্ধান জিজ্ঞাসা করি। তিনি তখন একটি ফোন নম্বর দিয়ে তার সন্ধান পাওয়া যেতে পারে বলে জানালেন। আমি তখন সে নাম্বারে ফোন করে তার দাদীর ফোন নং সংগ্রহ করি। কিন্তুু দাদী জানালেন যে, সে তাদের কাছে থাকে না। তার মামার কাছে থাকে। তবে তিনি আমাকে তার মামা ইনডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশনে কর্মরত নওশের আলম রোমানের নাম্বার দিলেন। আমি তখন রোমান ভাইকে ফোন করি। প্রথমে তিনি অপারগতা প্রকাশ করলেও শেষ মুহুর্তে আমি অনেক দূর থেকে গিয়েছি শুনে রাজী হলেন।
আমি তখন তার সাথে সাক্ষাৎ করার সূযোগ পাই। তাকে কাছে নিয়ে বসলাম কিন্তুু সে তার শিশুসূলভ চপলতার মাধ্যমেই আমার পাশে বসলো। একবার এদিক, একবার ওদিক তাকাতে থাকে। হঠাৎ তার মামাতো ভাইয়ের সাথে দৌড় দিয়ে চলে গেলো। আবার ফিরে আসলো। আমাকে চা-পানে আপ্যায়িত করা হলো। ফিরে আসার সময় কয়েকবার তার দিকে তাকালাম। কিন্তুু শান্তনা দিবার ভাষা বা সূযোগ কোনটাই পেলাম না। আমার অন্তরের বেদনা অন্তরেই রয়ে গেলো। মামা জানালেন, তিনি তাকে নিয়ে খুবই আশংকার মধ্যে আছেন। কখন কি ঘটে যায় তার জন্য তিনি সব সময়ই তটস্ত থাকেন। সাথে সাথে এটাও জানালেন যে, অনেকেই নানা ব্যাপারে অনেক আশার বাণী শুনিয়ে ছিলেন কিন্তুুু সবই গুড়ে বালি। কাজের কাজ কিছুই হয় নাই। তাই তিনি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত।
তিনি জানালেন প্রতিবছর সাগর রুনীর মৃত্যু বার্ষিকী আসলে অনেকে তার খোঁজ খবর নেন। তাকে সমবেদনা জানান, সহমর্মিতা প্রকাশ করেন। কিন্তু মেঘ এখন আর তাতে সন্তুষ্ঠ নয়। সে এখন বেশ বড় হয়েছে। তাই তার পিতামাতার সন্ধান চায়। কিভাবে কি ঘটেছিল তাও জানতে চায়। তারা তখন তাকে সান্তনা দিবার ভাষা খুঁজে পান না। আগামী দিনেও কি শান্তনা দিবেন সেটাও তাদের জানা নেই। এ অবস্থায় আমিও শান্তনার ভাষা খুঁজে না পেয়ে ‘শুভ কামনা’ করি মেঘের জন্য। সাথে সাথে সে যখন বড় হচ্ছে তখন তার পিতামাকে পাওয়ার জন্য যে ভাবনা মনের মধ্যে উদয় হচ্ছে তা উপলব্দি করতে গিয়ে লালন শাহের একটি গানের কথা স্মরণ করেই লেখাটি শেষ করতে চাই।

“মিলন হবে কতদিনে।
আমার মনের মানুষের সনে।।
চাতকপ্রায় অহর্নিশি
চেয়ে আছে কালশশী
হব বলে চরণদাসী
ও তা হয় না কপাল গুণে।।
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন
লুকালে না পায় অন্বেষণ
কালারে হারায়ে তেমন
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে।।
ঐ রূপ যখন স্মরণে হয়
থাকে না লোকলজ্জার ভয়
লালন ফকির কেদে বলে সদাই
ও প্রেম যে করে সেই জানে”।। (চলবে)।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com