জীবনের কথা, পর্ব-৪২
“সিলেট পাইলে যেমন-তেমন, ঢাকায় পাইলে ‘আছইন কেমন’ লন্ডনে কই- ও আমার সিলেটি ভাইছাব”
:: মো. রহমত আলী ::
লন্ডনী সাব বা লন্ডনী শব্দটি দেশের অধিক প্রচলিত। প্রবাসে কেউ কাউকে লন্ডনী সম্বোধন করতে দেখা যায় না। দেশে গিয়ে বিমান থেকে নামার পর কাষ্টমসের কাজকর্ম শেষ করে এয়ারপোর্ট থেকে নিজ বাড়িতে রওয়ানা হওয়ার জন্য যখন প্রস্তুুত তখনই কানে ভেসে আসে ‘‘লন্ডনী সাব’’ কোথায় যাবেন? অথবা লন্ডনী সাব তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠেন, না হয় আপনি টাকা পয়সা দিয়ে শেষ করতে পারবেন না। এ কথাগুলো বিমান বন্দরেরই কোন কর্মকর্তা অথবা স্বজনের। কথা শেষ করতে না করতেই হয়তো কিছু লোক এসে ঝেকে ধরবে এবং বলবে ‘লন্ডনী সাব- আল্লাহর ওয়াস্তে কিছু দিয়া যান’।
গাড়ি থেকে নামার পরও সেই একই সম্বোধন শোনা যাবে। ‘‘লন্ডনী সাব ভালা আছইন নি’’ অথবা ‘আমরার লন্ডনী কিলা আছইন’। এভাবে যতদিন দেশে থাকবেন ততদিন কথা শুরুর আগেই ‘লন্ডনী সাব’ শব্দটি সাধারণভাবে প্রচলিত থাকে। অবশেষে লন্ডন ফেরার জন্য যখন পুনরায় লন্ডনীসাব বিমান বন্দরে উপস্থিত হবেন ও কাষ্টমস শেষে বিমানে চড়বেন তখনই রেহাই পাবেন সে ‘লন্ডনী’ সম্বোধন থেকে। এ বিষয়ে বহু গানও প্রচলিত আছে। একটি গানেরকলি এরকম- ‘‘সিলেট ফাইলে যেমন-তেমন, ঢাকায় ফাইলে কই ‘আছইন কেমন’ আর লন্ডন গেলে কই‘ ও আমার সিলেটি ভাইছাব, আমার লন্ডনী ভাইসাব। অর্থাৎ লন্ডনীদের সাথে সিলেটে দেখা হলে এটা স্বাভাবিক মনে হয়। তবে রাজধানী ঢাকায় দেখা হলে কোশল বার্তা জিজ্ঞাসা করা হয়। কিন্তু লন্ডনে গিয়ে দেখা হলে গলায় জড়িয়ে ধরে একজন আরেকজনকে বলে থাকেন, আমার সিলেটের লন্ডনী ভাইসাব।
সে যাই হউক, ‘লন্ডনী’ শব্দটির মহাত্মতা বা গুরুত্ব এখানেই শেষ নয়। ‘লন্ডনী’ শব্দটি দেশে প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকাতো বটেই অন্যান্য এলাকায়ও এর গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। দেশের বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে লন্ডনী ছাড়াও তাদের আত্মীয়-স্বজন বিশেষ গুরুত্বের অধিকারী হয়ে থাকেন। লন্ডনীদের ভাই ভাতিজা গ্রামে বা এলাকায় বিশেষ প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ করে থাকেন। বিচার পঞ্চায়েত, সভা-সমাবেশে খেলাধুলা, শিক্ষা-দীক্ষা এমনকি দান খয়রাতের বেলাও তাদের নাম থাকে সর্বাগ্রে। লেখাপড়ার কমতি থাকলেও শুধুমাত্র ‘লন্ডনী’ পরিবারের লোক হওয়ার কারণে তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির ঘটনা আমাদের সমাজে কম নয়। আবার লেখাপড়া, তার সাথে লন্ডনী পরিবারের সন্তান হলেতো সোনায় সোহাগা। অতি অল্প দিনেই তাদের স্থান নির্ধারিত হয়ে যায় সমাজের উচুঁ তলায়।
লন্ডনী শুধু একটি শব্দ নয়। এ শব্দটি স্থাবর-অস্থাবর ধন সম্পত্তির চেয়েও অনেক বড়। প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকার পাত্রের যোগ্যতার ক্ষেত্রে তার ধন সম্পত্তি বা শিক্ষাগত যোগ্যতার উর্ধে স্থান করে নেয় ‘লন্ডনী’ শব্দ। অর্থাৎ পাত্রের পরিবারে কত জন লন্ডনে আছে। বিয়ের বাজারে সেটাই মুখ্য বিবেচ্য হয়ে দাঁড়ায়। যে পরিবারে লন্ডনীর সংখ্যা যত বেশী, সে পরিবারের পাত্র-পাত্রীর মূল্য তত বেশি। হীন অবস্থাসম্পন্ন পাত্ররা বিয়ের আলাপ দেয়ার আগেই বেশি করে খোঁজ খবর রাখেন যে, পাত্রী পরিবারে কতজন লন্ডনী আছেন। তবে পিতা বা আপন ভাই ‘লন্ডনী’ হলে পাত্রীর পাল্লা সব সময় ভারী থাকে। বাবা-ভাই না থাকলে নিদেন পক্ষে মামা-চাচা-দুলাভাইকেও উপস্থাপন করা হয়। কার কত জন লন্ডনী দুলাভাই আছে এ নিয়ে শালা-শালীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা কম হয় না। পাশের বাড়ির আম্বিয়ার তিনজন দুলাভাই লন্ডনী থাকলেও অন্য বাড়ির লন্ডনী দুলাভাইহীন শাফিয়ারতো আর দিন চলে না। এমন পানসে দিন কাটানোর চেয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়াই যে তার অধিক সুখকর ছিল মনে হতে থাকে। তিন দুলাভাই লন্ডনী মানে বছরে তিনবার কসমেটিকসের সমারোহ, সাথে নিত্বনতুন মোবাইল ফোনের যোগান। একই রকম লন্ডনী দুলাভাইহীন রিয়াজের মনভরা ভাব কাটে না। নতুন জামাকাপড়, কেডস পায়ে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে শহর ঘুরতে যাওয়া কিংবা একটি মাইক্রোবাস নিয়ে পিকনিকের আবদার জানাবার তার যে কেউ নেই।
লন্ডনী দামান্দ তো (জামাতা) শশুর বাড়ীতে একটু আলাদা মর্যাদার অধিকারী। আজকালকার শ্বশুর-শাশুড়ীরাও দামান্দের পকেটের ভাষা বোঝেন! শাশুড়ী লন্ডন থেকে দামান্দের আনা শাড়িটি সবাইকে না দেখানো পর্যন্ত শান্তি পান না। শ্বশুর বাবা অবশ্য এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি হেঁটে হেঁটে গিয়ে দামান্দের আগমনী সংবাদ জানাতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন। দামান্দের পছন্দ অনুযায়ী বাজার খরচ, বড় মাছটি কিনে আনতেও কার্পন্য করেন না তিনি। এ নিয়ে ও অন্যান্য দামান্দের মধ্যে মাঝে মাঝে মন কষাকষি হয়। তবে চালাক ভায়রাগন তক্কে তক্কে থাকেন লন্ডনীকে কোন লোভ দেখিয়ে যে কোন একটি পার্টনারশীপে রাজি করানো যায় কি-না। সব পার্টনারশীপই যে মন্দ নয়, লন্ডনী সাব তা ভালো করেই জানেন। তথাপি ভায়রাদের আব্দারে তিনি খুব বেশি হলে সিলেট শহরে এক খন্ড জমি অথবা অন্য কোন ব্যবসায় রাজি হন। আর রাজি না হলে আশ্বাসে-আশ্বাসে গন্তব্যে ফেরার দিনের অপেক্ষা হয় মুক্তি পাওয়ার মাধ্যম। এভাবে আশ্বাস দিতে দিতে এওয়ারপোর্টের কনকর্স হল ত্যাগ করেন এক সময়।
লন্ডনী বোনদের কদরও পিতামাতার কাছে অন্যান্য বোনদের চেয়ে বেশি। তবে এ নিয়ে তেমন মনকষাকষি হতে দেখা যায় না। সবাই ঘিরে ধরেন ‘লন্ডনী আপাকে’। তবে এর সবই আর্থিক কারণে নয়। লন্ডনে একা একা সব কাজকর্ম করার পর দেশের গিয়ে তারা বেশ স্বস্তিই পান। অনুরুপভাবে লন্ডনীদের ছেলে-মেয়েরাও দেশে গেলে বেশ কদর থাকে । সবাই তাদের ¯েœহ মমতা করেন। হিংসা বিদ্বেষের স্থান এখানে থাকে না।
এদিকে বর্তমানে লন্ডনী কন্যা আর লন্ডনী পাত্রের সাথে সম্পর্ক করা তো রিতিমতো আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সমতূল্য হয়ে গেছে। এ বিয়ের নাগাল পেতে প্রকাশ্যে বা নীরবে যে কত তপস্যা, তদবির চলে তা বলে শেষ করা যাবে না। কোন কোন সময় সম্মোহনী মন্ত্রেরও কাজ-কারবার চলে বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। আবার এই লন্ডনী পাত্রপাত্রী বিশেষ করে লন্ডনী কন্যাদের বিয়েদানের মাধ্যমে নিজের কম অবস্থা সম্পন্ন আত্মীয় স্বজনকে অবস্থাসম্পন্ন করার দৃষ্টান্তও রয়েছে অনেক।
মোট কথা যত কিছুই হোক না কেন লন্ডনীরা সব সময় সচেষ্ঠ থাকেন দেশে থাকা নিজেদের আত্মীয়-স্বজনের মঙ্গল কামনায়। কিন্তু কেউ কেউ অধিক স্বার্থপর হয়ে গেলে সেখানেই বিপত্তি দেখা দেয়। আর তখনই সমস্যার সৃস্টি হয়। এ সমস্যা যেন দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভবিষ্যতে কখন, কিভাবে যে এর সমাধান হবে তার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com