জীবনের কথা, পর্ব-৩৭
চিটি পড়ার কেরামতি জানা ছিল বলে ইজ্জত রক্ষা হয়েছিল
:: মো. রহমত আলী ::
আমরা ছোটবেলায় দেখেছি ডাক বিভাগের অবস্থা, আমাদের পূর্ব পুরুষ দেখেছেন ব্রিটিশ আমলের ডাক ব্যবস্থা এবং ইতিহাসে আছে তারও আগের দিনের ডাক ব্যবস্থার বর্ননা। কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম এ ডাক ব্যবস্থার কথা এখন প্রায় ভুলতেই বসেছে। তবে বাংলাদেশে এটা বর্তমানে নাজুক পরিস্থিতে থাকলেও বৃটেনে এখনো তা চালু আছে তার ঐতিজ্য বজায় রেখে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তার সার্ভিস সীমিত পর্যায়ে নিয়ে এসেছে।
আমি যখন চিটি লিখতে শিখি তখন একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। হাইস্কুলে পড়াকালিন লজিং বাড়িতে আমাকে ‘মাস্টার’ বলে ডাকা হতো। তাই অনেকে বিদেশে তাদের আত্মীয়দের কাছে চিটি লিখে দেয়ার জন্য আসতেন। তাই তাদের আব্দার আমাকে রক্ষা করতে হতো। কিন্তু আমার হাতের লেখা ছিল একেবারে খারাপ। অনেক সময় আমার নিজের লেখা আমি নিজেই পড়তে পারতাম না। তাই কারো চিটি লেখার পর আবার পড়ে শনানোর কথা বললে আমি মহা বিপদে পড়তাম। এভাবে এক সময় একটি চিটি লিখে এক ব্যক্তিকে দিয়েছিলাম। এরপর যখন তার উত্তর আসলো তখন আবার তিনি আমার নিকট আসলেন তা পড়ে শুনানোর জন্য। আমি চিটি খুলে পড়তে লাগলাম। কিন্তু তার এক পর্যায়ে লেখা ছিল ‘যাকে দিয়ে তুমি চিটি লেখাও তাকে দিয়ে চিটি লেখাবে না, কারণ আমরা তা পড়তে পারি না’।
আমি তখন নিজের ইজ্জত রক্ষার্থে এ অংশটিকে একটু ভিন্নভাবে পড়লাম। অর্থৎ এখানে যে দুইবার ‘না’ শব্দ লেখা আছে তা উল্লেখ করলাম না। তাই লেখাটি দাঁড়লো ‘যাকে দিয়ে তোমরা চিটি লেখাও তাকে দিয়ে চিটি লেখাবে’, কারণ আমরা তা পড়তে পারি’। এরপর আমি অনেক্ষন নিজে নিজে হাসলাম। কিন্তু এ যাত্রা রেহাই পাওয়া গেলেও আমার তখন চিটি লেখার পরিমান বেড়ে যায়।
প্রবাসী অধ্যুসিত এলাকার অনেকের হয়তো স্মরণ আছে যে, আগের দিনে প্রবাসী ছেলেদের বিয়ের সময় একটা আব্দার থাকতো যে পাত্রীকে নিদেন পক্ষে চিটিপত্র লেখার যোগ্যতা থাকতে হবে। এর কারণ নিশ্চই সবার বোধগ্য। এ রকমের এক নববধু তার শশুড়ের অনুরোধে ছেলের কাছে পত্র লিখিয়েছিলেন। সে পত্রটি লেখার কয়েকদিন পর শশুড় খুব খুশি হয়ে গোপনে গোপনে একটা চিটি এনে পুত্র বধুর কাছে দিলেন। তিনি তখন তাড়াতাড়ি উত্তর আসবে তা কল্পনা করতে পারেননি। কিন্তু বধু পত্র দেখে বিষয়টা বুঝতে পারেন যে তা বিষয়টা বুমেরাং হয়ে গেছে। অর্থাৎ সে চিটিতে প্রেরক এবং প্রাপকের ঠিকানা লেখাটা উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। তাই তা ফেরত এসে গেছে। কিন্তু তিনি সেটা বুঝতে দিলেন না। যেভাবে ফেরত আসা পত্রটি সংক্ষিপ্তভাবে পড়লেন তাতে মনে হলো যে, ‘এই চিটি সেই চিটি নয়’। এটা নতুনই এসেছে।
এ চিটি-পত্র লেখা বা পড়া নিয়ে অনেক কথা আছে। এ নিয়ে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে অনেকের মধ্যে। তখন প্রবাসীদের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই চিটি। অনেক পিতামাতা পুত্রের কাছ থেকে চিটি পাওয়ার প্রত্যাশায় থাকতেন সব সময়। বিলম্ব হলে চিন্তায় পড়ে যেতেন সবাই। এরপর তা পেলে সবার মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসতো। সে সময় সাধারনতঃ পনের থেকে বিশ দিন অথবা ক্ষেত্র বিশেষে মাস পর্যন্ত লাগতো চিটি পৌছতে। মানিওর্ডারও আসতো পোস্ট অফিসের মাধ্যমে। তখন জরুরী চিটিপত্র রেজিস্ট্রার্ড ডাকযোগে আদান প্রদান হতো। আর এর মাধ্যমে প্রায় সময় টাকার চেক আসতো। কিন্তু এখন আর সে দিন নেই। নতুন প্রযুক্তির কারণে তা হয়েছে একবারে সহজ মাধ্যম যা একযুগ আগেও কল্পনা করা যায়নি।
সে যাই হোক। এক সময় পোষা পায়রার পায়ে বেঁধে প্রিয়জনের কাছে বার্তা পাঠাতো মানুষ। প্রাচিন কালে এ চিটি দূত মারফত কেবলমাত্র রাজস্বের সংবাদ আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহ্রত হতো। সেই সময় কবুতরের মাধ্যমে রাজকীয় পত্র পরিবহনের নিদর্শনও দেখা যায়। খৃষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে পত্র যোগাযোগের ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। সে সময় রানার ও পায়রার মাধ্যমে ডাক বহন করা হতো। ষোড়শ শতাব্দীতে শেরশাহ বিখ্যাত ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেছিলেন। জমিদাররাও বাহকের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করত। পরবর্তী সময়ে রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার পর চিঠিপত্র, তথ্য ডাক আদান-প্রদান আরও গতিশীল হয়। ব্রিটিশ শাসনামলের প্রারম্ভে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে ডাক আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। পরে রেল যোগাযোগের যাত্রা শুরু হলে দূরত্বকে পরাজিত করে ডাক চলাচল গতিশীল হয়।
শুরুতে চিঠি ছিল রাষ্ট্রীয় বার্তা সঞ্চালনের মাধ্যম, ডাকব্যবস্থা প্রচলনের উদ্দেশ্য তা-ই ছিল। পরে তা পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত যোগাযোগের নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে ওঠে। প্রণয়ের সম্পর্ক বিস্থারেও এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ডাক বিভাগের মাধ্যমে এখনো চিঠিপত্র চালাচালি হয় সরকারি বা বেসরকারি দাপ্তরিক কাজের প্রয়োজনে।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগের প্রধান পরিসেবাসমূহ ছিল আন্তর্জাতিক ডাক দ্রব্যাদি গ্রহণ, পরিবহন ও বিলিকরণ, রেজিস্ট্রেশন সেবা, ভিপি সেবা, বীমা সেবা, পার্সেল সেবা, বুক পোস্ট, রেজিস্টার্ড সংবাদপত্র, মানি অর্ডার সেবা, এক্সপ্রেস সেবা ই-পোস্ট এবং ইন্টেল পোস্ট ইত্যাদি। ডাক বিভাগ এখন মূলত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস আদেশ, ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির দাপ্তরিক চিঠি লেনদেন করে।
বাংলাদেশের বাংলাদেশে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়- ২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৭২। ডিজাইনার ছিলেন- বিমান মল্লিক। তখন ডাকটিকিটে ছবি ছিল- বাংলাদেশের মানচিত্র। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশিত ডাকটিকিটে ছিল- আগুনের ফুলকি। বাংলাদেশে পোস্ট কোড চালু হয়- ১৯৮৬ সালে। ডাক বিভাগের মনোগ্রাম হলো- একজন ধাবমান রানারের কাঁধে চিঠির ব্যাগ ঝোলানো, হাতে একটা বল্লম, মাথায় প্রজ্বলিত লণ্ঠন।
যুক্তরাজ্যে কিন্তু এখনও গুরুত্বপূর্নভাবে ডাক বিভাগ চালু আছে। এটাকে বলা হয়, ‘রয়েল মেইল’। ১৫১৬ সালে ব্রিটিশ রাজা অষ্টম হেনরির রাজত্বকালে এ ব্যবস্থাটি চালু হয়। এরপর রাজা হেনরি সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘মাস্টার অব দ্য পোস্ট’। ১৭১০ সালে এর নামকরণ করা হয় ‘পোস্ট মাস্টার জেনারেল’। রয়েল মেইল সার্ভিস জনগণের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৬৩৫ সালে। ১৮৪০ সালে রয়েল মেইলের পোস্ট মাস্টারদের প্রথম ইউনিফর্ম চালু হয়। প্রথম ডাকবাক্স চালু হয় ১৮৫২ সালে। রাস্তার পাশের অলিগলিতে তখন বসানো হয় পিলার পোস্টবক্স এবং দেয়ালবক্স। রয়েল মেইল পোস্ট-সার্ভিসের সাথে কুরিয়ার সার্ভিস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাছাড়া চিঠি ও পার্সেলের আকার ও ওজনের উপর ভিত্তি করে চার্জ বা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। সেবার উপর ভিত্তি করেও মূল্য নির্ধারণ করা হয়।
ইংল্যান্ডের ভেতরে ডাকসেবা পাঁচ ভাগে বিভক্ত। যেমন- রয়েল মেইল স্পেশাল ডেলিভারি, রয়েল মেইল সাইন ফর ফার্স্ট ক্লাস, রয়েল মেইল সাইন ফর সেকেন্ড ক্লাস, ফার্স্ট ক্লাস মেইল ও সেকেন্ড ক্লাস মেইল। এছাড়া আন্তর্জাতিক পোস্ট সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে, ইন্টারন্যাশানাল ট্র্যাক, সাইন, স্ট্যার্ন্ডাড ও ইকনোমি সেবা। তবে পোস্ট সার্ভিসের মতো পার্সেল সার্ভিসেরও বিভিন্ন ভাগ রয়েছে। যেমন- গ্রান্টেড, সাইন ও স্ট্যার্ন্ডাড সার্ভিস। তবে ব্যক্তি মালিকানাধীন অন্যান্য কার্গো ও পোস্ট সার্ভিসের
তুলনায় রয়েল মেইল সার্ভিস খুব ভাল সেবা দিয়ে যাচ্ছে। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com