পাগলি
:: কাজী শাহেদ বিন জাফর ::
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পাগলিটার নোংরা শরীর ও ময়লাটে কামিজ,এও আবার ছেড়া। ইজ্জত আব্রুটা কোনো মতে ঢাকা ছিল। মাথার চুল গুলোও এলোমেলো এবং জটানো। মনে হয়, বছর খানেক হয় তেল সাবান তার গায়ে ও মাথার চুলে চরব্যবহার হয়নি। কারোর সাথে কোনো কথাও বলেনা। নির্বাক দৃষ্টিতে শুধুই মাদরাসায় যাওয়া আসার পথে বাচ্চাদের প্রতি তাকিয়ে থাকে। তথাপি এ পাগলিটা আাবার আরো ৫/১০ পাগলের চেয়েও আলাদা।
তাকে দেখলেই মনে হয়, হারিয়ে যাওয়া কী যেন
খুজে বেড়ায়। এই পাগলিটা কাউকে আক্রামন করেনা, বলেনা কোনো অশালীন কথাবার্তা ও কোনো প্রকার গালিগালাজ। এমনকি নিজে নিজে কোনো প্রকার বকবকানিও করেনা। সায়েফ মাদরাসার চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। সে প্রতিদিন তার মায়ের ভাড়াকরা রিক্সায় নিয়মিত মাদ্রাসায় আসা যাওয়া করে।
একদিন সায়েফ দেখে, এক পাগলি মাদরাসা হতে আসার পথে, ঠিক রাস্তার মুড়ে আবর্জনার স্তোপের এক পাশে এলোমেলো করে ফেলানো খাবারের প্যাগেট হতে, উচ্ছিষ্ট খাবারগুলো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আর সায়েফের দিকে স্থির দৃষ্টিতে ফেল ফেল করে তাকিয়ে দেখছিল। এতে সায়েফ কিছুটা ভয় পেলেও রিক্সা চালক অভয় দিয়ে আমোদ প্রিয় কথা বার্তা পাগলদের নিয়ে বললে, সায়েফের অনেকটা ভয় কাটিয়ে হাসতে শুরু করে। এ অবস্থায় চালক রিক্সা চালিয়ে তার বাসার সামনের গেইটে এসে দাড়ায়। সায়েফ রিক্সা হতে নেমে হাসতে হাসতে ঘরের সিড়ি বেয়ে উপরে দিকে উঠে। তার কামড়ায় পৌছতে না পৌছতেই তার মা “মোহিমা বেগম” এর সাথে দেখা হয়। মা তৎক্ষনাত সায়েফের হাত ধরে জিজ্ঞেস করলেন।
কী এত হাসাহাসি কিসের জন্য হচ্ছে? পথে কোনো দুষ্টামি তুষ্টামি হচ্ছে নাকি?
সায়েফ তার মাকে বলল আরেনা মা, এসব
পরে বলছি! আগে কাঁধের বোঝাটা সরাও! এতো সব বই খাতা, টিপিন বক্স ও পানির বোতল। সবে মিলে সায়েফের ওজনের চেয়ে কম নয়।
তখন মা আল্ত করে এত সব সরিয়ে টেবিলের উপরে নিয়ে রাখলেন। আর সায়েফকে টেনে আদর দিয়ে কোলে বসিয়ে হাসার কারনটা জানতে চাইলেন।
সায়েফ তখন পাগলিটার বিস্তর বর্ণনা দিল। মা মোহিমা বেগম, সায়েফের কথা শুনে
সায়েফকে বলেন। তুমি কী পাগলিকে কোনো ঢিলটিল মেরেছ। পাগলির সাথে কোনো রকম দুষ্টামি তুষ্টামি করেছ?
সায়েফ বলে না মা! আমি পাগলিকে ঢিল মারতে যাবো কেন? পাগলি তো আমার সাথে কোনো খারাপ আচরন করেনি এমন কী কোনো কথাও বলেনি। আমি অযথা পাগলিকে ঢিল মারতে যাবো কেন? পাগলি শুধু আমার দিকে চলন্ত রিক্সায় তাকিয়ে দেখছিল। তখন আমি খানিকটা ভয় পেলেও, ড্রাইভার কাকু আমাকে অভয় দিয়ে পাগলদের নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প বলে বলে নিয়ে আসলেন। তাই আমি হাসতে ছিলাম।
মা সায়েফের কথা শুনে বলেনঃ
ভালো কথা, পাগলদের নিয়ে এভাবে হাসাহাসি করতে নেই বাজান। পাগল তো মানুষ এমনি এমনি হয়না। পাগল হওয়ার মধ্যেও একটানা একটা কারন নিশ্চয়ই থাকে। তাই কোথাও পাগল দেখলে, তার সাথে তামাশায় লিপ্ত হতে নেই বা কোনে প্রকার ঢিল টিল ছোঁড়তে নেই। এমন কী কুকুর বিড়াল সহ কোনো প্রকার পশুপাখির উপরও। হয়তোবা ওদের উপরে না পরে যদি ঐ ঢিলটা কোনো মানুষের উপরে গিয়ে পরে। তখন বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে বাবা। তাই কখনো কোথাও ঢিলটিল মারতে যেওনা, সোনা আমার। এ পযর্ন্ত মা সায়েফকে বুঝিয়ে বলে ছেলের গালে মুখে চুমু খেয়ে খাবার টেবিলে সামনে চেয়ারে বসিয়ে খাবার খেতে দিলেন। পর দিন যথা নিয়মে সায়েফ তার মায়ের ভাড়াকরা রিক্সায়, মাদরাসায় যাওয়ার পথে রাস্তার সেই মোড়ে যেতেনা যেতেই সায়েফ দেখতে পেলো, অনেক মানুষের জটলা। ঠিক জটলার মধ্য হতে সায়েফের কানে আসলো মেয়েলী কন্ঠে কান্নার আওয়াজ। তখন সাথে সাথে সায়েফ রিক্সার চালকে রিক্সা থামাতে বলে। চালক রিক্সা থামিয়ে নিলে, সায়েফ চট করে রিক্সা হতে নেমে জটলায় ডুকে দেখল রাস্তার মুড়ে দাড়িয়ে থাকা সেই পাগলিকে দল বেঁধে মারা হচ্ছে। আর পাগলি মারের আঘাতে চিৎকার করে কাঁদছে। আর ওমাগো! ওআল্লাহ গো!, বলে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বাচাও! বাচাও! বলে কাঁদছিল। তৎক্ষনাত সায়েফ জটলার খানিক দুরে এসে তার মাকে কান্না সিক্ত ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় তার মাকে মোঠো ফোনে বলল।
মা তুমি এখোনি রাস্তার মোড়ে চলে এসো। দল বেঁধে সেই পাগলিকে মারা হচ্ছে মা! তুমি না এলে ওরা পাগলিকে মেরেই ফেলবে ওরা, মা! মাগোঁ তুমি চট এখানে এসো মা। ছেলের কাঁন্না সিক্ত এ আবদার শুনা মাত্রই, মা মোহিমা বেগম, সাথে সাথে একটা রিক্সা নিয়ে রাস্তার মুড়ে চলে আসেন। রিক্সা হতে চট করে নেমে জটলায় ডুকে চিৎকার করে বলে উঠলেন। একি হচ্ছে! থামুন আপনারা কন একটা নিরিহ পাগলিকে এই ভাবে পিটাচ্ছেন? বন্ধ করুন যতসব। উত্তরে সবাই সম সুরে বলে উঠল। এই পাগলি নাকি বাচ্চা চুরি করেছে। তখন মোহিমা বেগম আরেটা চিৎকার দিয়ে বলেন, খামুশ………! সে যদি পাগল হয়ে থাকে, তবে বাচ্চা চুরি করে কী ভাবে। যত সব আজগুবি আলতুপালতু গুজব ছড়ানো কথা। বন্ধ করো যতসব নির্বোধের দল। এই কথা বলে মোহিমা বেগম, মাটিতে ফেলানো গুমরিয়ে শায়িতা পাগলিকে হাত ধরে টেনে জটলার ভেতর হতে বাহিরে নিয়ে আসেন। পরে পার্শ্বস্থ পুকুরে নামিয়ে নিজ হাতে পাগলিকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে, স্থানীয় বাজারের এক কাপড়ের দোকানে নিয়ে বসালেন। এবং দোকানির নিকট হতে এক সেট নুতন ত্রি- পিছ কাপড় কিনে পাগলিকে পড়িয়ে দেন।
তার পর মাতৃ স্নেহে পাগলির মাথায় হাত বুলিয়ে
জিজ্ঞেস করলেন। আচ্ছা মা বলতো, তুমি কী সত্যি বাচ্চা চুরি করেছ। আর কেনই বা এই কাজ করতে গেলে ?
উত্তরে পাগলি বলল, আমি বাচ্চা চুরি করিনি মা! আর বাচ্চার শুকেই আজ আমার এ মরণ দশা। বলে পাগলিটা আবার হুহু করে কাঁদন শুরু করে দেয়। মোহিমা বেগম পাগলির শান্তনায় পিটে মাথায় হাত বোলিয়ে মৃদু সুরে বলেন কেদনা মা! তৎক্ষনাত পাগলি কান্না থামিয়ে বলে। আমি মাদরাসার রাস্তার ঐ মোড়ে দাড়ানো ছিলাম। তখন দেখি পাশের বাসার গেইট দিয়ে এক বাচ্চা পটেটোর প্যাগেট হাতে নিয়ে খেতে খেতে বেড় হয়। তখন রাস্তায় দু’টি কুকুর বাচ্চাটার পটেটোর প্যাগেটে নজর দিলে, বাচ্চাটি প্রানের ভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে দৌড়াতে শুরু করে। এ সময় রাস্তায় কোনো লোকজন ছিলনা। বাচ্চাটা দৌড়তে দৌড়তে এক পর্যায়ে রাস্তার খাদে পানিতে পরে যায়। তখন আমি দেখা মাত্রই, পানিতে ঝাপ দিয়ে বাচ্চাটাকে তুলে কোলে আনি। অন্যতায় মারাই যেত। এই হলো আমার অপরাধ মা। বাচ্চাটা তুলে আনার পর আমার কোলে দেখা মাত্রই আমাকে সবে মিলে এক জুট হয়ে মারতে লাগল। সবাই কে কতো হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করলাম, কিন্তু রেহাই ফেলামনা মা। কেহই আমার কথা বুঝতে চাইলনা যে আমার অপরাধটা কী। দেখেন আমার সারা শরীর ক্ষত বিক্ষত করে ফেলেছে ওরা। তুমি না আসলে আমাকে মেরেই ফেলত মা। পাগলির এহেন বক্তব্য শুনে মোহিমা বেগম উপস্তিত সবার উদ্যেশ্যে চিৎকার করে বলে উঠেন, এসব কি শুনলেন আপনারা। একটু কান্ড জ্ঞান নেই আপনাদের। কোনো কিছু বুঝার আগেই এই নিরিহ পাগল মেয়েটাকে নির্মম ভাবে মারলেন। অথচ এই পাগল মেয়েটা একটি জলে ডুবা বাচ্চাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাল।
তোমাদের বুঝ শক্তি কবে পিরে আসবে বলুন আমাকে? একথা শুনা মাত্রই সবাই লজ্জায় দুরবিদুর হয়ে গেল।
পরে মোহিমা বেগম আবার পাগলিকে জিজ্ঞেস করলেন। বলতো মা! তোমার পাগল বা এই অবস্থা হবার কারণটা কি? পাগলি বলে মা ডাক জীবনে শুনিনি মা, আজ তোমার মুখে প্রথম শুনলাম। স্মৃতি হারা পাগলি তার আস্তে আস্তে স্মরণ করে বুঝাতে চাইল ৭১- এর সংগ্রামের সময় সে নব বিবাহিতা। রাজাকাররা তার স্বামীকে হানার বাহিনীর হাতে তুলে দিলে পাকিস্তানি হানাদাররা তার স্বামীকে গোলি করে মেরে ফেলে। পরদিন আবার ঐ গ্রামে হানাদার বাহিনী আসলে জান ও ইজ্জতের ভয়ে নব জাতক শিশুটি বিচানায় বালিশে ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় বালিশ সহ শিশু বাচ্চাকে বুক চেপে তুলে নিয়ে পালিয়ে যাই। কয়েক মাইল পথ অতিক্রক করে, এক নিবৃত স্থানে গিয়ে আশ্রয় নেই। তখন রাত প্রায় সন্ধা সাত হবে। বুক চাপা বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানোর ইচ্ছায় বালিশ আলগে দেখি শুধু বালিশটাই বুকে চাপা রয়েছে, অথচ শিশু বাচ্চাটি কোলে নেই। একথা শুনে মোহিমা বেগমের গাল বুক গড়িয়ে দু’ চোখের পানি ঝড়তে লাগলো। এদিকে পাগলি ও উঠে দাড়াল, তারপর হাটতে শুরু করল। হাটতে হাটতে রাতের অন্ধকার আঁধারে মিশিয়ে গেলো।
লেখক: কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক।