জীবনের কথা, পর্ব-৩৫
ছবি শুধু কথা বলে না ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমও হয়
:: মো. রহমত আলী ::
আনোয়ার চৌধুরী যখন ব্রিটিশ হাইকমিশনার হিসাবে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছিলেন তখন তাঁকে একটি সংবর্ধনা প্রদান করা হয়েছিল। বৃটেনের বাঙালী কমিউনিটির পক্ষ থেকে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে আমিও যোগদান করেছিলাম। সে অনুষ্ঠানে আমি বক্তব্য দানকালে বলেছিলাম যে, তিনি যেন তার সাথে ছবি তোলার ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করেন। কারণ আমার তখন মনে হয়েছিল তাঁর সাথে তোলা ছবির অপব্যবহার করা হতে পারে। আমার কথাটি শুনে তখন কেউ কেউ একটু মনক্ষুন্ন হয়েছিলেন। তবে আমি এ জন্য অনুতপ্ত ছিলাম না ।
এরপর তিনি প্রায় চার বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানতে পারি যে, এ সমস্ত ছবির কোনটি বৃটেনে আবার কোনটি দেশে প্রদর্শন করে নিজের শ্রেষ্টত্ব দেখানোর প্রচেষ্ঠা চালানো হয়েছে। তবে এর মাধ্যমে কে কতটুকু শ্রেষ্ঠ হয়েছেন তা আমি জানি না। কারণ আনোয়ার চৌধুরী তখন এবং এখন অনেকের সাথেই ছবি তুলে চলেছেন। আমার জানামতে তিনি এখন পর্যন্ত কাউকে নিরাশ করেন নি। বাউল শিল্পি কালা মিয়া থেকে শুরু করে রুনা লায়লার সাথে পর্যন্ত তার ছবি রয়েছে। বৃটেনের বৈশাখী মেলার দর্শকদের সাথে গান গাওয়ার ছবিও আছে।
ছবি তোলার ব্যাপারে আমার এ আলোচনায় অনেকে হয়তো মনে করতে পারেন যে, আমি এ সমস্ত ছবি তোলার বিরোধী। আসলে কিন্তু তা নয়। আমারও অনেক ছবি আছে ভিআইপিদের সাথে। আমার কথা হলো ছবি তুলতে আমার কোন আপত্তি নাই। তবে সেটা হতে হবে স্থান কাল পাত্র ভেদে। টাঙ্গিয়ে রাখার ব্যাপারেও হতে হবে তাই। তা হলেই কেবল ছবিগুলি যথাযোগ্য মর্যাদা পাবে। তবে যারা শুধু ছবি তুলেন কেবল তারা নন‘ যারা ভিআইপি তারাও একটু খেয়াল রাখতে হবে কার সাথে কিভাবে ছবি তুলছেন। বিশেষ করে তিনি যখন কোন বিশেষ পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকেন।
এবারে ছবির প্রয়োগ বা ব্যবহার সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করছি। উন্নত দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থায় ভিআইপিদের সাথে ছবি তোলা ও ব্যবহার তেমন কোন বিশেষ ফায়দা হাসিলের সূযোগ থাকেনা। এটা দিয়ে কেউ স্বার্থ আদায়ের চেষ্টাও করেনা। বৃটেনে বা আমেরিকায় অনেক ভিআইপির সাথে সাধারণের ছবি আছে। বৃটেনের বিগত সাধারণ নির্বাচনের সময়ও তার পূর্বে অনেকেই সরকারী দল বা বিরুধী দলের নেতৃবৃন্দের সাথে ছবি তুলেছেন। কিন্তু তা সে পর্যন্তই। হয়তো তা ফেইসবুকে বা এলবামে সংরক্ষিত আছে।
তবে আমাদের দেশের অবস্থা ভিন্ন। একজন নি¤œ পর্যায়ের কর্তকর্তা যদি কখনো দেখেন যে, তার উচ্চ পর্যায়ের কারো সাথে কারো ছবি আছে তখন স্বভাবতই সে ব্যক্তি আইনের প্রয়োগ করতে গিয়ে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে যান। কারণ ছবি কথা বলে এবং এর একটা ক্ষমতার প্রভাব রয়েছে। সেটা হউক নতুন অথবা পুরাতন।
আমার জানা মতে একজন রাজনৈতিক নেতা দেশের শীর্ষস্থানীয় ভিআইপির সাথে তোলা ছবিগুলি সব সময় বৃটেন থেকে দেশে যাওয়ার সময় সাথে করে নিয়ে যান। এতে বিমানবন্দরসহ দেশে বিভিন্ন অফিসে কাজ করার ক্ষেত্রে তা বাড়তি নিয়ামক হিসাবে কাজ করে বলে তিনি জানান। ছবিগুলি এমনভাবে তোলা তাতে মনে হয় যেন, তিনি সেই ভিআইপিদের একেবারে কাছের লোক। তাই সময় সূযোগমত তিনি তা প্রদর্শন করে থাকেন। শুধু তাই নয়, অনেক রাজনৈতিক নেতা যারা যুক্তরাজ্যে বসবাস করেন তারা কেবলমাত্র দেশের ভিআইপিদের সাথে তোলা ছবি ফেইস বুকে বা অন্যান্য সামাজিক মিডিয়ায় প্রদর্শনের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আরাধনার পাত্র হিসাবে পরিগণিত হয়ে থাকেন। এ সমস্ত কর্মীরা হয়তো তাদের সরাসরি অনেক সময় দেখেও না কিন্তু ভিআইপিদের সাথে তোলা ছবির মাধ্যমেই তারা এ আরাধনা করে থাকে।
এবার ছবি তুলতে না পারা সংক্রান্ত একটু কিছু বলেই তা শেষ করতে চাই। একবার কিছু রাজনৈতিক নেতাকর্মী গিয়েছিলেন একজন ভিআইপিদের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য। সুতরাং এ ধরণের সাক্ষাতের বিশেষ উদ্দেশ্যে থাকে নিদেন পক্ষে একটা ছবি তোলার। কিন্তু তারা সাক্ষাৎ করলেন বটে কিন্তু ছবি তুলতে পারলেন না। তাই তাদের এ আফসোস দীর্ঘদিন ছিল। তাদের ছবি তুলতে না পারার কারণ ছিল সেই ভিআইপির সামনে থাকা টেবিলগুলি এমনভাবে সাজানো ছিল যে, তাতে সেই ভিআইপির সংস্পর্শে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তাদের বিফল হতে হয়েছিল।
এখন সেলফির যুগ। তাই ছবি তুলতে অন্যজনকে ডাকতে হয় না বা সহযোগিতার জন্য বলার প্রয়োজন পড়ে না। ভিআইপির কাছে গিয়ে নিজে নিজেই ছবি তোলা যায়। সে রকমের একজন ছবি তুলতে গিয়ে একজন মন্ত্রীর পায়ে আঘাত করায় মন্ত্রি বেশ বিরক্ত হন এবং তাকে অনেকটা ধাক্কা মেরে সেখান থেকে সরিয়ে দেন। এ নিয়ে পরে পরস্পর বিরুধী বক্তব্য শুনা যায়। কিন্তু যতই হউক, এ ধরনের ঘটনা যে প্রায় সময় ঘটে না তা বলা যাবে না।
সম্প্রতি বাংলাদেশে এ ছবি তুলে প্রতারনার বিষয়টি বেশ আলোচনায় রয়েছে। বিশিষ্টজনদের সঙ্গে তোলা ছবি ব্যবহারই ছিল রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম প্রতারণার উৎস। রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, এমপি, পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, সাংবাদিক ও আমলাদের সঙ্গে তোলা শতাধিক ছবির সন্ধান পাওয়া যায়। এসব ছবি প্রদর্শন করে সাহেদ অধীনদের কাছে জাহির করতেন তিনি অনেক ক্ষমতাবান ব্যক্তি। আর তা ব্যবহার করেই সাহেদ বিভিন্ন জায়গায় তদবির করতে দোর্দন্ড প্রতাপ খাটাতেন। প্রতারণা করে উদ্দেশ্য হাসিল করতেন।
কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সাহেদের ছবি তোলার জন্য তাঁর সহযোগী থাকতেন। সাহেদ বিশিষ্ট ব্যক্তির পাঁশে গিয়ে দাঁড়ালে তাঁর সহযোগীরা তাৎক্ষণিক ছবি তুলে ফেলতেন। কোনো বিভাগের কাজ করতে গেলে বা তদবিরে গেলে সেখানকার অধীনদের শীর্ষ ব্যক্তির সঙ্গে সাহেদের ছবি দেখিয়ে ভয় দেখাতেন।
সিলেটের একজন পাথর ব্যবসায়ী হাজি শামসুল মাওলা যখন এ প্রতারক সাহেদের কাছে তার পাওনা টাকার জন্য বার বার ধর্ণা দিচ্ছিলেন তখন তাকে দেয়ালে টাঙ্গানো ছবি দেখিয়ে বলা হয় যে, সে তাদের প্রত্যেকের সাথে ঘনিষ্ট তাই তাকে কিছু করা যাবে না। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com