করোনা পরিস্থিতি, আমাদের করণীয়
সাইফুর রহমান কায়েস
আমাদের দেশে এখনি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের ছবিটি ফুটে উঠেছে। বলা হচ্ছে নতুন ধান উঠলে খাদ্যাভাব থাকবে না। কিন্তু প্রকৃত কৃষকের জমি নেই, বর্গাচাষীর সংখ্যা এদেশে বেশি। তারা ধান চাষের জন্য আগাম দাদন নেন শ্রমিকের মজুরী,বীজ,সার ও সেচের জন্য,কৃষিযন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য। ফলে ধান গোলায় তোলবার আগেই খলায় রেখেই স্বল্পদামে ধান বেচে দাদনের টাকা শোধ করতে হয়। তা করতে গিয়ে কৃষকের ঘরে আর ধান থাকে না। কৃষি ঋণের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। বিনামূল্যে কৃষিযন্ত্রপাতি সরবরাহ করতে হবে। খাদ্যনিরাপত্তাবেষ্টনী থেকে প্রায় ৩০% মানুষ ছিটকে পড়েছেন। এদের সরকারী প্রণোদনার আওতায় এখনি যদি নিয়ে আসা না হয় তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহতম রূপ নেবে । সামাজিকভাবে ব্যক্তিমানুষেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। সমাজে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাবে। তাই সরকারী সকল ধরনের ভাতা বা পারিতোষিক ৫০০- ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০০০ টাকায় উন্নীত করতে বিজ্ঞজনেরা মতামত দিয়েছেন। এর মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষাবেষ্টনী সুদৃঢ় করার উদ্যোগ কার্যকর করতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠানকে এর দায়িত্ব না দিয়ে সরাসরিভাবে উপকারভোগীকে তার ব্যাংক হিসাব বা বিকাশ বা বগদ একাউন্টে স্থানান্তর করতে হবে।
প্রণোদনার টাকা বা সামগ্রী এখনি দুর্বৃত্ততার শিকার হচ্ছে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনে অব্যবস্থাপনার কারণে। তাই সেনাবাহিনীকে এই কাজের দায়িত্ব দেয়া হোক। তাহলে অন্ততপক্ষে দরিদ্র জনগোষ্ঠী কিছুটা হলেও পাবে। এখনি হয়তো মানুষ অতোটা সংকটে পড়বে না। এখন যে সংকট সেটি হচ্ছে নগদ টাকার। আর তিনমাস থেকে ছয়মাস পরে খাদ্য সংকটে পড়বে পুরো জনগোষ্ঠীর অর্ধ্বেক মানুষ। তখন তারা ক্ষিধেকে মোকাবেলা করতে হিমশিম খাবে। সরকারী অব্যবস্থাপনার জন্য দুর্নীতি দরিদ্র মানুষের ন্যায্যতাকে অনিশ্চিত করে তুলছে।
কাজ,আয় ও সঞ্চয়ে করোনার কারণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। এটি চলমান থাকবে অন্ততপক্ষে দুই বছর। তাই এখনি পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগকে প্রণোদিত করতে হবে। ব্যক্তি উদ্যোগের ফলে সামাজিক সুষম বন্টনের কাজটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত মডেল হতে পারে। ব্যক্তি উদ্যোগে দুর্নীতি না হলে, সফল হলে সরকারী উদ্যোগ কেনো চালচোরদের খপ্পরে পড়বে।
করোনা পরিস্থিতির জন্য মধ্যবিত্তের, নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও বিপদে পড়েছেন। যারা কোনোভাবেই সরকারী খাদ্যনিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতাভূক্ত নন। তাদের সমস্যা হচ্ছে তারা কারো কাছে চাইতে বা হাত পারেন না। তাদের কাজ থাকায় আয় ও সঞ্চয় প্রবাহ চলমান ছিলো। কিন্তু কাজ হারিয়ে এই শ্রেণির এখন বেহাল দশা। নিম্ববিত্ত এবং বিত্তহীনদের পাশাপাশি এই শ্রেণিকেও সরকারী প্রণোদনার আওতায় এনে সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
যম যখন বাড়ি চিনেছে তখন প্রাণসংহারে বারেবারেই হানা দিবে। তাই এই মূহুর্তে স্বাস্থ্যখাত ও এর সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাস্তবায়নে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ, গণমাধ্যমে নিয়োজিত ব্যক্তিগণ এবং দেশের জনগণও একই সাথে ঝুঁকির মুখে পড়েছেন। তাই এই ঝুঁকি হ্রাসের জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্যবীমা চালু করতে হবে। এ ধরনের দুর্যোগ আমাদেরকে আগামীতেও মোকাবেলা করতে হবে। তাই স্বাস্থ্যখাতের সক্ষমতা এবং সরকারী প্রণোদনা আরো বাড়াতে হবে। এই খাতের ফড়ে, দালালদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে। বাংলাদেশী নাগরিক যারা বিদেশে থেকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন তাদেরকেও এই খাতে সম্পৃক্ত করতে হবে। গবেষণার উপর জোর দিতে হবে। দেশের মানুষের মাঝে বিজ্ঞানমনষ্কতা সৃষ্টি করতে হবে। কোনো ধরনের গুজব বা মিথনির্ভরতা এড়িয়ে জনসাধারণকে সচেতন করতে হবে। আমাদের পাঠ্যসূচী ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা যাতে বিজ্ঞান অনুশীলনে আরো বেশি ব্রতী হয় সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। তাদেরকে উজ্জীবিত করতে স্কুল, মিডিয়ার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল বন্ধকালীন সময়ে পড়াশুনার চাপ অতোটা না থাকায় ছাত্রছাত্রীদের ডিমোরালাইজড, ডিরেইল্ড হওয়ার সম্ভাবনাকে একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। তাই মিডিয়াতে আচরণিক বিজ্ঞান, নৈতিকশিক্ষামূলক বিষয়াদি বেশি করে প্রচার করতে হবে। কারণ ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে আমরা অতিমাত্রায় উন্নাসিক হওয়ায়, যান্ত্রিক হয়ে যাওয়ায়, মানবিকতার পথ থেকে দূরে সরে যাওয়ায় এরা হতাশার মধ্যে বেড়ে উঠছে। পরিবারে সময় না দেয়ার প্রবণতাযুক্ত হওয়ায় পেরেন্টিংটা ঠিকমতো হয় নি। তাই করোনা পরিস্থিতিতে এগুলো শুধরে নেবার সুযোগ এসেছে। সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার মওকা পাওয়া গেছে। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং আসলে সামাজিক নয়, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার কথা বলছে। তাই এই পরিস্থিতিতে আমাদের সামাজিকতা,মানবিকতা বিলুপ্ত হতে দেয়া যাবে না। এখন আমরা মানবিকতার সংকটে পড়ে গেছি। এ থেকে উত্তরণের সময় এখনি।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক