জীবনের কথা, পর্ব-৩৮
ব্রিটিশদের ‘লাল পাগড়ি’ ওয়ালা পুলিশের কথা এখনও মানুষ স্মরণ করে
:: মো. রহমত আলী ::
আমার বয়স যাই হোক না কেন সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম সেই ১৯৭২ সাল থেকে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। এরপর দেশে ফিরে এসে লেখালেখি শুরু করি। যা এখন পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। হয়তো খুব নামি-দামি কিছু হতে পারিনি। তবে এ প্রায় অর্ধশত বছরে বিভিন্ন সময়ে নানা ঘটনার স্বাক্ষি হয়েছি। তার মধ্যে অনেকটা প্রত্যক্ষভাবে আবার অনেকটা পরোক্ষভাবে। এগুলির মধ্যে রয়েছে জনপ্রতিনিধি, প্রশাসন বা সমাজের অন্যান্য স্থরের মানুষের সাথে সম্পর্কিত।
তখন আমি কলেজে লেখাপড়া করি। আমার এক সহপাঠির ভাই ছিলেন একটি থানার ওসি। তাই সেই সহপাঠি একদিন আমাকে তার ভাই যে থানায় কাজ করেন সেখানে নিয়ে গেল। সেই এলাকাটি দূরে হওয়ায় আমাদেরকে রাত্রি যাপন করতে হয় সেখানে। খাওয়া-দাওয়ার পর রাত্রে শুয়ে পড়েছি। রাত আনুমানিক ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে হঠাৎ শুনতে পেলাম ওসি সাহেবের সাথে একজন লোক ফিস ফিস করে কি বলছে। আমি সাংবাদিকতা পেশার সাথে যুক্ত থাকার কারণে এ ধরণের কোন কৌতুহলী ঘটনায় অনিসন্ধিৎসু ভাব থাকতো একটু বেশী। তাই কান পেতে তা শুনতে লাগলাম। লোকটি বলছিল, ‘ওসি সাহেব খুব বিপদে পড়ে গেছি, টাকা এক হাজার না হলেই নয়। যে কোনভাবে হউক এই টাকা এক হাজার আমাকে দিতেই হবে। আমি এটা আগের গুলির সাথে একসাথে ফিরিয়ে দেব’।
আমি এ কথাটি শুনার পর প্রথমতঃ আমার মনে হলো যে, সে একজন পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে টাকা ধার নিচ্ছে, যেটি সাধারনতঃ হওয়ার কথা নয়। অন্যটি হলো, সে পূর্বে আরও নিয়েছে। তাই সে এভাবে নিয়মিত ধারকর্জ্জ নিয়ে থাকে। এমতাবস্থায় সেই লোকটির পরিচয় কি তা জানার আগ্রহ আমার জাগে। তাই পরের দিন সকালে সে লোকটির পরিচয় জানতে চাই বড় ভাই পুলিশ অফিসারের কাছে। প্রথমে তিনি তা এড়িয়ে গেলেও পরের তার অন্তরের ক্ষোভ ধরে রাখতে পারেন নি।
তিনি তখন বললেন, ‘দেখো তোমরাতো আমার নিজের লোক, তাই বলতে অসুবিধা নেই। অন্যেরা যে যাই করুক না কেন, ঘুষের ব্যাপারে পুলিশ বা ওসিদের উপরই শুধু দোষ চাঁপানো হয়। কালকে যে লোকটি এসেছিল সে হলো এ থানার ক্ষমতাসীন (তৎকালীন) দলের সেক্রেটারী। তাই প্রায় সময়ই তার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমার কাছে ধার কর্জের কথা বলে। না দিলে ‘বদলী’ করে দেয়া হবে অথবা ‘খাগড়াছড়ি’ বা ‘বান্দরবন’ পাঠিয়ে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয়। শুধু তাই নয়, প্রতি মাসেই তাদের নানা সভা-সমাবেশের সময়ও তারা চাঁদা দাবী করে বসে।
এ ব্যাপারে তিনি তখন আরো একটি বিষয়ের কথা বলেছিলেন। সেটা অবশ্য তার নিজের পুলিশ বিভাগ সম্পর্কিত। তিনি জানালেন, থানায় যখন পুলিশের কোন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আসেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের জন্যে দান দক্ষিনার ব্যবস্থা করতে হয়। তবে এটা একটা রেওয়াজ হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ তা নিতে চান না। শুধু তাই নয়, সেই অফিসারের গাড়ীর ড্রাইবারের “তেল খরচ” এর নামেও কিছু করতে হয়। তবে সেটা সংশ্লিষ্ট থানার অন্য অফিসারগন বহন করে থাকেন বলে জানান তিনি ।
এখানেই শেষ নয়, স্থানীয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক অথবা অন্যান্য সভা-সমাবেশ হলেও সেখানে তাদের চাঁদার নামে অনুদান দিতে হয়। আবার অনেকে যারা লেখালেখি করেন তাদের মধ্যেও কেউ কেউ একটা প্রচ্ছন্ন ভাব দেখান যে, না হলে তারা লিখে দিবেন। এভাবেই ওসি সাহেবরা তাদের নির্ধারিত কাজের বাইরে অনেক কিছু মোকাবেলা করে চলতে হয়।
সে যাই হউক, পুলিশ তাদের নির্ধারিত কাজের মধ্যে সংশ্লিস্ট এলাকার চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সমাজ বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধসহ বিভিন্ন জনসভা, নির্বাচনী দায়িত্বে অংশগ্রহণ করে থাকে। থানা হাজতে আসামীর মৃত্যূ হলে বিষয়টি জেনারেল ডাইরীতে লিখে রাখতে হয়। বিষয়টি ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশ সুপারকে দ্রæত টেলিফোন বা বেতারযোগে জানাতে হয়। পুলিশ অফিসার বাদী হয়ে অপমৃত্যু মামলা দায়ের করতে হয় এবং তদন্ত শুরু করতে হবে। মৃতদেহের অবস্থান একই রাখতে হবে নড়াচড়া করানো যাবেনা, তদন্তের সার্থে ছবি তুলে রাখতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট উপস্থিত হলে তার কাছে তদন্তভার সমজিয়ে দিতে হবে এবং সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুত করে নিতে হবে। মৃতের চালান ফরমে স্বাক্ষর নিতে হবে। চালান ফরম সহ মৃতদেহটি মর্গে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে মৃত্যুর সঠিক কারন নির্ণয়ের জন্য। তা ছাড়া মৃতের ময়না তদন্ত ও সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তার আত্মীয় স্বজনদের কাছে তা বুঝিয়া দিতে হবে, ইত্যাদি। এ সমস্ত কাজে সংশ্লিস্ট তদন্ত অফিসার ভ‚মিকা পালন করলেও সবকিছুতেই ওসি সাহেবদের ভ‚মিকা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু এই পদটি এতকিছু মোকাবিলা করার পরও কি শুধু ‘ভারপ্রাপ্ত’ হিসাবেই ব্রিটিশ আমল থেকে দায়িত্ব পালন করে যাবে, কখনও কি ভারমুক্ত হবে না! আমার মনে হয় যেখান থেকে এ পদের সৃস্টি হয়েছিল সেখানেও এ ধরনের কোন পদের অস্তিত্ব এখন আর নেই।
আমরা একসময় ব্রিটিশদের অধিনে ছিলাম। সেখানে শিল্প বিপ্লবের সময় ইংল্যান্ডের সামাজিক ব্যবস্থায় অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে স্যার রবার্ট পিল একটি নিয়মতান্ত্রিক বাহিনীর অভাব অনুভব করেন। এর ফলে ১৮২৯ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে পুলিশ বাহিনী গঠনের বিল আনেন। এর প্রেক্ষতে গঠিত হয় লন্ডন মেট্রো পুলিশ। ১৮৫৬ সালে ভারত শাসনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিকট থেকে ব্রিটিশ সরকার গ্রহন করে। এরপর ভারতের প্রতিটি প্রদেশে একটি করে পুলিশ বাহিনী গঠিত হয়। প্রদেশ পুলিশ প্রধান হিসাবে একজন ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ’ এবং জেলা পুলিশ প্রধান হিসাবে ‘সুপারিন্টেনটেন্ড অব পুলিশ’ পদ সৃষ্টি করা হয়।
১৮৯৮ সালে প্রণীত ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ৪(ত) ধারা মোতাবেক একটি থানার নিয়োজিত পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসারকে ‘ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’, ওসি বা ‘অফিসার ইনচার্জ’ বলা হয়ে থাকে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছুটিতে, অসুস্থতায় বা অন্য কোন কারণে অনুপস্থিত থাকলে ‘এস আই’ পদের পুলিশ অফিসার থানার ‘ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’র দায়িত্ব পান। এস আই পদের কোন পুলিশ অফিসার থানায় উপস্থিত না থাকলে পর্যায়ক্রমে ‘এ এস আই’ এ দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
পুলিশ বাহিনী চুরি-ডাকাতি রোধ, ছিনতাই প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদি সমাজ বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধসহ বিভিন্ন জনসভা, নির্বাচনী দায়িত্বে অংশগ্রহণ করে থাকে। ভারতবর্ষে পুলিশের আগমন ১৮২০ থেকে ১৮৪০-এর মধ্যে। পুলিশ সেপাইদের মাথায় তখন ছিল তকমা আঁটা ‘লাল পাগড়ি’। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ এখনও লাল পাগড়িওয়ালা পুলিশের কথা বলে থাকেন। তবে সে সময়ে কেউ একদিকে তাদের ধারে কাছেও যাওয়ার সাহস করতো না অন্য দিকে তাদের কথা শুনলে মানুষ খুব ভয় পেত।
লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রাক্তন কমিশনার স্যার, রবার্ট মার্কের ভাষায়, পুলিশ সমাজিক আচরণের উৎকৃষ্ট প্রতিফলন। সমাজ যদি উচ্ছৃঙ্খল হয়, পুলিশও উচ্ছৃঙ্খল হবে; সমাজ যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, পুলিশও দুর্নীতিগ্রস্ত হবে। অন্য দিকে, সমাজ যদি সহনশীল, শিক্ষিত ও মানবিক আচরণে অভ্যস্ত হয়, পুলিশও একই রকম সহনশীল ও মানবিক আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।
পরিশেষে আজকের লেখায় আমার পক্ষ থেকে একটি বার্তা দিতে চাই যে, এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে শনিবার ও রবিবারে আমার কলামটি লিখে যাব। এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য থাকলে এ লেখার সাথে যুক্ত আমার ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন। ধন্যবাদ। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com