প্রচ্ছদ

স্মৃতিতে অম্লান বিশ্বনাথের এক উজ্জ্বল তারকা আমার বাবা

  |  ১১:৫৮, আগস্ট ২১, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: মিজানুর রহমান মিজান ::

পৃথিবী মুসাফির খানা। ক্ষণস্থায়ী এ পৃথিবীর বুকে মানুষ আসে-যায়। জন্ম কথার সাথে মৃত্যু অবধারিত এ যাত্রার ব্যতিক্রম নেই কোন কালে বলে মানুষ অমরত্ব বঞ্চিত। দু’দিন আগে পরে সবাইকে চলে যেতে হয় যথানিয়মের পথ ধরে। নিরবে , সংগোপনে শূন্য হাতে। এমনি আমার পিতা ৪ বৎসর রোগাক্রান্ত থেকে নিয়মের পথে হলেন ধাবিত ১৭ ই ড়িসেম্বর ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দ সন্ধ্যা ৫-৫৫ মিনিটে মহান আল্লাহর নির্দেশিত পথে চিরনিদ্রায় শয়নের মধ্য দিয়ে। ( ইন্না …….রাজিউন) ।

জন্ম-মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়টুকু জীবন নামে অভিহিত। নিয়মের পথ ধরে মানুষ চলে গেলে চিরায়ত পথে সত্যের অবিস্মরণীয় যাত্রায় অভিযাত্রীক হিসেবে পৃথিবীতে রেখে যান কিছু স্মৃতি , আদর্শ কর্মময় জীবন যাপনের মাধ্যমে। যা ভবিষ্যত প্রজন্মের অনুসরণীয় , অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের প্রতিচছবি রুপে উজ্জীবিত , অনুপ্রাণিত করে হৃদয়ের অনুভূতি সিক্ততায়। এ সমস্ত কর্ম আলোচিত হয় দিনের পর দিন কীর্তি গাঁথা স্বরুপ। সে কর্ম বা আলোকিত জীবন যাত্রা যদি আদর্শিক চরিত্র , মাধুর্যমন্ডিত স্পর্শছোঁয়া হয়, তবে যেন সোনায় সোহাগার ঘটে সংমিশ্রণ। আমার বাবা ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন আলোকিত ব্যক্তিত্ব। যাঁর কণ্ঠের মাধুর্য ও সুললিত সুরে সিলেটের সাংস্কৃতিক অঙ্গন মাতিয়ে রেখে ছিলেন ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল প্রথমার্ধ পর্যন্ত। তিনির একান্ত নিরলস প্রচেষ্টা এবং দৃঢ প্রত্যয়ে ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সোপান বেয়ে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌছেন সিলেটের মরমী বাউল শিল্পি রুপে দর্শক শ্রোতার হৃদয় বন্দরে। সিলেটের বিভিন্ন আসরে , মঞ্চে অংশ নিয়ে দর্শক শ্রোতার অকুণ্ঠ প্রশংসা , সাফল্য অর্জন করেন। প্রসারিত হয় প্রতিভা বিকাশের উম্মুক্ত সোনালী প্রভাত। একজন গুণী শিল্পী রুপে প্রতিষ্টিত হয়ে গোটা সিলেটের আকাশে বিচরণ করেন সুরভিত সৌরভে সঙ্গীত পিপাসু অগণিত ভক্তদের মাঝে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় পল্লীর মরমী বাউল শিল্পীর যথাযথ মর্যাদা প্রাপ্তির বা প্রদানের ক্ষেত্রে উদাসীনতা প্রদর্শিত হয়েছে বরাবরই। জনশ্রোতি বা লোক মুখে তিনির কীর্তি গাঁথা আলোচিত হলে ও প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে কোন প্রকার সহযোগিতা বা উদ্যোগ গৃহীত হয়নি অদ্যাবধি। তিনির মৃত্যুর পর অজপাড়া গায়ে প্রতিষ্ঠিত মঞ্জুশ্রী একাডেমীর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় ” একটি ফুলের অন্বেষায়” ।
সিলেটের মরমী বাউল বা মরমী গানের অগণন শিল্পীর মধ্যে তিনি আপন প্রভায় শুধু উজ্জল নয়। কিংবদন্তীতে পরিণত বলা যায়। বিশেষ করে তিনি ভাবুক গান গাইতেন অত্যধিক। যেমন – ” যেদিন হতে বন্ধুহারা ধারা বয় দুই নয়নে” অথবা ” আমি অধম পাথকী , জোড় হস্তে তোমায় ডাকি , কর সুখি দেখাইয়া দিদার , আমি গুণাগার” দর্শক শ্রোতা পিন পতন নিরবতায় ভাব সাগরে অবগাহন করতেন তম্ময় পূর্ণ সুর লহরীতে। স্রষ্টার নিকট নিজকে সমর্পণের আকুলতায় মানব হৃদয়ের ব্যাকুলতা প্রকাশিত হত হৃদয়জ গভীরতায়।
তাছাড়া বেহালা বা হারমোনিয়ামের সুরের মুর্ছনায় ” ডাকি আমি কাতরে , রহম কর আমারে , ওগো রহমানুর রাহিম আল্লাহ” গান গুলি ভাবুক হৃদয়ের প্রান্ত সীমা ছুয়েঁ যেত মর্মস্পর্শী আন্তরিকতায়। খাজাঞ্চী নদী যেমন পূর্বের জৌলুস হারিয়ে মরা নদীর রুপ ধারণে এগিয়ে যাচেছ ক্রমশ। তেমনি ঐ নদী তীরের বাসিন্দা সখ্যতা গড়ে কালের গর্ভে মিতালী পেতে সমবেদনায় বিদুরিত বিলীন যাত্রায়। তেমনি ঐ শিল্পীর এক সময়ের উজ্জল নক্ষত্রের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গানের ক্যাসেট সংরক্ষণ করা অতীব জরুরী বলে বিবেচ্য ও দাবী রাখা বৈচিত্র কিছু নয়। কারন এক সময় ভাবের দরিয়ার তরঙ্গ রাশি অগণিত মানুষের হৃদয় টাল মাতাল ছিল গানের সুললিত মুর্ছনায় তা অস্বীকার করার জো নেই। এ দাবী এ দেশের সঙ্গীত পিপাসুর।
সিলেটের বিশ্বনাথ উপজলার খাজাঞ্চী ইউনিয়নের অন্তর্গত জয়নগর ( নোয়াপাড়া ) গ্রামে ১৯২৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সর্ব কনিষ্ট থাকায় সকলের অতি আদুরে লালিত পালিত হন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া সমাপ্ত করে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। পল্লী গ্রামে গ্রামোফোন ( কলের গান) এর প্রচলন হয় শুরু। গ্রামোফোন কিনে বাজাতেন। গান শুনে গানের প্রতি তাঁর ঝোঁক বেড়ে যায়। শুরু হয় সাধনা। প্রথমেই হারমোনিয়াম। তারপর দুতারা। পর্যায়ক্রমে বেহালা ইত্যাদি। এক সময় টেপরেকর্ডার এর প্রচলন ছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। অনেকে সুদুর লন্ডন থেকে ক্যাসেট পাঠিয়ে তিনির গান রেকর্ড করে নিতেন। আজো অনেক সঙ্গীত পিপাসুর নিকট তাঁর কণ্ঠের ধারণকৃত ক্যাসেট বাজতে দেখা যায়। ছড়িয়ে , ছিটিয়ে আছে সর্বত্র।

একজন পিতা হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল। একমাত্র পুত্র সন্তান হওয়ায় আমার প্রতি যে অকৃত্রিম ভালবাসা , আদর , স্নেহ , কতটুকু ছিল তা বলা বাহুল্য। সর্বক্ষণ তিনির চিন্তা , চেতনা , ধ্যান-ধারণায় আমার উন্নতি , সুখ , শান্তি , সমৃদ্ধি প্রত্যয়ী প্রয়াস রুপে কামনার বিষয় বস্তুতে অর্ন্তভুক্তি ঐকান্তিক নির্ভরতায় মহান আল্লাহর নিকট ছিল কাম্য। যদি ও সাংসারিক ক্ষেত্রে গানের জগতের সংশ্লিষ্টতায় সময় দেয়া সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে মায়ের একনিষ্ট আন্তরিকতায় ঠিকে থাকা এ পর্যন্ত। বাদবাকী মহান রাব্বুল আলামীনের কৃপা। কোন দিন পিতা আমাকে বকুনী বা ধমক দেননি , হাত তোলা দুরের কথা। তিনির একটি নীতি বাক্য সর্বক্ষণ আমার প্রতি ছিল সত্য ও সততাকে অন্তরের অন্ত:স্থলে স্থান দিয়ে জীবনের পথ চলা। সাথে ধৈর্য ও সহনশীলতা অত্যন্ত পরমাত্মীয় হিসেবে গ্রহণ করা। এ নীতি বাক্য পরম সঙ্গী ভেবে পথ চলতে একটু ভাবগাম্ভীর্যময় স্বভাব সিক্ত হয়ে গেলাম বলে মনে হয় তিনির মত। তবে তিনির মত একজন শিল্পী হতে পারলাম না। যদি ও বোধশক্তি অর্জনের পর হতেই পথে , ঘাটে , মাঠে , হাটে যেখানে গিয়েছি প্রতিটি মানুষ কেহবা অবয়ব দেখে , কেহ অপরের নিকট থেকে পরিচয় জেনে আবার কেহ আমাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করে বলতেন , ” আমি একজন বড় গায়ক হবো” বলে ভবিষ্যত বাণী করতেন। কিন্তু বিখ্যাত হওয়া দুরে থাক গানের জগতের সংস্পর্শে ও যাওয়া হয়নি মোঠেই। রয়ে গেলাম অখ্যাত যা আমার জীবনের অভিশাপ না আশীর্বাদ তা ও অজ্ঞাত। এক মাত্র ললাট লিখক ভাগ্য নিয়ন্তাই জ্ঞাত। পিতা যেমন আমাকে এ ব্যাপারে কোন উৎসাহ , আগ্রহ বা অনুপ্রাণিত করেননি , আমি ও তেমনি আন্তরিক হৃদ্যতা অনুভব করিনি।
আমার বাবার সঙ্গীত সাধনায় অনুকুল পরিবেশ প্রাপ্তিযোগ মোঠেই ছিল না। কারন তখনকার সময় ও পরিবেশ ছিল একটু ভিন্নতর। পারিবারিক ক্ষেত্রে ও ছিল এ সংস্কৃতি বিবর্জিত। এতদসত্তেও সম্পূর্ণ প্রতিকুল পরিবেশে অত্যন্ত সংগোপনে আড়ালে আবড়ালে তিনির সঙ্গীত সাধনা চলত নিরবিচিছন্ন ভাবে। আমি দেখেছি মধ্য বয়সে এসে ও বড় ভাইদের লুকিয়ে গানের সরঞ্জামাদি আনা নেওয়া করতেন। বড় ভাইদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধা , ভক্তি ও সমীহ সম্মানের সহিত কথা বার্তা বলতেন। ধুমপানের অধিক অভ্যাস থাকলে ও সর্বক্ষণ সতর্ক থাকতেন বড় ভাইরা যদি দেখে ফেলেন। তা বেয়াদবীর পর্যায়ভুক্ত বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন।
আমি লেখাপড়া করি এ ছিল তিনির প্রাণের কথা। কিন্তু যখনই আমি বাবার পরামর্শ নিতে চেয়েছি, যেমন কোন গ্র“প বা শাখা গ্রহণ ভাল হবে তা জিজ্ঞাসিলে তিনির সুন্দর একটি জবাব ছিল , ”তুমি ভাল মন্দ বুঝ। সুতরাং যা ভাল মনে কর তাই গ্রহণ কর”। আমার প্রতি তিনির এই যে নির্ভরশীলতা এবং আত্মবিশ্বাস তার প্রতিদান কতটুকু দিতে পেরেছি , তা আমি জানি না , এক মাত্র আল্লাহই জ্ঞাত। সাত কন্যা ও একমাত্র পুত্র সন্তান বলে ও কোন আক্ষেপ ছিল না তিনির। অনেকে কন্যা সন্তানে একটু নিরানন্দ বোধে আসক্তী প্রকাশ করতে দেখা যায়। অল্প বয়সে দু’জন সন্তান মৃত্যুমুখে পতিত হন। তাইত দেখা যায় বড় কন্যা সন্তান প্রবাসে থাকায় উপস্থিত হতে না পারলে ও অপর পাঁচ সন্তান ও নাতি নাতনিদের সার্বক্ষণিক সান্নিধ্যে থেকে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। ( ইন্নালিল্লা………রাজিউন)।
আমার বাবা ছিলেন জয়নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের এবং রাজা গঞ্জ বাজার হাফিজিয়া মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের অন্যতম একজন সদস্য। ২০০০ সালের দিকে ক্যান্সার নামক মহাঘাতকে আক্রান্ত হলে ও সৃষ্টি কর্তার অপার বিষ্ময় ডাক্তার ফরিদ উদ্দিনের আন্তরিক চিকিৎসায় অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ্য হয়ে উঠেন। যদি গলায় ত্রিশটি রেডিওথেরাপি কোন কিছুর প্রকৃত স্বাদ গ্রহণ কেড়ে নিয়েছিল। পরবর্তী ২০০৪ সালের ২৮ শে রমজান অসুস্থ্য হলে ধরা পড়ে ফুসফুস আক্রান্তের। এ যাত্রা রেহাই দেয়নি ঘাতক। সদর্পে চেপে বসে বীরের ভুমিকায়। নিয়ে যায় অন্তিম যাত্রায়।
তিনি ছিলেন সদালাপি , হাস্যময়ী , অমায়িক ব্যবহারের সমাহার সমৃদ্ধ ব্যক্তি। মানুষকে সহজে আকৃষ্ট করার বা আপন করে নেবার আকর্ষিক নিজস্ব বলয়ের অধিকারি। সুতরাং মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা অর্জন সমৃদ্ধ জীবনের পরিচয় মেলে সহজে জানাজায় লোক সমাগমে। অনেক মানুষ অংশ গ্রহণের নিমিত্তে এসে ও বঞ্চিত হয়ে গেছেন নির্দিষ্ট সময়ের বিলম্বতায়। এ ব্যাপারে শত অভিযোগের সমাধান দিতে আমাকে হিমশীম খেতে হয়েছে। আমি নিরন্তর করজোড়ে বিনয়াবনত চিত্তে মহান আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি রুহের মাগফেরাত ও জান্নাতবাসি করার। তিনি সফলতা পূর্ণ কীর্তি গাঁথা সুভাসিত হোক অনন্ত সময় ব্যাপী ফুলের সৌরভ মন্ডিত সুবাসে। তিনির আত্মা হোক প্রশান্ত মানুষের ভালবাসা সিক্ত স্রষ্টার রহম ও করুণায়।

লেখক: প্রতিষ্টাতা ও পরিচালক
চাঁন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার, সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব।