আল মাহমুদ : কবিতাই যাঁর ঐশ্বর্য কবিতাই তাঁর প্রাণ
:: এবিএম সালেহ উদ্দীন ::
আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) পোশাকি নাম মীর আবদুস শুকুর। আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। বাংলার মাটি ও মানুষের তৃণমূল থেকে উঠে আসা কবি আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যাদর্শের উজ্জ্বল নক্ষত্র। একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, ছোট গল্পলেখক, শিশুসাহিত্যিক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঔপনিবেশিক শাসনামলের জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে ভারত বিভাগের পরবর্তী সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা সাহিত্য ও কাব্যচর্চায় যাঁদের নিবিড়ভাবে সক্রিয়তা ছিল, আল মাহমুদ তাঁদের অন্যতম। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে সাজিয়ে নতুন চেতনার উদ্ভব ঘটানোর ক্ষেত্রেও আল মাহমুদ অন্যতম ভ‚মিকা পালন করেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আদর্শ নির্মাতা হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি আছে। বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে মনন ও চেতনায় সাজিয়ে যে কজন কবি ও সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন ও সাহিত্য-সংস্কৃতির উজ্জয়নে সক্রিয় ভ‚মিকা রেখেছেন, আল মাহমুদ তাঁদের অন্যতম।
দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে বিরামহীনভাবে কবিতায় এক সর্বালোচিত কবি আল মাহমুদ। সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর সদর্প বিচরণ থাকলেও কবি হিসেবে সর্বত্র খ্যাতিমান।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের কলমযোদ্ধা ১৯৭১ সালে কবি আল মাহমুদ সরাসরি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং কলকাতায় প্রবাসী সরকারের সাথে যুক্ত হন। স্বাধীনতাসংগ্রামের ওপর তাঁর কবিতা ও প্রচুর রচনা রয়েছে। তাঁর লেখার অন্যতম চরিত্র হচ্ছে বাংলার সবুজ-শ্যামল সৌন্দর্যময় বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, নদী ও নারীসহ বাংলার মাটি ও মানুষ। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তরে’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে। কিন্তু ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থ তাঁকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে অন্যতম কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, ‘আমি অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে দেখেছি সোনালী কাবিন তাদের মুখস্থ।’ কবি আসাদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘আল মাহমুদকে তিনি তাঁর লেখা এবং শিল্পের বিচারে মূল্যায়ন করেন।
যে কারণে অনবদ্য বাংলা কবিতা ‘সোনালী কাবিন’-এর মতো চিরায়ত কবিতা তৃণমূল থেকে জীবন্ত হয়ে উঠে এসে বাংলার নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে শুরু করে রাজাধিরাজের তখতেও টোকা দিতে পেরেছে। সোনালী কাবিনে মানুষের মধ্যকার সংঘাতের চেয়ে, মানুষের মাঝে মানুষের সুগভীর সম্পর্ক ও মিলনকে জোরদার করার চেষ্টা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন :
‘আমি সোনালী কাবিনে অন্য এক বাংলার চিত্র বা সুদৃঢ় অতীতের হয়েও সমকালের দৃষ্টিগোচর বয়ন করার চেষ্টা করেছি। আমি প্রেম ও কামের সাথে মেলাতে চেয়েছি আধুনিক জীবনের দাবিকে, যা হ্যাঁ-বাচক।’
আবার ইস্পাতকঠিন শহুরে জীবন কাটিয়েও তিনি তাঁর চিরায়ত বিশ্বাসের দীপ্তিকে শাণিত ও সুদৃঢ় করে রাখতে পেরেছেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতাকে শহুরে জীবন থেকে ভাটিবাংলার গ্রামীণ জীবনধারা, নদীমাতৃক আবহের নৌকা বেয়ে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনপ্রবাহকে কবিতার উপাত্ত এবং অবলম্বন করেছেন।
কবিতা ছাড়াও বিস্ময়করভাবে তিনি গল্প-উপন্যাস রচনা করে কথাসাহিত্যে নিজের স্থানটিকে পোক্ত করে নিয়েছেন। তাঁর লেখার টেকনিক ও গতিময়তা ছিল বিস্ময়কর। যেকোনো বিষয়ের ওপর সাবলীল লেখা উপস্থাপন করতে পারতেন। ১৯৫০-এর দশকে যে কজন লেখক বাংলা ভাষার স্বাধিকার ও আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, আল মাহমুদও অন্যতম। এছাড়া জাতীয়তাবাদ, রাজনীতি, অর্থনৈতিক নিপীড়ন, পাকিস্তানি শাসক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়েও সমালোচনা লিখেছেন। নিজস্ব কৌশলকে অক্ষুণ্ন রেখে তিনি অনবদ্য সাহিত্য রচনা করেছেন। অথচ একটা সময় তাঁর মাঝে স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে বাহ্যিক সখ্য সৃষ্টি হওয়ায় অনেকের কাছে তা প্রশ্নাতীত থেকে গেল। যদিও একজন কবির ক্ষেত্রে এসব বিষয় যেমন স্পর্শকাতর, তেমনি নিতান্ত ব্যক্তিগত।
আমাদের আলোচ্য বিষয় তাঁর অপার কাব্যচেতনা এবং কবিতার প্রধান নীতি হচ্ছে সময় ও কাল ডিঙিয়ে সর্বশ্রেণির মানুষের জন্য বিশ্বজনীন হয়ে ওঠা। এ রকম কবিতার ক্ষেত্রে একজন কবি যদি তাঁর মনন-চেতনাকে আত্মশক্তিতে সুদৃঢ় ও স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তবেই তিনি সার্থক। আল মাহমুদ তাঁর আত্মবিশ্বাস ও আত্মশক্তিকে একই জায়গায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। যার প্রভাবে তাঁর মধ্যে প্রবল ঐশ্বরিক চেতনা ও ধর্মবোধ তৈরি হয়েছে এবং তা মৃত্যু পর্যন্ত অটুট ছিল।
সত্যিকার অর্থে তিনি কবিতার ছন্দকে ভেঙে ভাষার সাবলীলতায় কীভাবে আরো বেশি সহজ করে তুলেছেন, সেটি তাঁর কবিতার মধ্যে ডুব না দিলে বোঝা যাবে না। পদ্য ও গদ্যে এসব বিষয়ে তিনি একাধিকবার তাঁর অনুরক্তির কথা ব্যক্ত করেছেন। তাঁর সাহিত্যে মানুষের স্বপ্নময় জীবনের অপরিমেয় সম্ভাবনার অনন্ত সমাহার লক্ষণীয়। গ্রামীণ জীবনের রস আস্বাদনের মাধ্যমে মফস্বলের প্রাকৃতিক নদীনির্ভর জীবনধারাকে অবলম্বন করে তিনি তাঁর সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী নাগরিক জীবনের দুরবস্থায় রাজনৈতিক অস্থির সময়ে বাম রাজনীতির চিন্তানির্যাস দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশ সোজা হয়ে দাঁড়ানোর এক কঠিন সময়ে নবীন দেশের গণমানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। সারা দেশে চোর-বাটপার, মজুতদার ও মুনাফাখোর এবং সংঘবদ্ধ পাচারকারী দল একযোগে অরাজকতা সৃষ্টি করে। দেশব্যাপী চরম খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অন্যদিকে সরকারি ছত্রচ্ছায়ায় নব্য রাজনৈতিক ক্ষমতার দম্ভদাপটে পুরোনো রাজনৈতিক দলসমূহ কোণঠাসা ও মুখ থুবড়ে পড়ে। এ সময় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের (!) স্লোগান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল, সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজসহ একদল ঝানু রাজনীতিক মাঠে নামেন। তাদের দ্বারা পরিচালিত বাম রাজনীতির চিন্তা-চেতনায় (১৯৭২) আত্মপ্রকাশ ঘটে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকা। কবি আল মাহমুদ ছিলেন গণকণ্ঠের সম্পাদক। প্রধান সম্পাদক ছিলেন শক্তিমান লেখক ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফা এবং সহকারী সম্পাদক ছিলেন একসময়কার দৈনিক সংবাদের সাথে যুক্ত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি দিলওয়ার। আল মাহমুদ ও বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফার দক্ষ সম্পাদনায় দৈনিক গণকণ্ঠ যখন জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল, তখনই তৎকালীন সরকারের নজরে পড়ে যায়। একপর্যায়ে পত্রিকাটিকে সরকার বন্ধ করে দেয়! সম্পাদক আল মাহমুদ গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাবরণ করেন। জেলমুক্তির পর তিনি আস্তে আস্তে বামধারার রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা পরিহার করতে শুরু করেন। তিনি স্বদেশপ্রেম ও মানুষের স্বার্থের কথা এবং আধ্যাত্মিক চিন্তাপ্রসূত রচনার প্রতি মনোনিবেশ করেন।
পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের পত্রিকায় চাকরি করে তিনি বিতর্কিত হন। তবে তাঁর সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে তাতে কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাঁর মধ্যে গর্ববোধ ও অহংকার ছিল। সেই অহংকারের কথা অকপটে প্রকাশ করতেন। অন্য পন্থার সংশ্রবে থাকার ফলে তাঁর সাহিত্যের স্বভাবধর্মে কোনো রকম সমস্যা দেখা দেয়নি। কেউ কেউ মনে করেন, অর্থনৈতিক দিক থেকে সংসার চালাতে টানাপোড়েনের কারণেই হয়তো তিনি জামায়াত পরিচালিত পত্রিকায় চাকরি করেন। যদিও কোনো চিরন্তন নৈতিকতার প্রশ্নে এসব যুক্তি টেকে না। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনার কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি। কেননা সাহিত্য রচনায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে বলেই তিনি গায়ে মাখেননি। তিনি বিশ্বাসের দীপ্তিতে অবিচল আস্থা ও আত্মশক্তিতে তাঁর মাঝে সুদৃঢ় মনোভাব অটুট রেখেছেন। কবিতায় নিজস্ব নীতিবোধের প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আত্মবিশ্বাস।
তাই তো তিনি বিশ্বাসের স্পষ্ট উচ্চারণ করেন-
‘তোমার এই অস্তিত্ব আমার গভীর আস্থাকে আমি
বলি, আস্তিকতা। আর বাঁ পাশে
শূন্যতার দিকে তাকিয়ে আমি সিজদা করি
তোমার সৃষ্টিকর্তাকে। বলো, আমি কি বিশ্বাসী নই?’
আমাদের মনে রাখা দরকার-কবিতা রচনার ক্ষেত্রে কবির মনন, আবেগ ও চেতনার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি আগাম চিন্তার একটা ঐশ্বর্য সৃষ্টি করে নিতে হয়। নিজস্ব ধ্যান-ধারণার সাথে মিল রেখে কাব্যরচনায় চৈতন্যের আবহ সৃষ্টির মাধ্যমে কবিকে সব সময় সম্যক ক্রিয়াশীলতা থাকতে হয়। (বাকি অংশ ৬৮ পাতায়)
আল মাহমুদ : কবিতাই যাঁর ঐশ্বর্য
পৃথিবীর কলহ-বিবাদ-বিসম্বাদের পরিবর্তে কবি চান এক পরিশীলিত বিশ্ব। যার মমতা ও আলোর ছটায় মানুষ স্বস্তি পাবে এবং শান্তির পথ খুঁজে পাবে। তাই কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়-
‘হে বারুদগন্ধী মানচিত্র বন্ধ কর মৃত্যুর তামাশা
বন্ধ হোক ঝরে পড়া মরে যাওয়া হাওয়ার ক্রন্দন।
এই অন্ধ চোখ দুটি হয়ে যাক হেমন্তের খুব ভোরবেলা।
তোমার সবুজ থেকে
খুলে ফেল মৃত্যুর মেখলা।’
কাব্যরচনায় আত্মমগ্নতায় আল মাহমুদ ছিলেন সর্বদা সচল। তিনি কবিতাকে বিচিত্র রূপে প্রকাশ করেছেন। একেবারে তৃণমূল থেকে শুরু করে বিত্তবান পর্যন্ত যেকোনো মানুষের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে প্রেম-বিরহ, ভালোবাসা, কামনা-বাসনা, স্বপ্ন-উচ্ছ্বাস, ক্ষোভ, দ্রোহ-প্রতিরোধ ও প্রতিবাদী চেতনা তাঁর কবিতায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। প্রেম-বিরহ ও সংক্ষুব্ধতার পাশাপাশি তাঁর কবিতায় স্বাধীনতা, স্বদেশিকতা ও স্বদেশপ্রেম সমুদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। যেমন জেলখানার অন্ধকার আগুনের মধ্যে বসে কবির কষ্টবোধ এভাবে প্রকাশ পায়-
‘আমি জানি বাইরে এখন আকাল চলছে।
ক্ষুধার্ত মানুষ হন্যে হয়ে শহরের দিকে ছুটে আসছে।
সংবাদপত্রও না বলে পারছে না যে এ অকল্পনীয়।
রাস্তায় রাস্তায় অনাহারী শিশুদের মৃতদেহের ছবি দেখে
আমি কত দিন আমার কারাকক্ষের লোহার জালি চেপে ধরেছি।
হায় স্বাধীনতা, অভুক্তদের রাজত্ব কায়েম করতেই কি আমরা সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলাম।
আর আমাকে ওরা রেখেছে বন্দুক আর বিচারালয়ের মাঝামাঝি
যেখানে মানুষের আত্মা শুকিয়ে আয়।
যাতে আমি আমার উৎস খুঁজে না পাই।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল তাঁর গভীর শ্রদ্ধাবোধ। ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতায় তিনি বলেন-
‘সবাই চায় একজন রবীন্দ্রনাথ। কারণ তারুণ্যের ভাষা
যেহেতু প্রায় গাধার ডাকের মতো হয়ে উঠে
হাট-বাজার ভরিয়ে তুলছে। তখন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কে কোমলতার সঞ্চার করবে।’
অন্য লাইনে তিনি উচ্চারণ করেন-
‘আমরা বনসাই করা অশ্বত্থ গাছের মতো
ছোট বটগাছ চাই। যা বহন করা যায়,
সাজিয়ে রাখা যায়। কিন্তু বাজাতে গেলেই বিপদ।
কারণ সুরের প্রশ্ন উঠলেও রবীন্দ্রনাথ সমুদ্র নিয়ে
আমাদের ডুবিয়ে দিতে চান।
আমরা সব ছোটখাটো বিষয় চাই। সংক্ষিপ্ত।
আমরা কবিত্বের ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি চাই।
কিন্তু ঘূর্ণিঝড় চাই না। প্রবল মৌসুমি হাওয়ার
তোলপাড় চাই না। সুন্দরবন দেখলে ডরাই
আর গুনগুন করে গাই, তোরা যে যা বলিস ভাই,
আমার সোনার হরিণ চাই।’
আবার একজন কবিকে শুধু আবেগসর্বস্ব চিন্তানুসারী হলেও চলে না। তার চৈতন্যে যেমন সৃষ্টিশীলতার শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হয়, তেমনি পৃথিবী, ধরণিকুলের মানুষ ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা থাকতে হয়। প্রেম ও ভালোবাসার অনুভ‚তিকে আল মাহমুদ তাঁর কবিতাকে উচ্চশিখরে নিয়ে ছেড়েছেন। তিনি কবিতাকে এভাবেই স্পষ্ট করেন এবং চিরন্তন আবহের সঙ্গে সুযুক্ত করে দেন-
‘আমার উদ্ভাবনার টেবিলজুড়ে তোমার আনাগোনা। আঙুল
নড়ছে আর ফুটো হয়ে যাচ্ছে উপমা। আমি পারি না
তবু চায়ের কাপের সাথে, পারি না, তবুও ফুলদানির কাছে
সিদ্ধ ডিমের সাথে তোমার মুখকে রাখলাম।’
প্রেম নিয়ে এ রকম উপমা চিরন্তন এবং বিশ্বসাহিত্যসম্মত উচ্চমার্গের পঙ্্ক্তিমালা। আবার অন্য একটি কাব্যরচনায় জড়ের সাথে চৈতন্যের যুদ্ধকে দেখেছেন। যেমন ‘পিতৃপরিচয়’ কবিতায় তিনি তাঁর আক্ষেপের কথা উচ্চারণ করেন-
‘ও একবিংশ শতাব্দী,
কেন তোমার গর্ভিনীরা আর কোনো পিতার প্রয়োজন অনুভব করে না?
দলে দলে মানুষের শিশুতে ভরে যাচ্ছে পৃথিবী, অথচ-
ও অযোনিসম্ভব শতাব্দীর সন্তানেরা, তোমরা কি জানো
তোমরা কোনো নারীর মাতৃদ্বার থেকে নির্গত নও?
প্রসবদক্ষ সার্জনদের ছুরি মায়ের পেট কেটে
তোমাদের নামিয়ে দিয়েছে সর্বংসহা ধরিত্রীর ধুলোয়।
ও উদরছেঁড়া সোনা-মানিকের দল
বলো তোমাদের পিতৃপরিচয়? কারণ
এখনও পরিত্যক্ত প্রতিটি শতাব্দীর পাথরে উৎকীর্ণ দেখো
পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমং তপঃ
পিতরে প্রীতমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতা।’
আল মাহমুদ এ রকম অনেক কারণেই সার্থক কবি। কবিতায় তার সাহিত্যাদর্শের চিরন্তন দিকগুলো স্পষ্ট হয়ে ওঠার ফলেই তা জোরের সাথে বলতে পেরেছেন। বিশেষ করে, তাঁর আধুনিক কবিতার প্রতিটি বাঁক ঠিক রেখে সেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ধারায় চলমান। নব্বইয়ের দশকে কবিতার সঙ্গে গদ্যসাহিত্যের দিকে আল মাহমুদ ঝুঁকে পড়েন। এ সময় বেশ কয়েকটি উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর কথাসাহিত্যের সাবলীলতা ছিল বেশ ঝরঝরে এবং প্রখর। অমর একুশে বইমেলায় নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বই বিক্রির একচ্ছত্র আধিপত্যের মধ্যে দ্বিতীয় স্তরে মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও আল মাহমুদের বইয়ের বেশ কাটতি ছিল। এ বিষয়ে পরবর্তীতে হয়তো আলোচনা করা যাবে।
আল মাহমুদের কাব্যচেতনায় যেমন প্রেম-বিরহ, উচ্ছ্বাসের কথা স্পষ্ট, তেমনি তাঁর অনেক কবিতায় যন্ত্রণাদগ্ধ এক অসুখী মানুষের ছায়া স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যাঁর অনুভবে হৃদয় নিংড়িত বেদনাব্যাকুল কাতরতার সুর বাজে। তাঁর কবিতার ঐশ্বর্যে আমরা যেমন আনন্দ পাই, তেমনি তাঁর ওইসব কষ্ট ও দুঃখবোধ আমাদেরও ব্যথিত করে তোলে। কবিতা ও সাহিত্যরচনায় আল মাহমুদ যে শিল্পমান প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তা বাংলা সাহিত্যে অক্ষয় এবং অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।
(১১ জুলাই কবি আল মাহমুদের জন্মদিন উপলক্ষে প্রবন্ধটি রচিত)