জীবনের কথা, পর্ব-৪৪
আগের দিনের কলের গানের কথা এখনও স্মরণ হয়
:: মো. রহমত আলী ::
বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে আমাদের জীবনের অনেক কিছুই পাল্টে গেছে এবং পাল্টে যাচ্ছে। তবে এটা আমাদের জীবনকালেই যেন বেশী হচ্ছে বলে মনে হয়। এর আগে হাজার হাজার বছরে যা হয়নি তা যেন বিগত একশত বছরে বাস্তবায়ন হয়ে গেছে। আগামী একশত বছরে যে আরো কতকিছু হবে তা বোধ হয় আমরা কল্পনাও করতে পারবো না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বিজ্ঞানের এক চরম পর্যায়ে বিচরণ করে কোথায় যে হারিয়ে যাবে তা খেয়াল না করে সবাই আছে শুধু নতুন নতুন আবিস্কারের তালে। এ আবিস্কারগুলি যে সবটিই মানব সভ্যতার জন্য সুফল বয়ে আনছে বা আনবে তা কিন্তু হলফ করে বলা যায় না। ব্যক্তি নিরাপত্তা, পারিবারিক গোপনীয়তা, সমাজ ও দেশ বিধ্বংসী এমন কিছু ঘটছে বা ঘটবে যার ফলে আমরা পৃথিবীতে এক বিপন্ন প্রজাতি হিসাবে পরিনগনিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমরা ছোটবেলা পরীক্ষায় বা বিতর্ক অনুষ্ঠানের বিষয় “বিজ্ঞান আশির্বাদ না অভিশাপ” হিসাবে উল্লেখ করতে দেখতাম। কিন্তু সে সময় তেমন কিছু না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি এর প্রভাব কতটুকু প্রতিফলিত হচ্ছে।
সে যাই হোক, আজকে একটি পুরোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি যা শিরোনাম দেখে বিষয়টি অনেকে ইতোমধ্যেই অনুমান করতে পেরেছেন। অর্থাৎ সেকালের কলের গান বা গ্রামফোনের কথা। আজকাল যদিও অনেকের নিকট এ সম্পর্কে তেমন ধারনা নেই কিন্তু বিশেষ করে পঞ্চাশোর্ধ যারা তাদের কাছে এটি নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। আমি ছোটবেলায় অর্থাৎ ষাটের দশকে এ কলের গানের সাথে পরিচিত হই। আমার এক মামা বৃটেন থেকে একটি কলের গান দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। তখন গ্রামের লোকজন এ কলের গান শুনার জন্যে ভীড় জমাতো। আর এর গান শুনে অনেকে অনেক মন্তব্য করতেন। অনেকের ধারনা ছিল নিশ্চই এর ভিতরে কোথাও না কোথাও মানুষ আছে, না হলে এটা বাজে কিভাবে?
সে সময় কেবল সামর্থ্যবান পরিবারেই শোভা পেত কলের গান বা গ্রামোফোন। কারণ সে সময় এখনকার মতো মোবাইল ফোন বা এমপিথ্রিতে গান শোনা তো দূরে থাক, ক্যাসেট প্লেয়ার বা সিডি প্লেয়ারের প্রচলন তখন ছিল না। সে সময় গান শোনার মাধ্যম ছিল এই কলের গান। এই গ্রামোফোন যন্ত্রটি চালানোর জন্য কোনো বিদ্যুতের প্রয়োজন হতো না। ফলে এই যন্ত্রটি দ্রুত মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ভারত উপমহাদেশে প্রথম গ্রামফোন নিয়ে আসেন এফ ডব্লিউ গেইসবার্গ। ১৯০২ সালে কলকাতার বাঙালি শিল্পী গওহর জানকে দিয়ে প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড করানো হয়। গ্রামোফোনের রেকর্ড তৈরিতে প্রথম ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা হলেন হেমেন্দ্র মোহন বসু। কলকাতার বেলিয়াঘাটায় প্রথম রেকর্ড কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৮ সালের ১৯ জুন। প্রথম দিককার গ্রামোফোনের রেকর্ডগুলোতে এক পিঠে একটি করে গান থাকত। পরে লং প্লে রেকর্ড তৈরি হতে শুরু হয়। তখন এক পিঠে সাত-আটটি করে গান রেকর্ড থাকত, যা গ্রামোফোন ব্যবহারের শেষ সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।
এই গ্রামফোন ছিল যন্ত্রের দ্বারা ধারণকৃত শব্দকে বাজানোর জন্য ব্যবহৃত এক প্রকার যন্ত্র বিশেষ। শব্দকে বিশেষভাবে নির্মিত একটি মাধ্যমে ধারণ করা হতো। এক্ষেত্রে কোনো নির্বাচিত চলমান মাধ্যমের উপর দাগ কেটে বা খোদিত করে শব্দের কম্পাঙ্ককে কোনো রেখা অনুসরণ করে ধারণ করা হতো। পরে ওই চলমান গতি অনুসারে, ওই শব্দধারণকৃত মাধ্যমটিকে ফনোগ্রাফে বাজানো হতো। শব্দ ধারণের মাধ্যমটি চোঙ্গাকৃত বা চাকতির মতো ছিল। এই মাধ্যমটি ফনোগ্রাফের নিজস্ব যন্ত্রের সাহায্যে ঘুরানো হতো এবং এর উপরে শব্দরেখার উপর সূঁচালো একটি শলাকার অগ্রভাগ ছুঁয়ে যাওয়ার সময়, শব্দরেখার কম্পাঙ্ককে শনাক্ত করে, শব্দ উৎপন্ন হয়। পরে শব্দ বর্ধক যন্ত্রের সাহায্যে তা জোরালো হয়ে উঠতো আর তখন শুনা যেত।
শব্দ সংরক্ষণের জনক ছিলেন টমাস আলভা এডিসন। তিনি ১৮৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কাঠের বাক্সের ওপর চোঙা লাগানো এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করলেন। যার মধ্যে গোলাকৃতি এক বস্তুর ওপর চাকতির মধ্যে পিন লাগিয়ে ঘোরালে শব্দ উৎপন্ন হতো। এর প্রায় এক দশক পর জার্মানির বিজ্ঞানী বার্নিলার টিনফয়েল আধুনিক করে মোমের রেকর্ড বানিয়ে নাম দেন গ্রামোফোন। তারপর মাটির রেকর্ড থেকে প্লাস্টিকের সুতায় ঘূর্ণন রেকর্ড। এ সময় এডিসনের পোষা কুকুরকে গ্রামোফোনের চোঙের সামনে বসিয়ে মনোগ্রাম করে নামকরণ হয় ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ সংক্ষেপে এইচএমভি। টমাস এডিসন পরে এ শব্দযন্ত্র আবিষ্কার করেন এবং তার নাম দেন ফোনোগ্রাফ। ১৮৮৭ সালে এমিল বার্লিনার গ্রামোফোন আবিষ্কার করেন, যা এডিসনের ফোনোগ্রফেরই উন্নত ব্রিটিশ সংস্করণ।
এর ধারাবাহিকতায় ১৯০২ সালে গেইসবার্গ প্রথম একজন ভারতীয় শিল্পীর গান রেকর্ড তৈরি করেন। সাত ও দশ ইঞ্চি ব্যাসের একটি রেকর্ডে তাঁর গানগুলি ধারণ করা হয়। বিশ শতকের প্রথম দশকে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি গ্রামোফোন কোম্পানি ছিল, হিজ মাস্টার’স ভয়েজ (ব্রিটিশ), কলাম্বিয়া (আমেরিকান) এবং পঠে (ফ্রেন্স)। তবে ব্রিটিশ কোম্পানি হিজ মাস্টার’স ভয়েজ ছিল অনেকের মত আমার কাছেও বিশেষভাবে পরিচিত। আমি তখন মনে করতাম ছবিতে দেয়া কুকুর হয়তো বলছে এটা তার মুনিবের আওয়াজ।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বেতার বা রেডিওতে গান প্রচারের সময় বলা হতো ‘এখন শুনবেন গ্রামোফোন রেকর্ডে গান।’ এ সময় রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল গীতি, বাংলা গীত, নাটক, কৌতুক সবই রেকর্ড করা হতো। তখন বেশির ভাগ রেকর্ড ছিল প্রতি মিনিটে ৭৮ বার ঘূর্ণনের। এই রেকর্ডকে বলা হতো ৭৮ আরপিএম (রিভলভিং পার মিনিট)। এইচএমভি, কলাম্বিয়া, টুইন কোম্পানির রেকর্ড চলত বেশি। ঐতিহাসিক পালা সিরাজউদ্দৌলা, চাঁদ সওদাগর, শৈলজানন্দের শহর থেকে দূরে নাটকের রেকর্ড ব্যাপক প্রচার পায়। তবে উপমহাদেশে সবচেয়ে বেশি চলে বাট শেফার্ডের হাসির গানের রেকর্ড। তারপর অটো রেকর্ড প্লেয়ার, চলত ব্যাটারি ও বিদ্যুতে। সেই সঙ্গে বড় ফিতার স্পুল রেকর্ডার। বলা হতো টেপ রেকর্ডার। আশির দশক থেকে নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত ছোট ফিতার ক্যাসেট রেকর্ডার। একটি ক্যাসেট এপাশ-ওপাশ মিলে চলত এক ঘণ্টা। গান শোনার ক্যাসেটের সঙ্গে চলে এলো ভিডিও ক্যাসেট। তারপর শব্দ বিজ্ঞানের পালা বদল ঘটতে থাকে সুপারসনিক গতিতে। একবিংশ শতকের প্রথম দিকেও ক্যাসেট প্লেয়ার ছিল। এরপর এলো কমপ্যাক্ট ডিস্ক (সিডি)। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এলো ডিজিটাল ভিডিও ডিস্ক (ডিভিডি)। এমতাবস্থায় গান স্থির ছবি, চলমান ছবি সবই ডিস্কে ধরে রাখার ব্যবস্থা শুরু হয়।
এখন হাতের মুঠোয় ‘পেন ড্রাইভে’ সবই ধরে রাখার ব্যবস্থা করল বিজ্ঞান। এই ‘পেন ড্রাইভ’ চালাতে লাগে কম্পিউটার। কিন্তু পরে বিজ্ঞান সবই ঢুকিয়ে দিল সেল (মোবাইল) ফোনে। হাতের মুঠোয় এখন বিশ্ব। ইন্টারনেটও ভেসে ওঠে সেলফোনে। এমতাবস্থায় গান, স্থির ও চলমান ছবি তোলা ও দেখা শুধু ইশারার ব্যাপার। বর্তমান প্রজন্ম চলতে ফিরতে মোবাইলের মনিটরে সবই দেখে, গানও শোনে। মধ্য বয়সীদের সেলফোনেও এখন পুরনো দিনের গান বাজে। সাথে সাথে আরো অনেক কিছুর অনুসঙ্গ হচ্ছে এ মোবাইল ফোন। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com