আগস্ট ষড়যন্ত্রের ভেতর-বাইর
:: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান ::
প্রথমেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে যারা শাহাদতবরণ করেছেন তাদের সকলের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। এ বছরের যে জাতীয় শোক দিবস তার আলাদা তাৎপর্য হচ্ছে আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে এই দিবসটি ভাবগাম্ভীর্যের সাথে, মর্যাদাপূর্ণভাবে পালন করেছি। এ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, বিশেষ করে ষড়যন্ত্রকারীদের তালিকা অথবা ষড়যন্ত্র কারা করেছিল, কীভাবে ঘটনাটি ঘটল – এ নিয়ে অসংখ্য প্রকাশনা আছে, গবেষণা আছে। তারপরেও আমি মনে করি এই গবেষণাগুলো বা এই জানার পরিধিগুলো অত্যন্ত সীমিত। আসলে এটা একটি ব্যাপক গবেষণার বিষয়।
প্রথমেই বলি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে সামরিক অভ্যুত্থানটি হয় সেটা নিছক ক্ষমতা বদলের একটি সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না। ১৯৬০/৭০ এর দশকে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল করা- একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এবং আমাদের এই দিকটায় দক্ষিণ এশিয়া, থাইল্যান্ড থেকে আরম্ভ করে এই অঞ্চলেও। এমনও আছে যে, সামরিক বাহিনী কর্তৃক কোন কোন দেশে সপ্তাহে দুইবার ক্ষমতা বদল হয়েছে। এক জেনারেলকে মেরে আরেক জেনারেল ক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে যে সামরিক অভ্যুত্থানটি হয় এটা ওই ধরনের একটা ক্ষমতার হাতবদল অর্থাৎ একজনকে মেরে অন্যজনের শাসন কায়েম করা- এরকম কোন সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না। এটা ছিল একটি রাষ্ট্রকে বদল করার অভ্যুত্থান। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে অঞ্চলটা নিয়ে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এখানে অনেক ধরনের সামন্ত রাজা ছিল, ঔপনিবেশিক বিভিন্ন শাসকের প্রতিনিধিরা এখানে বিভিন্নভাবে শাসন করেছে। জমিদাররা ছিল, ভূঁইয়ারা ছিল।এই ঘটনাটি, আমাদের এই যে দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিকানা পেলাম জাতির পিতার নেতৃত্বে, সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই একটা ষড়যন্ত্র। অর্থাৎ রাষ্টকে বদল করার জন্যই এই ঘটনা ঘটানো হয়।
আমরা এই যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি পেলাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে এটা আকস্মিক কোন ঘটনায় তৈরি নয়, দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিকাশ ঘটে; এবং এক পর্যায়ে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের মালিকানা পাওয়ার জন্য যখন আমরা দীর্ঘদিন চেষ্টা বা সংগ্রাম করে যাচ্ছিলাম তখন পথে পথে বিঘ্নসৃষ্টিকারীরাও ছিল। এই আন্দোলন সংগ্রাম যেটা আমরা দেখি, যদি আমরা একদম অতীত ইতিহাসের দিকে নাও যাই, ৫২- এর ভাষা আন্দোলন থেকেও যদি আমরা শুরু করি, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে আন্দোলন সে আন্দোলনের বিরোধিতাকারী ছিল এই বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। ১৯৪৮ সালের কথায় আসি, ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তান পরিষদ অ্যাসেম্বলির মিটিং হয় লাহোরে।১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটি তৈরি হলো, একটি ছিল কৃত্রিম রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির রাষ্ট্রভাষা কি হবে? সবাই মিলে সেখানে প্রস্তাব নিয়ে এলো উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু একটা আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, এই অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী যারা এমএলএ ছিল তারা বাঙালি কিনা জানি না তবে বাংলা ভাষায় কথা বলত বেশিরভাগ। তারা সবাই উর্দুর পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল। কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছাড়া বাকি সবাই এই উর্দুকেই সাপোর্ট দিয়ে কলঙ্কিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে আমাদের যত আন্দোলন, Progressive ধারার যে আন্দোলনগুলো আমরা বলবো, আমাদের এই দেশে পহেলা বৈশাখ পালন হবে কিনা এর বিরুদ্ধে এখন যেমন বিরোধী গ্রুপ আছে তখনও তেমন ছিল। বেতারে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার হবে না- রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হল। পূর্ব পাকিস্তান সরকার যখন এই ফরমান জারি করল তখন এর বিরোধিতা করে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিলেন এটা অন্যায়, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে না দেয়া একটা গর্হিত অপরাধ। এটা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু এর পরদিন ৪০ জন বুদ্ধিজীবী যার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও ছিল, তারা বিবৃতি দিয়ে পাকিস্তান সরকারের এই রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করার ঘটনাকে সমর্থন করেছিল।
১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন কেবল স্বায়ত্ত্শাসনের দাবিনামা তথা বাঙালির মুক্তির সনদ ছিল।সেটারও কিন্তু বিরোধিতাকারী ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে নিজের ভুল শুধরে নেয়ার পরও মওলানা ভাসানী কিন্তু ৬ দফার বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ আমাদের যে আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস আছে বহুলোক সেগুলোর বিপক্ষে ছিল।
৭০- এর যে নির্বাচনের কথা ধরা যাক, ৬ দফার উপর ভিত্তি করেই এই নির্বাচন হয়।কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন যে আওয়ামী লীগ সেটি কিন্তু ৬ দফার পক্ষে ম্যান্ডেট চেয়েছিল ১৯৭০ – এর নির্বাচনে। ২৩.৪৩% লোক নৌকা মার্কা বা এই ৬ দফার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল। আর তারাই কিন্তু পরবর্তীতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গণ্য হয়, যাদের বিচার আমরা করেছি। স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা আমাদের মা- বোনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করেছে সেই পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে এই গোষ্ঠীরা কিন্তু রয়েই গেল এবং সেটা সংখ্যায় এক-চতুর্থাংশ। হতে পারে তাদের মধ্যে হয়ত ১০% মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধও করেছে। এটা হলো রাজনৈতিক ভাবে বাঙালিত্ব বা বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে যে অভ্যন্তরীণ বিরোধিতাকারী শক্তিটা ছিল তাদের পরিচয়।
এরপর আসা যাক বাইরের কথায়। ক্যান্টনমেন্টে আমাদের গণতন্ত্র, আমাদের স্বাধীনতা অবরুদ্ধ ছিল প্রায় ২০/২১ বছর। বিভিন্ন নামে সামরিক শাসক অথবা হ্যাঁ / না ভোট অথবা তথাকথিত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমেও আমাদের যে প্রধানমন্ত্রী হলো অর্থাৎ সামরিক শাসকরা তো ক্যান্টনমেন্টেই থাকত। নির্বাচনের নামে, প্রেসিডেন্টাল ইলেকশনের নামে হ্যাঁ / না- র নামে যেভাবেই হোক তারা ক্যান্টনমেন্টে ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯০ সালে যখন তথাকথিত গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচন হল, সেই নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীও কিন্তু ক্যান্টনমেন্টে থাকত।তারপরেও ১৯৯৬ সালের পরও বিরোধীদলীয় নেত্রীও ক্যান্টনমেন্টে থাকত। অর্থাৎ আমাদের যে রাজনীতি সেটা ক্যান্টনমেন্ট থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো।কোন কোন সময় সানগ্লাস, খালকাঁটা, এটা সেটা নামে। এর পরে আবার আটরশী পীর এবং হেলিকপ্টার ভ্রমণ, মেরির জগৎ- এগুলো কিন্তু কতগুলো সিম্বল। আমাদের সৌভাগ্য ১৯৮১ সালের ১৭ মে জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা ফিরে এলেন দেশে। তাঁর ফিরে আসার জন্য বহু প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। বহু ধরনের কণ্টকাকীর্ণ করা হয়েছিল তাঁর এই দেশে আসা এবং থাকা। কিন্তু সব প্রতিকূলতাকে সরিয়ে তিনি বাংলাদেশে এসে গণতান্ত্রিক আন্দোলন – সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে শুরু করলেন। আসলে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এই পূর্ব পাকিস্তানকে নতুন করে আবার বাংলাদেশে রূপান্তরের যে প্রক্রিয়া এটা শুরু হয় প্রকৃতপক্ষে ১৯৯৬ সালে।
অন্যদিকে ধর্মাশ্রয়ী যে রাজনীতি আমাদের এখানে এখন আছে সেই মুসলিম লীগ, জামায়তে ইসলাম তারা তো প্রকাশ্যেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানিদের সমর্থক। কিন্তু এর বাইরে আমি আগেই বলেছিলাম যখন এই সময়টা ৭০/৬০ এর দশক তখন পুরো বিশ্বে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ এবং কমিউনিজম এই বিষয়গুলো মানুষের মধ্যে আগ্রহের বিষয় ছিল। আর এই কমিউনিজম বা যেটাকে আমরা বলি সমাজতন্ত্র – এটার আবার দুটো ধারা ছিল একটা সোভিয়েত রাশিয়া, আরেকটা হচ্ছে চীন। চীন এখন আমাদের বন্ধু কিন্তু চীনের যে রাজনৈতিক প্রভাব, বা চৈনিক যে সমাজতান্ত্রিক গ্রুপগুলো এখানে ছিল, এর মধ্যে সর্বহারা পার্টি, হক-তোহা এরকম বিভিন্ন প্রকারের চীনাপন্থি কমিউনিস্ট যারা ছিল তারা কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলই না। বরং দুই কুকুরের কামড়া-কামড়ি এরকম কথা-বার্তা বলে তারা আলাদা অবস্থান নিয়েছিল। আর সেই অবস্থানটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে।তাদের নিজেদের মধ্যে পরস্পর বিরোধিতাও ছিল।সেই দুই পক্ষ, তিন পক্ষ, চার পক্ষের মধ্যে রেষারেষির কারণে গোলাগুলি করে প্রায়ই মানুষ মারা যেত। আর তাদের সবার আবার কমন শত্রু ছিল মুক্তিযোদ্ধারা। নোয়াখালীর চর অঞ্চলে বহু মুক্তিযোদ্ধা হত্যা করার জন্য এই চৈনিক কমিউনিজম বা যেটাকে আমরা বলি সমাজতন্ত্র কায়েম করার জন্য বন্দুক হাতে নিয়েছিল যারা , সেই দলগুলো কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। ৭১ এ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করার পর আমরা ১৯৭২ এ প্রথম বিজয় দিবস উদযাপন করি। ৭৩- এ আমাদের দ্বিতীয় বিজয় দিবস। এই বিজয় দিবসকে কালোদিবস ঘোষণা করে সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি। এর আগে তারা বিভিন্ন থানা লুট করা, মানিকগঞ্জের ঘিওরে, কুমিল্লায়, চট্টগ্রামে, সিলেটে থানা লুট, অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনাগুলো ঘটায়। ১৯৭৩ সালে আমাদের বিজয় দিবসকে কালোদিবস ঘোষণা করে দুইদিনব্যাপী হরতাল ঘোষণা করে। সদ্য স্বাধীন দেশের বিজয় দিবসে এই ঘটনা ঘটানো হয়। আর এই হরতালে অর্থাৎ সেই যে কালো দিবস ঘোষণা করা হয়েছে এটাকে সমর্থন করেছেন মওলানা ভাসানী ইতিহাস যার সাক্ষ্য দেয়। খুব নির্মোহভাবে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ না করলে পুরো ঘটনাটি বুঝে ওঠা কঠিন হয়ে যাবে।
এর বাইরে আজকে আমাদের অনেক জোট- ১৪ জোট, ১৬ জোট এই যে দল দিয়ে যে জোট করা হয়- এর মধ্যে যে অনেকগুলো দল ছিল, বিশেষ করে জাসদ; তাদের নেতৃত্বে যে হঠকারিতা হয়েছে, আমি বলব, জাসদ যারা করেছে বা জাসদ ছাত্রলীগ যারা করেছে তাদের মধ্যে অনেকে প্রচণ্ড মেধাবী ছিল কিন্তু সমস্যা ছিল নেতৃত্বের মধ্যে। তাদের যে কী উদ্দ্যেশ্য ছিল, তাদের কী পরিকল্পনা ছিল এবং তারা কী করতে চেয়েছিল, এই যে বিভ্রান্তি,এই বিভ্রান্তিতে পরে শত শত তরুণ কিন্তু জীবনও দিয়েছে। বরাবর তারা হঠকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে এবং হঠকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে গিয়ে রাষ্ট্রকে, সরকারকে এবং পুরো বাঙালি জাতিকে বিপর্যস্ত করেছে। আমি মনে করি এই চীনাপন্থি কমিউনিস্ট যারা ছিল তারা এবং পরবর্তী পর্যায়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে আ.স.ম আব্দুর রব, একই সাথে মেজর জলিল, মাহমুদুর রহমান মান্না থেকে শুরু করে হাসানুল হক ইনু এবং যারা যারা ছিল এই যে দলটা- এই দলের হঠকারি বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পরবর্তী পর্যায়ে ১৫ আগস্ট ঘটার জন্য একটা পটভূমি তৈরি করে দেয়; অর্থাৎ তাদের হঠকারিতা বিরাট একটি ভূমিকা রেখেছিল।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলা ভাষাভাষী অফিসারদের মাত্র ৮৭ জনের তালিকা পাওয়া যায়।যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। আর মুক্তিযুদ্ধের পরে ১১০০ সামরিক অফিসার পাকিস্তান থেকে ফিরে এসেছিল। এই ফেরত আসারা সুযোগ পেল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে।তারা অবশ্য সবাই যে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে ছিল তা নয়। তাদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বন্দিদশায় পাকিস্তানে ছিল। আসলে বাংলাদেশের যে ঘটনা প্রবাহ- এগুলোর অনেক কিছুই তারা জানত না। এটা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক এই যে, ১১০০ সামরিক বাহিনীর অফিসার এলো, এদের বাইরেও আরেকটা গোত্র ছিল। তাদের ৩৫-৩৭ জনের তালিকাও আছে। যারা পাকিস্তানের পক্ষে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছে।এদের মধ্যে অন্তত ৮-১০ জন রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নিকট পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ করার সময় উপস্থিত ছিল। অন্তত ৮ জন নিশ্চিত করে বলা যায় তারাও আত্মসমর্পণ করেছিল রেসকোর্স ময়দানে।পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল, তারা বাঙালি, বাংলা ভাষায় তারা কথা বলত।
এই কথাগুলো বলছি এই জন্য যে পুরো সামরিক বাহিনীতে যে অবস্থাটি তৈরি হয়েছিল সেটা বোঝাবার জন্য। যারা পাকিস্তান থেকে ফিরে এলো তাদের অনেকেরই আমাদের মুক্তিযুদ্ধে মানুষের যে আত্মত্যাগ সে সম্বন্ধে ধারণা ছিল না। আরেকটা হচ্ছে তাদের রেজিমেন্টেশন, তাদের ট্রেনিং, তাদের ওরিয়েন্টেশন- সেটাও একটি ধর্মাশ্রয়ী ভারতবিদ্বেষী ওরিয়েন্টেশন যা ওই অফিসারদের মধ্যে ছিল। এই ধরনের সামরিক প্রশিক্ষণ আমাদের দেশে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেওয়া হতো। শত্রু চিহ্নিত করার জন্য এবং শত্রুকে খুব সহজে চিহ্নিত করা হতো এই বলে যে, ভারতই আমাদের শত্রু। আর তাদের মধ্যে এক ধরনের মুসলিম লীগ মনোভাবাপন্ন মানুষ তৈরি করার জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণ, যে ধরনের তামিল দেয়া দরকার, সেটা কিন্তু আমাদের সামরিক একাডেমিতে ১৯৭৫ সালের পরও চালু ছিল, যা ১৯৯৬ সালের আগে পর্যন্ত বহাল ছিল।
অন্যদিকে যে ৩৪-৩৫ জন বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল, আত্মসমর্পণও করেছিল তাদেরকে কিন্তু বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন অজুহাতে, বিভিন্ন লোকের সুপারিশে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া হয়। এদের কেউ কেউ ডিআইজি পর্যন্ত হয়েছিল। যেমন রকিবুল হুদা, সে তখন চট্টগ্রামের কমিশনার। যার নির্দেশে জননেত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় গুলি করে ২৭ জন তরুণকে হত্যা করা হয়েছিল।। সেই রকিবুল হুদাও কিন্তু আত্মসমর্পণকারী দলের অর্থাৎ পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করে আত্মসমর্পণ যারা করেছিল তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
সমস্ত ষড়যন্ত্রটা বোঝার জন্যই আমার এই কথাগুলো বলা। এগুলো হয়তো ওতটা সক্রিয় হত না যদি এটার মধ্যে আন্তর্জাতিক মদদ না থাকত। কারণ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই ব্যাপক বিশৃঙ্খলা ছিল, আমাদের নিয়মিত বাহিনীগুলো সুশৃঙ্খল ছিল না, সংগঠিত ছিল না, আমাদের পরিবহন ব্যবস্থা খারাপ ছিল, আমাদের খাদ্য সংকট ছিল।তবে ক্রমান্বয়ে কিছুটা হলেও একটু উন্নতি হতে লাগল।
বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন যে, যেভাবে তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা চলছে তাতে দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব খুব দরকার।সোনার বাংলা হবে এমন- যেখানে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ থাকবে না, মানুষের মধ্যে সাম্য থাকবে। বৈষম্য কমে যাবে, এমনকি এক ধর্মের উপর অপর ধর্মের আধিপত্য- সেটা থাকবে না।বাঙালির যে ভালো দিকগুলো আছে সেগুলো বিকশিত হবে। এরকম একটি সমাজ তৈরি করার জন্য সমগ্র জাতির একটি ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস আবশ্যক। যার করণে বাকশাল বা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করেন তিনি।সমালোচনা করে কেউ কেউ বলে এই বাকশাল কায়েম করার কারণেই বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছিল।
আসলে বাকশাল সে অর্থে কোন রাজনৈতিক দল ছিল না। পুরো জাতিকে সংঘবদ্ধ করার জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়েছিল। যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী যারা বিভিন্ন জায়গায় ব্যাংক লুট, থানা লুট, পাট গুদামে আগুন দেয়া এই যে কাজগুলো করছিল সেগুলোকে প্রতিহত করার জন্যই জাতির পিতা মনে করেছেন একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক শক্তির দরকার- সেটারই একটি প্রতিফলন বাকশাল।বাকশালের যে অর্থনৈতিক কর্মসূচি সেটাও যদি বাস্তবায়ন করা যেত, কারণ এটি করা যায়নি এইজন্য বাকশালের পুরো অর্থনৈতিক কর্মসূচিটাই ছিল সাম্যের অর্থনীতি, বৈষম্যহীন অর্থনীতি। যেটা অনেকাংশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, সোভিয়েত ধাঁচের অর্থনীতি।সেই অর্থনীতির দিকেই যাচ্ছিল, সেটা কোন অবস্থাতেই যারা আমেরিকান বলয়, বিদেশি বলয়, তারা সহ্য করতে পারেনি। যার কারণে একটু বেটার অবস্থানের দিকে যাচ্ছিল দেশ, যখন সবকিছু প্রায় গুছিয়ে আনা হচ্ছিল, আমাদের বিধ্বস্ত পরিবহন যখন কিছুটা হলেও রিপিয়ার করা হলো, বন্দর থেকে যখন বিধ্বস্ত জাহাজ-গ্রেনেড-মাইন সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় অপসারণ করা হলো এবং খাদ্য উৎপাদন যখন সমবায় সমিতি বা অন্যান্য ভাবে এগিয়ে গেল- যখন আরও পরিকল্পিতভাবে এগোলো অন্য সব কাজ তখনই কৃত্রিম ভাবে ১৯৭৪ – এ খাদ্য সংকট তৈরি করা হলো। যে খাদ্য আমাদের দেশে আসার কথা ছিল বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায়, সেগুলো ঠেকিয়ে দেয়া হলো।সেগুলো সরিয়ে নেয়া হলো। অর্থাৎ কৃত্রিম ভাবে একটি খাদ্য সংকট দেখা দিল। এটাকে বলা হয় encirclement attack অর্থাৎ শত্রুরা চারিদিক থেকে বাঙালিত্বকে, বাঙালিকে, বাঙালির স্বাধীনতাকে আক্রমণ করল এবং তাদের সম্মিলিত প্রয়াসটি সফল হল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।
আমি মনে করি এটা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয় ছিল। জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার এবং সর্বশেষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এটা যখন শুরু হয় আমি আগেই বলেছি এই হত্যাকাণ্ডের যারা পৃষ্ঠপোষক ছিল, কয়েকদিন আগে যার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হল- ক্যাপ্টেন মাজেদের। তার যে সাক্ষাৎকার ইদানিং টেলিভিশনে দেখা যাচ্ছে, এটা দেখলে বুঝতে অসুবিধা হবে না পুরো ব্যাপারটির মধ্যে পরবর্তী পর্যায়ে যারা ক্ষমতাসীন হয়েছিল তাদের যোগসাজস ছিল। তারা যদিও বলে যে, হঠাৎ করেই লোকেরা রাস্তা থেকে নিয়ে এসে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে শুরুর থেকে চক্রান্ত – ষড়যন্ত্রের সাথে এই লোকগুলো বিশেষ করে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান একেবারেই সুস্পষ্টভাবে জড়িত ছিল। ক্যাপ্টেন মাজেদের সাক্ষাৎকারটির মাধ্যমে জাতির কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে যে, পুরো চক্রান্তের সাথে, ষড়যন্ত্রের সাথে এবং এটার ফল লাভের সাথে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিল। এই নিয়ে আর কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
যখন একটা পর্যায়ে খুনিরা বঙ্গভবন দখল করল তখনকার একটি মজার ঘটনা বলি, আমি এটা মুসা সাদিকের কাছে শুনেছি। জাতির পিতা আসলে কখনোই বিশ্বাস করতেন না বাঙালিরা অর্থাৎ যিনি জীবনের ১৩ বছর জেলে ছিলেন শুধু এই জাতি নির্মাণে, দেশের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য- সেই বাঙালিরা তাকে হত্যা করতে পারবে।ফলে এটা উনি কখনো আমলে নিতে পারেননি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বাঙালিরা তাঁকে হত্যা করেনি। মুসা সাদিক তখন বঙ্গভবনে চাকুরিরত ছিলেন। মুসা সাদিক এক সাক্ষাৎকারে, একটি বইয়েও আছে সেটা। আমাকে কসম করে বলেছেন, ‘‘মীজান ভাই বিশ্বাস করেন, আমার আব্বা একজন ইমাম, আমি কসম করে বলছি ১৫ আগস্টের পরে বঙ্গভবন যারা দখল করেছিল তারা কেউ বাংলায় কথা বলেনি। তারা উর্দুতে কথা বলেছে এবং কখনো কখনো ইংরেজিতে কথা বলেছে। ওখানে বাংলায় কথা বলার মত বাঙালি অফিসার ছিল না।” ওই খুনিরা যখন এক পর্যায়ে সমস্ত ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল, জেলহত্যা ঘটিয়ে ফেলল, এর মধ্যে ৭ নভেম্বরের ঘটনা ঘটল। একটার পর একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। একপর্যায়ে যখন এই খুনিদের দেশে রাখাটা তাদের, যারা মূল ক্ষমতার নেপথ্যে থেকে দখল করেছে তাদের জন্য নিরাপদ মনে করল না তখন তাদেরকে বিদেশে পাঠানোর একটি প্রক্রিয়া শুরু হলো। তাদেরকে প্রথমে থাইল্যান্ডে পাঠানো হল। জেনে আশ্চর্য হতে হয়, যারা থাইল্যান্ডে গেল তাদের কোন পাসপোর্ট, ভিসা এগুলোর কিছুই ছিল না। তাদেরকে ব্যাংকক থেকে লিবিয়ায় পাঠানো হয়। এবং সেখানে গিয়ে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অফিসার তাদের পাসপোর্ট এবং ডলার ওখানে দিয়ে আসে। পরবর্তী পর্যায়ে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চাকরিন্যস্ত করে দূতাবাসে কিভাবে চাকরি দেয়া হয় সেই তালিকা সবার কাছে আছে। এবং সেটা জাতির পিতার খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কিছুদিন আগে সাক্ষাৎকারে সে কিছু কথা বলে গেছে- তাদেরকে কিভাবে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে প্রমোশন দেয়া হয়েছে। আর ওই যে ৩৫ জন যারা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল তারাও সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। জিয়াউর রহমান বিভিন্ন সেক্টরে- কর্পোরেশন থেকে আরম্ভ করে পুলিশের সর্বোচ্চ পদ, এমনকি এনএসআইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে পাকিস্তানের পক্ষে যারা যুদ্ধ করেছিল সেই লোকগুলোকে বিভিন্ন জায়গায় নিযুক্ত করেছিল। এটা সুস্পষ্ট যে এই শক্তিটা পরবর্তী পর্যায়ে যেভাবে ছিল, এভাবে থাকাটা যখন নিরাপদ মনে করল না তখন তারা গণতন্ত্রের লেবাসে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আসার জন্য চেষ্টা শুরু করল এবং বিভিন্ন ধরনের ১৯ দফা, ১৮ দফা, এসব কর্মসূচির নাম দিয়ে বিভিন্ন লোকদের জড়ো করতে লাগল।এরকম অনেক দফার কর্মসূচি দিয়ে সেখানে ওই যে পাকিস্তানি দোসর আর বিশেষ করে চীনাপন্থি যারা ছিল সেখানে কাজী জাফর, মশিউর রহমান থেকে আরম্ভ করে মুসলিম লীগ ঘরানার শাহ আজিজ এবং সবুর খান থেকে শুরু করে সবার একটা সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হলো ১৯৭৯ সালে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল এভাবেই তৈরি করল জিয়া। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী বিভিন্ন অপশক্তির লোকেরা এসে এ দলটি গঠন করেছিল। তার সাথে এসে বিভিন্ন সময়ে মৌলবাদী জোট, ধর্মভিত্তিক জোট মিলে যায়। আমি আগেই বলেছি, এই চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারীরা যখন কোন সামরিক অথবা কোন ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড নিয়ে এগোয় বা কোন ধরনের বড় একটি অপকর্ম ঘটিয়ে কোন কিছু বদল করার জন্য চেষ্টা করে বা প্রতিহত করার চেষ্টা করে- তারা সবসময় ওই প্ল্যান, বি প্ল্যান, সি প্ল্যান, ডি প্ল্যান পর্যন্ত বিকল্প সব প্ল্যান রাখে। যখন আর কোনভাবেই শেখ হাসিনা অথবা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে একেবারে চিরতরে নিঃশেষ করা গেল না , তার সর্বশেষ চেষ্টাটা করল ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট সেই পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে। ২১ আগস্টের ঘটনার আগে পরে এই ফারুক- রশিদরা বাংলাদেশে এসেছে যারা জাতির পিতাকে হত্যা করেছিল। তারা কিন্তু তখনও এই বাংলাদেশে অবস্থান করেছিল। এই পুরো চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের সাথে ৭৫- এর যে খুনিচক্র তাদের একেবারে সাদৃশ্য বা চাক্ষুষ একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। আমরা যদি লক্ষ্য করি, যে ঘটনাগুলো আগে পরে ঘটে সেগুলো দিয়ে এবং যারা পরবর্তীতে এর সুফল ভোগী হয়, এটার সুবিধা ভোগ করে সেই বিষয়গুলো কেন করা হচ্ছিল, কারা এর দ্বারা উপকৃত হতো তাহলে দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুর যারা সহকর্মী বা যারা একেবারেই কাছের ছিল তাদেরকে তো বিভিন্নভাবে নিঃশেষ করা হয়েছিল।জেলখানায় জাতীয় নেতাদের হত্যার মতো সাম্প্রতিককালে যারা নেতা হিসেবে উঠে এসেছেন তাদেরকে একসঙ্গে অর্থাৎ সব আওয়ামী লীগ নেতাকে একসঙ্গে মেরে ফেলার চক্রান্ত করেছিল ২১ আগস্ট।
অতএব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে যারা যুদ্ধাপরাধ করেছে, আর যারা পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে তারা একই জগতের বাসিন্দা। তবে ১৫ আগস্ট এবং ২১ আগস্টের মাঝখানে আরও অনেক ঘটনা সেখানে ঘটেছে। বিভিন্ন স্থানে বোমা পুঁতে রাখা, চট্টগ্রামে গুলি করে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা এরকম ঘটনা অন্তত ২০ টা হবে। সরাসরি জননেত্রী শেখ হাসিনার উপর হামলা এবং তার ঘনিষ্ঠ নেতৃবৃন্দকে হত্যার যে ষড়যন্ত্র সেটা পরিপূর্ণভাবে কায়েম করতে চেয়েছিল ওই ২১ আগস্টে। একই ভাবে ১৯৭৫ সালে যেমন জাতির পিতার দুইকন্যা বিদেশে থাকার কারণে বেঁচে যান, অলৌকিক ভাবে শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের হামলা থেকেও বেঁচে যান। ২১ আগস্টে যদি তারা সফল হতো, তাইলে এই বাংলাদেশ হতো পাকিস্তান। আমি মনে করি, আবার একই গোষ্ঠী, একই লোকেরাই ঘটনাটি ঘটিয়েছিল। অতএব আমি বলবো সবগুলো ঘটনার একটি যোগসূত্র আছে এবং সেই যোগসূত্রগুলো যদি গবেষণার মাধ্যমে সুস্পষ্ট করা যায় তাহলেই আসল সত্যটি উন্মোচিত হবে।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান সাহেব যখন এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিল, সামরিক লেবাস ছেড়ে একটা তথাকথিত গণতান্ত্রিক লেবাসে চলে আসবে, তার জন্য রাজনৈতিক দল গঠন করা দরকার। তখন বিভিন্নভাবে, প্রথমে ডিজিএফআই এর সহযোগিতায় মেজর জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমান এবং এই জাতীয় মেজর জেনারেল- এগুলো কন্ট্রোল করত। সামরিক বাহিনীর বিগ্রেডিয়ার বা তার উচ্চ স্তরের কতগুলো লোককে নিয়ে সারাদেশের দলছুট যত লোক ছিল অর্থাৎ মুসলিম লীগ ঘরনার যত লোক ছিল যারা পাকিস্তানি Mental setup এর এবং কাজী জাফরের মত ওই বামপন্থি, চীনাপন্থি মশিউর রহমান, জাদু মিয়ার মত যারা যারা ছিল সবাইকে নিয়ে সম্মিলিত একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিল। প্রথমে ১৮ দফা না ১৯ দফা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পরবর্তীতে জাগোদল ইত্যাদি নাম দিয়ে শেষ পর্যন্ত বিএনপি নামক যে দলটি সেটা আত্মপ্রকাশ করল ১৯৭৮ সালে। দলটি প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে ১৯৭৯ সালে। ‘A legacy of blood’, Anthony mascarenhas রচিত বইটি, সেখানে বলা আছে, সেসময় ৩০০ জন যে প্রার্থী ছিল বিএনপির। এর মধ্যে ২৫০ জন ছিল দালাল গোত্রশ্রেণির।
একথাগুলো বলা এই জন্য যে, কারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল, আর বাংলাদেশকে পিছনের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল, পাকিস্তানের দিকে ধাবিত করল। সেই লোকগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য। আর যে চক্রান্ত, যে ষড়যন্ত্র, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে একটি রূপ লাভ করেছিল তা শেষ করার পরিকল্পনা ছিল শেখ হাসিনাকে খুন করার মধ্য দিয়ে। তিনি যখন দেশকে অগ্রগতির দিকে এবং প্রগতিশীলতার দিকে নেতৃত্ব দিতে লাগলেন অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানকে আবার যখন ঘুরিয়ে বাংলাদেশের দিকে নিয়ে আসার যাত্রা শুরু করা হলো তখনই কিন্তু ২১ আগস্টে আবার একই চেষ্টা করা হল। দালিলিক প্রমাণ আছে যে, ২০০৪ সালে যখন ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হয় তখন ওই ৭৫ এর খুনি ডালিম-রশিদরা বাংলাদেশে এসেছে, তাদের অবস্থান বাংলাদেশে ছিল। কিভাবে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হল, বিভিন্ন সময়ে সেগুলোতো আছেই। জিয়াউর রহমান সাহেব, এরশাদ সাহেব কিভাবে এদেরকে সহায়তা করেছে।
এই জন্যই তো বলেছি ১৯৭১ – এ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা, ১৯৭৫ – এ জাতির পিতাকে হত্যা এবং পরবর্তীতে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে পুরো আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে চেয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা, যেমনটি ৩ নভেম্বর জেলখানায় আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের হত্যা করা হয়।
২১ আগস্ট হলো একই প্রক্রিয়ার অংশ। পুরো আওয়ামী লীগ অথবা এই প্রগতির ধারা, আমাদের অগ্রসরমান চিত্র, বাঙালিত্বের ধারা, এখানে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র এগুলোতে অনেক ধরনের Reform, অনেক ধরনের পরিবর্তন,পরিমার্জন হয়েছে। তারপরেও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা সেটাকে ধারণ করার মতো একমাত্র দল হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্র যারা আছে। তাদেরকে একসাথে মিলে শেষ করার পরিকল্পনা করা হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। অতএব এটি একই সূত্রে গাঁথা। এই চক্রটা থেমে নেই। তাদের চক্রান্ত – ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। বিশেষ করে এখন আন্তর্জাতিক একটা ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এশিয়া সময় অতিক্রম করছে।এক সময় তো কেবল দুইটা বলয় ছিল একটা সোভিয়েত রাশিয়া বলয়, আরেকটি আমেরিকান বলয়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষমতা এবং তাদের মতাদর্শগত টানাপোড়েন এখনো কিন্তু আছে। বিশেষ করে এশিয়ান অঞ্চলে একে তো আছেই, আমাদের মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদিআরবসহ কয়েকটি দেশ তাদের পেট্রো ডলার এবং ডলারের সাথে সাথে তাদের মরু সংস্কৃতির রফতানি করা সেটা জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে হোক, মৌলবাদীর পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে হোক, সেই চেষ্টা কিন্তু অব্যাহত আছে। আর আমরাও এটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না এই জন্য যে, আমাদের প্রচুর লোককে কর্মসংস্থানের জন্য এই মধ্যপ্রাচ্য- বিশেষ করে সৌদিআরবসহ আশেপাশের কয়েকটি দেশে যেতে হয়। সেখান থেকে কেবল ডলার আসছে এটা মনে করার কোন কারণ নেই।এর সাথে সাথে তাদের যে মতাদর্শ তাদের সালাফি মতবাদ এটা রফতানি করার একটা প্রক্রিয়া। যেটার অংশ হচ্ছে এই জঙ্গিবাদ এবং অন্যান্য যে বিষয়গুলো।
আরেকটা ইস্যু হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বন্ধু ভারত। ভারত আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। তারা আমাদের ১ কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছিল। কিন্তু ভারত রাষ্ট্রটির এখন যে অবস্থা, বিশেষ করে এটার সরকার কাঠামো এবং মতাদর্শগত ভাবে যে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে- এইটা একটা ভিন্ন ধরনের মৌলবাদী রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে বর্তমান যে সরকারটি আছে সেই সরকার একেবারেই ওখানে একটা রামরাজত্ব কায়েম করার ঘোষণা দিয়েই বসেছে।
একটা দেশ যখন তার ধর্মকে প্রশাসনে বা রাজনীতিতে নিয়ে আসে এবং এটাকে যখন প্রাধান্য দেয় তখন আরেকটা দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদিতার উত্থান হয়।ভারত তো হবে হিন্দু রাষ্ট্র, পাকিস্তান বা বাংলাদেশে কেউ কেউ যদি বলে যে বাংলাদেশ হবে একটা ইসলামিক রাষ্ট্র- এই জায়গাটার মধ্যে কিন্তু একটা নতুন ধরনের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়ে যাবে। আরেকটা হচ্ছে যে চীন শুরুতে আমি বলেছি, স্বাধীনতার বিপক্ষে অন্যতম একটি শক্তি ছিল। তারা এখন আমাদের Development partner এবং সেই Development partner হিসেবে বিশেষ করে আমাদের পুঁজির জন্য গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এখন পুঁজি সঞ্চালন করতে পারে বা বিশ্বপুঁজিতে লগ্নি করতে পারে একমাত্র দেশই হচ্ছে চীন। আমাদের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচিতে তাদের অংশগ্রহণ আছে। এ অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়ছে।
আমরা একটা টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি।ইতোমধ্যে ভারত- চীন দ্বন্দ্ব এবং সৌদিআরবসহ ইসলামি দেশগুলোর উপর আমেরিকার আধিপত্য, এই সবকিছু মিলে যে ত্রিমুখী সংকট – বিশেষ করে ভারতের সাথে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক বজায় রাখা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। কারণ যত ঘটনাই ঘটুক না কেন, আমি বহুবার একথা বলেছি যে, অনেক কিছুই আপনি পরিবর্তন করতে পারবেন, বন্ধু যদি আপনার সাথে ঝগড়া করে, তার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছেদ করেন অথবা নতুন বন্ধু করতে পারেন অথবা কেউ যদি তার স্ত্রীর সাথে সমস্যায় পড়ে তবে ডিভোর্স দিয়ে আপনি স্ত্রী বদল করতে পারেন। কিন্তু কেউ প্রতিবেশী বদল করতে পারে না। প্রতিবেশী বদল করা যায় না। এই যে চীন এবং ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং পেট্রো ডলার অনুপ্রবেশ- ত্রিমুখী যে সংকটগুলো আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চলছে সেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকা প্রশংসনীয়।তিনি অনুসরণ করছেন জাতির পিতার পলিসি- পরাশক্তিধর যে কারও সাথে বৈরিতা নয় সবার সাথে বন্ধুত্ব। এটা দিয়ে অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে যাচ্ছেন তিনি। কারণ আমাদের অবস্থানটি এটিই হওয়া উচিত। কারও সাথে শত্রুতা নয়, সকলের সাথে বন্ধুত্ব।
আমি মনে করি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে খেলাটা বিশেষ করে এশিয়ান রিজিয়নে এখন চলছে, এটা অত্যন্ত মারাত্মক ষড়যন্ত্রে রূপ নিতে পারে। সেজন্য আমি বলবো যারা ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট ঘটিয়েছিল তাদের মধ্যে কিন্তু এই শক্তিগুলোর অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে এবং একইভাবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে বাংলাদেশের শক্তিকে, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করার জন্য অথবা বাঙালি নেতৃত্ব কিংবা বাঙালির চাওয়া ও অভিপ্রায়কে বাধাগ্রস্ত করার জন্য যে চক্রান্ত – ষড়যন্ত্রগুলো হচ্ছিল সেগুলো কিন্তু এখন আবার মাথা চাড়া দেওয়ার সম্ভাবনা এবং এগুলো আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার একটা সোর্স রয়েছে।বঙ্গবন্ধুর ৪৫ তম শাহাদাতবার্ষিকীতে আমাদের সবচেয়ে বড় সতর্কতার বিষয় হচ্ছে যে ওই টানাপোড়েনটা অর্থাৎ নতুন করে Geo Political যে টানাপোড়েন তৈরি হল এটা কিন্তু কখনো কখনো চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রে রূপ নিতে পারে। সেজন্য আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
(লেখক: অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান, উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং আহ্বায়ক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম)