জীবনের কথা, পর্ব-৩৯
তখন নাইটস্কুলে যারা পড়তেন তাদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ পরিলক্ষিত হতো
:: মো. রহমত আলী ::
দেশে একবার বয়স্ক শিক্ষা বা উপআনুষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্র চালু হয়েছিল। তারও আগে ছিল ‘নাইটস্কুল‘। সরকারের পক্ষ থেকে এ দু’টি উদ্যোগের বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল, যারা ছোটবেলায় বিভিন্ন কারণে লেখাপড়া করতে পারেন নি তারাই মূলত এগুলিতে এসে লেখাপড়া করবে। যার ফলে দেশের স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাবে। এগুলি সাধারণত স্থানীয় প্রাইমারী স্কুল, হাইস্কুল, মক্তব, ক্লাব বা ক্ষেত্র বিশেষে চেয়ারম্যান, মেম্বার এর বৈঠকখানায় অনুষ্ঠিত হতো। এতে শিক্ষা দিতেন প্রাইমারী স্কুল, মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমামগণ অথবা এলাকার শিক্ষিত লোকগণ। এটা ছিল অনেকটা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে। তবে বইপত্র সরকারীভাবে সরবরাহ করা হতো। তবে যারা পড়তে আসতেন তাদের কোন কোন সময় সরকারী ত্রাণ সামগ্রি বিতরণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার প্রদান করা হতো। সকলের সুবিধার জন্য তা সন্ধ্যার পর অনুষ্ঠিত হতো। যে কারণে এটাকে ‘নাইটস্কুল‘ হিসাবে উল্লেখ করতেন যদিও বিভিন্ন সময় এর নাম বিভিন্নভাবে হয়েছে।
আমি তখন আমার স্থানীয় হাইস্কুলে শিক্ষকতা করি। তাই বয়স্ক শিক্ষার ব্যাপারে কোন প্রশিক্ষণ না নিয়েই সেই সমস্ত স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হই। কারণ আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল স্থানীয় সবার মধ্যে। তাই আমার বয়সে যারা বড় তারাও বেশ সমিহ করতেন। আমার স্মরণ আছে, প্রথম দিন যখন ক্লাশ শুরু করি তখন দেখলাম বয়স্কদের কেউ কেউ বেঞ্চে বসে সিগারেট পান করছেন। সাথে সাথে গল্প-গোজবও করছেন। কেউ আসছেন আবার কেউ চলে যাচ্ছেন। সাথে সাথে উপস্থিতির নাম ডাকলেও তারা তেমন সাড়া দিচ্ছেন না। মানে একটা ফ্রি স্টাইল ভাব।
এমতাবস্থায় পরের দিন ক্লাশ শুরু করার আগে এ ব্যাপারে প্রথমেই এ বিষয়টি নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা করলাম। তখন সবাই এক বাক্যে স্বীকার করলেন যে, যা হয়েছে তা ঠিক নয় এবং ভবিষ্যতে আর এটা হবে না।
এর পরে খুব সুশৃঙ্খলভাবে ক্লাশ চলতো। তবে তাদের বিভিন্ন প্রশ্ন শুনে মাঝে মধ্যে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হতো। আসলে এ সমস্ত উত্তর দেয়ার মত ব্যাকরণও ছিল বলে আমার জানা ছিল না। যেমন, আমার এক আপন মামা যিনি বয়সের দিক থেকে আমার মায়েরও বড় তিনি ‘স্কুল’ বানান নিয়ে প্রশ্ন উত্তাপন করলেন। তার মতে যেহেতু এ যুক্ত অক্ষরটির ডানে-বামে জায়গা আছে সুতরাং এটাকে এক সাথে না লিখে সবটিকে আলাদা আলাদা করে লিখতে অসুবিধা কোথায়? । অর্থাৎ তার কথায় এটা ‘ইসকুল’ লিখতে হবে। আমি তখন এর উচ্চারণ এবং অন্যান্য কারণে এভাবে লেখা প্রয়োজন বলে জানালাম। কিন্তু দেখা গেল আমার সাথে একমত না হয়ে তারা সবাই তিনিকে সমর্থন জানালেন। আমি তখন এ ব্যাপারে পরে কথা হবে জানিয়ে অন্য বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। সে ধরণের স্কুলগুলিতে কিন্তু শিশুদের যেভাবে বর্ণমালা শিক্ষা দিয়ে শুরু করা হয় সে ধরণের নিয়ম ছিল না। এখানে সাংক্ষেতিক চিহ্ন ব্যবহার করে বর্ণ শিক্ষা দেয়া হতো। যেমন, লতার মত ‘‘ল” তালের মত “ত” পাতার মত “প” ইত্যাদি। এখানেও অনেক জটিলতা ছিল। যারা একটু বর্ণমালা চিনতেন তারা এগুলোকে পাত্তা দিতেন না। তারা বলতেন, বর্ণ তো বর্ণই । এখানে আবার লতা-পাতা কেন। আমি বলতাম এগুলি স্মরণ রাখার জন্য সংকেত হিসাবে তা দেয়া হয়েছে।
শুধু বাংলা নয় অংকের ব্যাপারেও তখন নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয় আমাকে। যেমন, দুটি সংখ্যা যোগ করার সময় যদি তা ‘দশ’ এর উপরে হয়ে যায় তখন আমরা ডান দিকেরটা বসাই। আর বাম দিকেরটা না বসিয়ে বলি ‘হাতে থাকলো‘ এত। কিন্তু তাদের প্রশ্ন এটা হাতে থাকবে কেন। তা বসিয়ে দিলেইতো হলো। বিয়োগ অংকের বেলায়ও তাই। আমরা যেমন বলি ‘দশ’ থেকে ‘চার’ গেলে বাকী রইল ‘ছয়’। তাদের কথায় দশ থেকে চার গেলে না বলে, ‘দশ’ থেকে ‘চার’ নাই বলতে হবে। ‘গেলে‘ শব্দটিকে তারা কোথাও চলে যাওয়ার সাথে তুলনা করেন। গুণ অংকের ব্যাপারেও তাদের ভিন্ন চিন্তা। তাদের মতে ‘দুই’ একে ‘দুই’ দুই হবে কেন। দুই আর একে তো তিন হওয়ার কথা। এভাবে একের কোটার নামতাকে তারা ‘বেহুদা’ মনে করেন।
যে যাই হউক, এ বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র থেকে কেউ কেউ তাদের নাম ঠিকানা এমনকি অনেক প্রয়োজনীয় বস্তুর নাম পর্যন্ত শিখতে পেরেছিলেন। যা তাদের প্রত্যাহিক জীবনে কাজে লেগেছে। কেউ কেউ চিঠিপত্র লেখা বা পড়ার প্রচেষ্ঠাও চালাতেন। আসলে তারা তখন শিক্ষা যে অমূল্য সম্পদ তা অনুভব করতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ যাদের চোঁখ নেই তারা যেভাবে চুখের মূল্য বুঝে সেভাবেই তারা বিদ্যা শিক্ষাকে বুঝেছিলেন। তাই আফসোস করতেন ছোটবেলা কেন হেলায় সে সূযোগ হারিয়েছেন।
এ ব্যবস্থায় প্রথম প্রাথমিকভাবে যারা অক্ষর চেনেন না তাদের অক্ষর পরিচিতি ও নাম লেখা শেখানো হতো। দ্বিতীয় পর্যায়ে যারা অক্ষর চেনেন এবং কোনো মতে নাম লিখতে পারেন তাদের নাম-ঠিকানা, বার ও মাসের নাম শেখানো হয়। আর তৃতীয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের চিঠি লেখা, পত্রিকা পড়া এবং যোগ-বিয়োগসহ প্রাথমিক হিসাব যেন করতে পারে তা শেখানো হতো।
দেশ স্বাধিন হওয়ার পর নিরক্ষরতা দূর করতে সত্তরের দশকে শুরু হয় গণশিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। সেসময় এ প্রকল্প ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। দেশে সাক্ষরতার হার বাড়াতেও প্রভাব ফেলে এই কর্মসূচি। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে পরিচালিত শিক্ষাদান কার্যক্রম। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা মূলত দরিদ্র জনমানুষের শিক্ষাদান কার্যক্রম। এতে যে কোনো বয়সের নিরক্ষর মানুষকে অক্ষর, লেখাপাঠ, গণনা, হিসাব, মনের ভাব লিখন প্রভৃতি মৌলিক বিষয় শেখানো হয়। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীকে সমাজ, পরিবেশ ও দৈনন্দিন বিজ্ঞান সম্পর্কে জ্ঞান দান করা হয়ে থাকে। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা শুধু বিদ্যালয়ের পাঠবঞ্চিতদের জন্য নয়, যারা দারিদ্র্য ও অন্যান্য কারণে বিদ্যালয় ছাড়তে হয় তাদের জন্যও উন্মুক্ত।
ব্রিটিশযুগে ১৯১৮ সালে নৈশ বিদ্যালয়ে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে বাংলাদেশে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯২৬ সাল নাগাদ নৈশ বিদ্যালয়ের সংখ্যা কয়েক হাজার হয়ে যায়। ১৯৩৫ সালে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার এবং বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে পাড়া বা মহল্লাভিত্তিক সমিতি বয়স্ক শিক্ষা এবং সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা স¤প্রসারণের জন্য বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৩৯ সালে ফ্রাঙ্ক ল্যুবাক-এর ‘অন্ততঃ একজনকে লেখাপড়া শেখাবো’ আন্দোলন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক সরকার বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় পল্লী উন্নয়ন অধিদপ্তরকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৭-এর পর বিচ্ছিন্নভাবে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এ কার্যক্রম চালু করেন। ১৯৫৬ সালে এইচ জি এস বিভার-এর উদ্যোগে ঢাকায় ‘সাক্ষরতা কেন্দ্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষার উপকরণ হিসেবে একটি প্রথম পাঠ ও কিছু চার্ট তৈরি করে। সাক্ষরতা কেন্দ্রের সূত্র ধরে গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান বয়স্ক শিক্ষা সমবায় সমিতি। এটি বয়স্ক শিক্ষার জন্য ২৪টি বই রচনা ও প্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে ১২টি ছিল নব্য অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিদের পড়ার জন্য। ১৯৬২ সালে বিভারের মৃত্যুর পর বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। ১৯৬৩ সালে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী গণশিক্ষা পরিদপ্তরের পাইলট প্রকল্প হিসেবে একটি বয়স্ক শিক্ষা শাখা চালু করে। প্রকল্পটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অব্যাহত ছিল। তবে বর্তমানে কীভাবে আছে তা আমার জানা নেই। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com