জীবনের কথা, পর্ব-৪১
বিশ্ব বরেণ্য কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে আমি
:: মো. রহমত আলী ::
আমি আগেই বলেছি যে, আমি তেমন কোন বড় ধরনের সাংবাদিক নই। আর সেটা কোন সময় দাবিও করি না। তবে বিগত প্রায় পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা জীবনে চলার পথে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক বরেন্য সাংবাদিকদের সংস্পর্শে আসার সূযোগ হয়েছে। আর আমি সেটাকে সৌভাগ্য হিসাবেই মনে করি। কারণ অন্য কোন পেশায় থাকলে তা সম্ভব হতো না। আজকে আমি যুক্তরাজ্যে অবস্থানকালীন কয়েকজন সাংবাদিকের সাথে আমার সাক্ষাতের প্রসঙ্গটি এখানে তুলে ধরছি।
একদিন লন্ডনের ব্রিকলেন জামে মসজিদ থেকে নামাজ শেষ করে বের হয়ে আসছিলাম। তখন দেখতে পেলাম একজন কালোবর্ণের লোকের চেহারা আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। আমি এগিয়ে গিয়ে তার পরিচয় জানার চেষ্ঠা করলাম। তখন জানতে পারলাম ইরাকের উপর মার্কিন হামলার সংবাদ পরিবেশনকারী সেই রাগেই ওমর হচ্ছেন তিনি। আমার তখন যে আনন্দ হয়েছিল তাতে মনে হয়েছিল যে, আকাশের চাঁদ যেন আমার হাতে ধরা দিয়েছে। কারণ এর আগে তাকে কেবল টিভির পর্দায় দেখেছি।
রাগেহ ওমর একজন সোমালি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক। তিনি এক সময় বিবিসির ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়াার্সের সংবাদদাতা হিসাবে ইরাক থেকে রিপোর্ট করে সুনাম অর্জন করেছিলেন। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে, তিনি আল জাজিরায় রাতের সাপ্তাহিক ডকুমেন্টারি সিরিজ উইটেনস-এ জানুয়ারি ২০১০ পর্যন্ত উপস্থাপন করেছিলেন। ২০১৭ থেকে আইটিভি নিউজ লন্ডন লাঞ্চ টাইম বুলেটিন এবং আইটিভির সান্ধ্য সংবাদ উপস্থাপন করেছেন। ওমর ইরাক আক্রমণের বিষয়টি কভার করে বিবিসি নিউজ বুলেটিন এবং বিবিসি নিউজের জন্য সপ্তাহিক অনুষ্ঠান করতেন। তাঁর অনেক সম্প্রচার পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে সিন্ডিকেট করা হয়েছিল, যেখানে তিনি স্কুড স্টাড হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। এরপর বিবিসি থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চান।
অন্য একদিন আমি ইস্ট লন্ডনের তৎকালীন মালিক শামসুদ্দিন শামস ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মন্নান ছুরাব আলী পরিচালিত ব্রিকলেনের কারী বাজার রেস্টুরেন্টে গেলে হঠাৎ সাক্ষাৎ হয় তৎকালীন বিবিসির নিউজ রিডার এর সাথে। পিটার সিজন এমন একজন সংবাদ পাঠক যিনি বৃটেনের বর্তমান রানী মারা গেলে তার সংবাদটি কিভাবে পড়া হবে এমন একটি প্রশিক্ষনে অংশ নিয়েছিলেন। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর সংবাদ ঘোষণার পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবেই এ প্রশিক্ষনে সংবাদ পাঠকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল। রানী এলিজাবেথের মা প্রথম এলিজাবেথ মারা যান ২০০২ সালে। তখন লাল রংয়ের টাই এবং ধূসর স্যুট পরে তার মৃত্যুর সেই সংবাদ পরিবেশন করেন বিবিসির এ সংবাদ পাঠক। ফলে বিবিসি তখন সমালোচনার মুখোমুখি হয়। তাই বিবিসি ২০০২ সালের মতো আর ঝুঁকি নিতে চাইছে না। এ প্রশিক্ষনের সময় ব্যবহারের জন্য ‘রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা গেছেন’ শিরোনামের একটি নকল ভিডিও ধারণ করা হয়। আর এ প্রশিক্ষনের আয়োজনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘কী চাওয়া হচ্ছে তা নিশ্চিত করার জন্যই তাদের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তারা।
লন্ডনে আমি একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। সেখানে দেখা হয় সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ মার্টিন বেল এর সাথে। ১৯৯৭ থেকে ২০০০ পর্যন্ত বৃটেনের একটি আসনের এমপি ছিলেন তিনি। নির্বাচনে দাঁড়ানোর কারণে তিনি তখন বিবিসি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। কারণ সাংবাদিকতা ও রাজনীতি একসাথে চলতে পারে না। এভাবে বৃটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রিও একসময় সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং রাজচনীতিতে আসার আগে পদত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু অনেক সময় আমরা দেখতে পাই অনেকে সাংবাদিকতা ও রাজনীতি একসাথে চালিয়ে যান। অর্থাৎ তারা ‘গাছেরটাও খেতে চান নীচেরটাও পেতে চান’। যেটা কোনভাবেই কাম্য নয়। যাই হোক মার্টিন বেল এর প্রার্থী হওয়ার কারণে এ আসনে লেবার পার্টি ও লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টির প্রার্থীরা তার স্বপক্ষে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন। তিনি এ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে অংশ নিয়েছিলেন। আর এটা ছিল সাংবাদিকদের আত্মমর্যাদার বিষয়। এরপর তিনি ইউনিসেফে বৃটেনের অ্যাম্বাসেডর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এখন সাংবাদিকদের ব্যাপারে কিছু লিখেই এ লেখাটি শেষ করতে চাই। সাংবাদিক বলা হয় তাদের যারা খবরের সন্ধান করেন, খবরের পেছনে ছোটেন, খবর নির্বাচন করেন, সম্পাদনা করেন ও সংশোধন করেন। তাদের কাজ হচ্ছে তথ্য সংগ্রহ করা, প্রতিবেদন লেখা। আর সংবাদ হলো চলতি ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ, যা পাঠকের আগ্রহ উদ্দীপিত করে। অন্যভাবে বলা যায়: স্থিতাবস্থার পরিবর্তনে সৃস্ট ঘটনা, যাতে সমাজে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় এবং যা অবশ্যই সত্য, বস্তুনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ, তাকে খবর বা সংবাদ বলে। সংবাদ সংগ্রহ করা; সংবাদের সত্যতা যাচাই করা; সংবাদ সম্পাদনা করা; প্রয়োজনে মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়া; তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণ করাও প্রয়োজনীয় ছবি সংগ্রহ করাও অন্যতম কাজ।
আমরা যা দেখি, তা খবর; যা জানি, তা প্রেক্ষাপট এবং যা অনুভব করি, তা মতামত। খবরের যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব আছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সংবাদ কোনো ঘটনা নয়, ঘটনার বিবরণ মাত্র। এটি সাধারণত কোনো নতুন বা সাম্প্রতিক ঘটনার বিষয়। এগুলোকে অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ বা ভারসাম্যপূর্ণ সংবাদ হতে হবে। সাথে সাথে তা হবে সংক্ষিপ্ত, স্পষ্ট ও সাবলীল।
মানুষ ‘অভ্যাস ও কৌতূহলের কারণে সংবাদপত্র পড়ে’। এজন্য সংবাদপত্রে কর্মরত সাংবাদিকদের সংবাদপত্রের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। আমরা জানি পত্রিকার লক্ষ্যের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, অবগত করা, বিনোদনের ব্যবস্থা ও শিক্ষার বিষয়ে লক্ষ্য রাখা। তবে সবক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নীতিমালা অনুসরণ করে অগ্রসর হতে হয়। আর সাংবাদিকতার নীতিমালা তৈরি হয় দেশের মানুষের মূল্যবোধ থেকেই। এখানে আইন যাই থাকুক না কেন, সেটার চাইতে দায়িত্ববোধই মূল ব্যাপার। সাংবাদিকের বিবেকই বলে দেবে-কোনটা ছাপানো হবে আর কোনটা ছাপানো হবে না। সব সময় মনে রাখতে হয় সত্যতাই এ পেশার মানুষের একমাত্র লক্ষ্য।
এ খবরের পিছনে অনেকে কাজ করে থাকেন। খবর সম্পাদনা করেন সহ-সম্পাদক। সাব-এডিটরের কয়েকটি কাজ কাজ হচ্ছে- নাম, সংখ্যা, তথ্য, শব্দ, তারিখ ইত্যাদি নিরীক্ষণ। ভারসাম্য রক্ষা, স্পষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন, বাহুল্য বর্জন, কম কথা এবং অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দেয়া এবং সাবলীল উপস্থাপনা। এ জন্য সাব-এডিটরের দায়িত্ব অন্য অনেকের চেয়ে অনেক বেশি। এরপর সম্পাদক বা সে দায়িত্বপালনকারী যিনি তিনি শিরোনাম দিয়ে থাকেন। যেহেতু সাধারণ মানুষের জীবনে গণমাধ্যমের সরাসরি প্রভাব রয়েছে, সেহেতু বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা একজন সাংবাদিকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এছাড়া সংবেদনশীল খবর প্রকাশের ক্ষেত্রেও তথ্যদাতার গোপনীয়তা রক্ষা করা বাঞ্ছনীয়।
সাংবাদিকদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত যোগ্যতার চাইতে অন্যান্য যে সমস্ত বিষয়ে যতেষ্ট অভিজ্ঞতার দরকার হয়, তার মধ্যে রয়েছে, ভাষাগত দক্ষতা, অনুসন্ধানী মনোভাব বা কোন কিছুর ব্যাপারে অনুসন্ধান করে তথ্য সংগ্রহের মানসিকতা, মানুষের সাথে যোগাযোগের অভ্যাস, পাঠকদের কাছে খবর উপস্থাপন করার ব্যাপারে জ্ঞান, বিভিন্ন ধরনের লেখালেখিতে পারদর্শীতা ও বিশ্লেষণধর্মী ক্ষমতা থাকা যা কিনা কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু তথ্য-উপাত্তের উপর নির্ভর না করে সংবাদে যৌক্তিক চিন্তার প্রসার ঘটানোর ক্ষমতা ইত্যাদি।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com