আমেরিকায় আরোও ভয়াবহ খারাপ দিন আসছে হয়তো!
:: মোঃ নাসির ::
করোনাভাইরাস সারা বিশ্বের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে প্রায় ৮ লাখের বেশি মানুষের জীবন। করোনা মহামারিতে আক্রান্ত প্রায় ২ কোটি ৩৫ লাখ মানুষ। নিউইয়র্কে করোনার তাণ্ডব কমলেও এখনো আমেরিকার অধিকাংশ স্টেটে করোনা মহামারিতে লন্ডভন্ড জনজীবন। প্রতিদিন এখনো হাজার হাজার মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এবং জীবন দিচ্ছেন অনেকেই।
অনেকেই বলেছেন, নিউইয়র্ক সিটিতে এখনো করোনা রয়েছে। গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর দেয়া তথ্য অনুযায়ী নিউইয়র্কে করোনায় আক্রান্তের পরিমাণ ১ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। অর্থাৎ আমেরিকার মধ্যে বর্তমানে নিউইয়র্ক একটি নিরাপদ শহর। যদিও দ্বিতীয়বার করোনা হানা দিতে পারে এমন আশংকা রয়েছে। সেই কারণেই এখনো নিউইয়র্ক সিটির রেস্টুরেন্ট এবং পার্টি হলগুলো বন্ধ। মানুষকে চলতে হচ্ছে মাস্ক এবং গ্লাভস পরে। যদিও নিউইয়র্কের লংআইল্যান্ড এবং আপস্টেটের রেস্টুরেন্টুগুলো চালু করা হয়েছে। পার্টি হলও সীমিত আকারে খুলে দেয়া হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে সিটির স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া হচ্ছে। করোনার কথা বিবেচনা করে দুই স্টাইলে স্কুলে ক্লাশ নেয়া হবে- অন আইন এবং সীমিত ক্লাশের মাধ্যমে। একজন শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে তিন দিনের মতো ক্লাশে যেতে হবে।
করোনার কারণে মার্চের ২০ তারিখ থেকে নিউইয়র্কে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। প্রায় ১০০ দিন লকডাউনে থাকার পর সীমিত আকারে নিউইয়র্ক সিটি খুলে দেয়া হয়। জুনের ৮ তারিখ থেকে নিউইয়র্ক সিটি খুলতে থাকে। মানুষ ছিল অনেকটা গৃহবন্দী। ছিল না কোনো কাজ। থমকে যায় জীবনযাত্রা। আলোর নগরী নিউইয়র্ক পরিণত হয় ভুতুড়ে নগরীতে, লাশের নগরীতে। ঐ অবস্থায় সরকার পেন্ডামিকের জন্য প্রতিটি নাগরিককে সপ্তাহে ৬০০ ডলার করে অনুদান দেয়। সেই সাথে ছিল আনএমপ্লয়মেন্টের অর্থ ও জনপ্রতি ১২ শত ডলারের স্টিম্যুলাস চেক। ঐ সময় মানুষ ভালোই ছিল। কোনো অভাব ছিল না। চাকরি না থাকলেও মানুষ স্বচ্ছন্দে তাদের জীবন পরিচালনা করেছেন। কিন্তু জুলাই মাসের ৩১ তারিখ থেকে প্রায় সব সুযোগ-সুবিধাই হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়। স্টিম্যুলাস এবং পেন্ডামিকের অর্থ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিউইয়র্কবাসী চরম অভাবের মধ্যে পড়ে। নিউইয়র্ক সিটি অনেকটা নিরাপদ হলেও অধিকাংশ ব্যবসা বাণিজ্য, হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ। চাকরি নেই অধিকাংশ মানুষের। তারা চরম অভাবের মধ্যে পড়েছেন।
মানুষের এই দুর্দিনে সিটির পাশাপাশি অনেক মানবাধিকার সংগঠন খাদ্য সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসেন। তারা প্রতিদিন অভাবী মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করছেন। নিউইয়র্ক পোস্ট একটি প্রতিবেদন করেছে। সেই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যেখানে ফ্রি খাবার দেয়া হচ্ছে সেখানেই মানুষ লম্বা লাইন ধরছে। কোনো কোনো লাইন এক মাইলের বেশি লম্বা। আবার নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তারা লাইনে এসে দাঁড়াচ্ছেন। নিউইয়র্ক পোস্ট এসব লম্বা লাইনে অংশ নেয়া ব্যক্তিদেও স্প্যানিস এবং দক্ষিণ আফ্রিকান আমেরিকান বলে উল্লেখ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশি কমিউনিটির অবস্থাও অনেকটা একই রকম। কোথাও ফ্রি খাবার বা খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করতে গেলেই দেখা যায় লম্বা লাইন। এমন চিত্র নিউইয়র্কেও বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটস, জ্যামাইকা, ব্রঙ্কস, এস্টোরিয়াসহ অন্যান্য এলাকায় দেখা যায়। নিউইয়র্ক পোস্ট তাদের প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করেছে, খাবারের জন্য এই ধরনের লাইন দেখা যায় ১৯৩০ সালের দিকে। তাহলে নিউইয়র্ক সিটি কী আবারো ১৯৩০ সালের মতো অভাবের নগরীতে পরিণত হবে?
করোনার সময় এবং করোনা পরবর্তীতে নিউইয়র্কে বিভিন্ন বাংলাদেশি এবং বাংলাদেশি সংগঠন অসহায় মানুষের মধ্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করছে। তারা জানান, প্রচুর মানুষ অসহায়ের মতো আছে। তারা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। যাদের বড় পরিবার এবং চাকরি নেই তাদের অবস্থা খুবই খারাপ। বাসাভাড়া এবং অন্যান্য খরচ চালাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। বাংলাদেশিদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বলতেও পারছেন না, সইতেও পারছেন না। তারা জানান, প্রতিদিন খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হলেও সবাইকে দেয়া সম্ভব হবে না। তারা চরম কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।
নিউইয়র্ক পোস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মানবাধিকার সংগঠনের নেতা রডরিগার্স বলেন, ‘আমরা সপ্তাহে দুই দিন খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে থাকি। প্রথমে অল্পসংখ্যক মানুষ আসতেন। এখন জানাজানি হওয়ার পর দিন দিন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সকাল ৮টার সময় খাদ্য বিতরণ শুরু করি। আমরা দেখতে পাই মানুষ সকাল ৬টা থেকে এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। এখন আমরা প্রতিদিন এক হাজার মানুষের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করছি। সামর্থ থাকলে আরো দিতাম। দিনভর খাদ্য বিতরণ করলেও অভাবী মানুষের কমতি হবে না।’
খাদ্য নিতে আসা ড্যানিয়েল বলেন, ‘আমি একটি কোম্পানিতে কাজ করতাম। আমি থাকি ফ্লাশিং এলাকায়। এখন আমার চাকরি নেই। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৫ জন। একদিকে আগস্ট থেকে বাসাভাড়া দিতে পারছি না, অন্যদিকে খাবারের সময় আমার ছোট ছেলেটি আমার দিকে তাকায় তখন আর থাকতে পারি না। লাজ-লজ্জা ভুলে এখানে চলে আসি। যা পাই তা ভাগ করে আমরা খাই।’
রিগ্যান থাকেন করোনায়। তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা তিন। তিনি কমিউনিটি রেস্টুরেন্টে কাজ করতেন। তা দিয়েই সংসার চলে যেত। পেন্ডামিকের অর্থ বন্ধ হওয়ার পর সংসার আর চালাতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘আমার এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু নিয়তি আমাকে এখানে টেনে এনেছে।’
জনসন বলেন, ‘আমার কোনো কাগজপত্র নেই। আমি একটি ছোট কোম্পানিতে ক্যাশে কাজ করে সংসার চালাতাম। এখন আমার চাকরি নেই, এমনকি ফেডারেল বা সিটির কোনো অর্থ সাহায্য পাইনি। লকডাউনের পর থেকে আমি চোখে অন্ধকার দেখছি। আমি জীবনে এত অভাবের মধ্যে পড়িনি। এমন দু:সময় জীবনে আসবে তা কল্পনাও করিনি। তাই পরিবারের অন্য সদস্যদের নিয়ে এখানে দাঁড়িয়েছি। প্রতিদিন খবর রাখি কোথায় ফ্রি খাবার বা ফ্রি খাদ্যসামগ্রী দেয়া হচ্ছে। বাসার পাশে হলে হেঁটেই চলে যাই, দূরে হলেও হেঁটে যেতে হয় অভাবের কারণে।’
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, আদর্শবার্তা; নিউ জার্সি, আমেরিকায় বসবাসরত।