জীবনের কথা, পর্ব-৪০
গাফফার চৌধুরী ভাষা শহীদ রফিক সালাম জব্বার বরকতকে চিনতেন না
:: মো. রহমত আলী ::
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী- আমি কি ভুলিতে পারি” এ কালজয়ী গানটি লিখেছেন প্রবিন সাংবাদিক ও কলামিস্ট আব্দুল গাফফার চৌধুরী। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। আমি যখন বৃটেনে প্রথম আসি তখন তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নেই। আমি তখন তাঁর কাছে সে সময়ের অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী সংগঠিত বিভিন্ন ঘটনার কথা জানতে চাই। তিনিও তা অত্যন্ত খোলামেলাভাবে বলে যান। আমি তখন তাঁর কাছে জানতে চাই যে, সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন তিনি তাদের পূর্বে চিনতেন কি না। তা ছাড়া কালজয়ী যে গানটি তিনি লিখেছেন সেটার প্রেক্ষাপটই বা কি ছিল। তিনি বলেন, যারা সেদিন ঢাকার রাজপথে গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন তিনি তাদের পূর্ব থেকে চিনতেন না বা তাদের কারো সাথে তার জানাশুনা ছিল না। পরে তিনি তাদের পরিচয় একে একে জানতে পারেন। তিনি এ সময় আরো উল্লেখ করেন যে, সে সময়ে তাঁর লেখা এ গানটিও ছিল একটি কবিতা মাত্র। পরে তা পরিমার্জিত হয়ে আজকের এই অবস্থানে এসেছে । গাফফার চৌধুরীর এ গানটি বর্তমানে হিন্দি, মালয়, ইংরেজী, সুইডিশ, জাপানীসহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়। ১৯৬৯ সালে জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে তা ব্যবহার করা হয়।
সাক্ষাৎকালে আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেন, তিনি সে সময় ছিলেন ঢাকা কলেজের ছাত্র। এ ঘটনার পর তিনি যখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান আহত ছাত্রদের দেখতে তখন তিনি সেখানে একটি লাশ দেখতে পান। এ লাশটি দেখে তার মনে হয় এটা যেন তাঁর আপন ভাইয়ের রক্তমাখা লাশ। তাই তৎক্ষনাতই তিনি আপন মনে গেয়ে উঠেন এ গানের প্রথম দ’ুটি লাইন। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি’। এর পরে কয়েকদিন ধরে এ গানটি লিখে তিনি শেষ করেন। গানটি এরপর বিভিন্ন লিফলেট ও সংকলনে কবিতা হিসাবে প্রকাশিত হয়। এ কবিতাটিকে গান হিসাবে প্রথম সুরারোপ করেন সুরকার আব্দুল লতিফ। ১৯৫৪ সালে সে সময়ের বিশিষ্ট সুরকার আলতাফ মাহমুদ এ গানটিতে পুনরায় সুরারোপ করেন। এরপর থেকেই প্রভাতফেরীতে এ গানটি গাওয়া শুরু হয়। তবে সে সময় অর্থাৎ পাকিস্তানী আমলে তা গাওয়া সম্ভব ছিল না। এ গান গাওয়ার অপরাধে ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়।
৫২ সালের এ দিনে যারা শহীদ হয়েছিলেন তারা কিন্তু সবাই বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ছাত্র ছিলেন না। তাদের মধ্যে কেউ দিন মজুর আবার কেউ পথচারী ছিলেন। আবার কেউ প্রাইমারী স্কুলের ছাত্রও ছিলেন। ছাত্রজনতা মিলেই সেদিন এর প্রতিবাদ করেছিলেন। তবে ছাত্র ছিলেন ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ। যার লাশ দেখে গানটি লেখা শুরু করেছিলেন গাফফার চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন বরকত। ছালাম ছিলেন অষ্ঠম শ্রেণীর ছাত্র। ঢাকার নবাবপুর রোডে গুলি প্রাণ হারিয়ে ছিলেন তিনি। তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন অহিউল্লা। তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। মিছিলে শ্লোগান দিতে গিয়ে শরীক হয়েছিলেন পথচারী দিন মজুর জব্বার। হাটু আর কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ঘোষনার প্রতিবাদেই এ হরতাল পালিত হয়েছিল। ঢাকায় তখন জারী করা হয় ১৪৪ ধারা আর এ প্রতিবাদ সর্বপ্রথম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ ছাত্র।
প্রথম কবিতাটি ছাপা হয় প্যামফ্লেট হিসেবে। বছরখানেক পর আতিকুল চৌধুরী কবিতাটি গনসংগীতের প্রখ্যাত শিল্পী আবদুল লতিফকে দিয়েছিলেন সুরারোপিত করে গান হিসেবে প্রচারের উদ্দেশ্যে। লতিফ সাহেব সুর দেন এবং ‘৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা কলেজের এক ছাত্র সমাবেশে প্রথম নিজ কন্ঠে তিনি গেয়েছিলেন। পরবর্তীতে আলতাফ মাহমুদ কবিতাটি কোথাও পড়ে তিনি আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাছে পুনরায় সুর করার অনুমতি চান। অনুমতি নেয়া হলে আমেরিকান প্রখ্যাত শিল্পী ন্যাট কিং কোলের ‘আইরিন গুড নাইট আইরিন’ গানের প্রথম পংক্তির সুর অবলম্বনে আলতাফ মাহমুদ সৃষ্টি করেন যেটি এখন গাওয়া হয়ে থাকে। তখন সুরের প্রয়োজনে কবিতার শেষ ছয় চরণ অবশ্য বাদ দেয়া হয়েছিলেন।
আবদুল গাফফার চৌধুরী ১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪ ইং বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম। শিক্ষা জীবনের শুরুতে গাফফার চৌধুরী স্থানীয় মাদরাসায় ৬ষ্ট মান পর্যন্ত লেখাপড়া করে পরবর্তীতে হাইস্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করেণ। ১৯৫৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন।
ছাত্র জীবনেই তার সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। ১৯৪৯ সালে সওগাত পত্রিকায় তার প্রথম গল্প ছাপা হয়। বিভিন্ন সময় তিনি কাজ করেছেন দেশের দৈনিক ইনসাফ, দৈনিক সংবাদ, মাসিক সওগাত, মাসিক নকিব, দৈনিক আযাদ ও ইত্তেফাকে। এছাড়া তিনি আরও অনেক পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে লেখালেখি করেন। লন্ডনেও সাংবাদিকতার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন দৈনিকে লিখে থাকেন। সাপ্তাহিক নতুন দিনের সাথেই তিনি দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন। সাপ্তাহিক জনমত, সাপ্তাহিক পত্রিকাসহ অন্যান্য পত্রিকায়ও লিখেন। তিনি একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারসহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
১৯৭৫ সালে তাঁর স্ত্রী সেলিমা আফরোজ চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আনুকূল্যে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে আসেন। এরপর দীর্ঘদিন চিকিৎসারত ছিলেন। ২০১২ সালের ১৯ ড়িসেম্বর সেলিমা আফরোজ চৌধুরী ৭১ বছর মারা যান। এরপর তাঁর মরদেহ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং বনানী শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। তাদের সংসারে ৪ মেয়ে ও ১ ছেলে রয়েছেন ।
গাফফার চৌধুরী বর্তমানে শারিরীকভাবে খুব বেশী সুস্থ নন।
আব্দুল গাফফার চৌধুরীর সাথে আমার অনেক স্মৃতি আছে। তাঁকে আমরা ‘গাফফার ভাই’ বলে ডাকি। লন্ডনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সাথে দেখা হয়। তখন তিনি নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন। অনেক সময় তিনি তাঁর নিজের ছেলে-মেয়েদের নিয়েও আলাপ করেন। আমরা জানতে চাই তারা বাংলা শিক্ষায় কতটুকু পারদর্শী। তিনি বলেন, চেষ্ঠা করেছেন কিন্তু এ যুক্তরাজ্যের সমাজ-সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তারা তেমন পারদর্শী নয়।
পরিশেষে তাঁর এক মেয়ের একটি কথার প্রসঙ্গ দিয়েই লেখা শেষ করতে চাই। অনেক সময় গাফফার ভাইয়ের কাছে অনেকে ফোন করে থাকেন। তিনি তখন চেষ্ঠা করেন তা রিসিভ করার। হয়তো অনেকদিন শারিরীক অসুস্থতার কারণে তা রিসিভ করতে পারেন না। একদিন তিনি ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। এমন সময় একটি টেলিফোন আসে। তখন তিনি তাঁর এক মেয়েকে বলেছিলেন যে, “তিনি ঘরে নেই ”এ কথা বলার জন্য। কিন্তু মেয়েটি উত্তর দেয়, সে এ ‘মিথ্যা কথাটি’ বলতে পারবে না। এই বলে সে ফোনের রিসিভারটি তাঁর কাছে এগিয়ে দেয়। তখন তিনি কিছুটা লজ্জা পেয়েছিলেন।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com