জীবন বড় বৈচিত্রময়, পর্ব-৮
:: মিজানুর রহমান মিজান ::
এস.এস.সি পরিক্ষা সমাপ্ত করে ফলাফল বের হবার পূর্বেই আমি সিলেট শহরের শেখ ঘাটে একটি দোকানে ম্যানেজার হিসাবে জীবনের প্রথম চাকুরীতে নিয়োজিত হই।এ সময়টুকু আমি থেকেছি মালিকের বাসায় সিলেট শহরে।আমার কর্মস্থল দোকানের উভয় পার্শ্বেই ছিল দু’টি হোটেল। উভয় হোটেলের অত্যধিক গরম আমাকে করে ফেলে কাবু। শরীরে এক প্রকার ফুসকার মতো লাল লাল চাকা এবং সাথে প্রকট চুলকানি। এ রোগটি আজো আমাকে গরমের মৌসুমে ভোগান্তিতে ফেলে দেয়। রোগাক্রান্ত হয়ে সে দোকানের চাকুরী ছেড়ে দিতে আমি বাধ্য হই।চাকুরি ছেড়ে অনেক চিন্তা ভাবনার পর উদ্যোগি হলাম ইংরেজি টাইপ রাইটিং শিখতে। সিলেট শহরের জিন্দাবাজারে প্রতিষ্ঠিত লিমিটেড টাইপ রাইটিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এক সাথে আমি ও দ্বীপবন্ধ নিবাসী সহপাঠি নজমুল হক টাইপ রাইটিং প্রশিক্ষণ নেই তিন মাসের কোর্স।ইত্যবসরে আমাদের এস.এস.সি পরিক্ষার ফলাফল হয়ে যায় প্রকাশিত। আমার জীবন চাকা ঘুরতে থাকে তালে বেতালে। সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকি অহরহ। কি করতে হবে, কি করব নাই আমার ভেবে কুল কিনারা। কখনও ভাবি লেখাপড়ায় টানব ইতি। পরক্ষণেই ভাবি লেখাপড়ায় লেগেই থাকবো। সময়ের স্বল্প ব্যবধানে আসে স্বপ্ন, আসে ভিন্ন চিন্তাধারা। এভাবে যায় দিন কেটে। ।ঈশান কোণে কাল মেঘে আকাশ যায় ঢেকে। ঘোর অন্ধকার, অমানিশার কালো থাবা পরিবেষ্টিত। দিক-বিদিক ছুটাছুটি। কবির কবিতার চরণ“ মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে”, “পারিব না পারিব না একথাটি বলিও না আর, একবার না পারিলে দেখ শতবার”। আমাকে স্বপ্ন দেখায়, স্বপ্ন যায় হারিয়ে নিমেষে।অনেক ভাবনা আর চিন্তার পর প্রভাত সূর্য সোনালী আভায় হল পূর্ব আকাশে উদিত। আমিও হলাম আশার ঘরে বাসা বেঁধে একটু নড়েচড়ে কোমর বেঁধে উদ্দীপ্ত। সিদ্ধান্ত নিলাম লেখাপড়া করার। এস.এস.সি পাশ করেছি মানবিক বিভাগে। কিন্তু তাই তরী ছাড়লাম রঙিন পালের পরিবর্তে সাদা পাল তোলে সামনে এগোনোর লক্ষ্যে।সিদ্ধান্ত নিলাম কলেজে ভর্তির সর্বশেষ তারিখে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে একাদশ শ্রেণিতে মদন মোহন কলেজে। বড় সাধ ও আশা ছিল লেখাপড়া নিয়ে। দু’মাস পরই হোচট খেলাম। তবে এ হোচট ছিল স্বল্প সময় ব্যাপি।অর্থের টানাপোডনে রামধানা নিবাসী এডভোকেট গিয়াস উদ্দিনের অধীনে মুহরীর হবার বাসনায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম কোর্টের বারান্দায়। প্রশ্ন দেখা দিল নাইট সেকশনে বিজ্ঞান বিভাগ নেই। কিন্তু আমি লেখাপড়া করতে হলে নাইট সেকশনে যেতেই হবে। তাই করে নিলাম গ্রুপ চেঞ্জ। মানে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে কমার্সে।শুরু হল যাত্রা।দিনে কোর্ট সন্ধ্যার পর পরই আমার কলেজ যাত্রা। জীবন নামক গাড়ির চাকা ঘুরছিল ট্রেনের মত ঝিক ঝিক করে।এখানে স্থায়ী হতে আমার মন সায় দিল না। দু’মাসের মতো সময় পার করে টানলাম কোর্টের জীবনের ইতি, যবনিকা।আবার ভাসালাম তরী লেখাপড়ার উদ্দেশ্যে।কাটিয়ে উটলাম মনের জোর, দৃঢ় একাগ্রতা ও মহান আল্লাহর কৃপায়।আবার ঝাঁপিয়ে পড়লাম নদীতে।কবির কবিতার চরণ আমায় দেখাল, শুনাল আশার বাণী। চরণ হচেছ, “ যেখানে দেখিবে ছাই , উড়াইয়া দেখ তাই, পেলে ও পেতে পার অমুল্য রতন”।তারপরও আমি মহান আল্লাহর নেয়ামতের কি শোকরিয়া আদায় করব, আমার মন-প্রাণ ঢেলে একাগ্র চিত্তে লাখ শুকরিয়া জানাই, আদায় করি নেয়ামতের।যা দিয়েছেন, হয়েছে যত কিছু অর্জিত সবই সে একক সত্ত্বার মালিক, মহান রাব্বুল আলামিনের, আমার সৃষ্টিকর্তার অবদান। আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট, তৃপ্ত। অতৃপ্তি নেই আমার মনে বিন্দু মাত্র।কারন অল্পতে তুষ্টি রয়েছে আমার বরাবরই।আমি সর্বক্ষণ ভাবি অত্যধিক যে কোন কিছু প্রাপ্তিতে, হারিয়ে ফেলতে পারি, ভুল পথে পরিচালিত হতে পারি অহংকার,অহমিকায়।
মহান আল্লাহ সবকিছু জ্ঞাত।১৯৭২ সাল থেকে ’৮১ সাল পর্যন্ত সময়ের ভিতর আমার তিন তিনটি বোন মারা যায় কলেরা, টাইফয়েড রোগে।ধৈর্য, সবুর করে পথ চলি আগামীর পানে, মনজিলে পৌছার অভিমুখে।
১৯৭৭ সালের শেষার্ধে আমি হয়ে গেলাম সিলেট-খাজাঞ্চি রেলওয়ের নিত্যদিনের যাত্রী। ভোর কখনও ছ’টায়, কখনও সাতটায় বাড়ি থেকে হেঁটে যেতাম খাজাঞ্চি রেলষ্টেশনে। অত:পর সিলেট। ফিরে আসতাম রাত দশ ঘটিকার ট্রেনে খাজাঞ্চিতে। তারপর ঝড়-বৃষ্টি, কাদা-পানি, অন্ধকার রাত্রের ভয়কে উপেক্ষা করে বাড়িতে পৌছা। কোন কোন দিন রাত ১/২টা বেজে যেত। আবার শুরু যাত্রা ভোরের আলো ফুটার আগেই রেলষ্টেশন অভিমুখে।এইতো জীবন, এইতো মাধুরী, এইতো চলা।১৯৭৯ সালে পাশ করলাম এইচ.এস.সি।এখানেও অনেককে পিছনে ফেলে আমার অগ্রযাত্রা থাকে অব্যাহত।তারপর আমি ও কান্দি গ্রামের ছালিক মিয়া এক সাথে যোগদান করি সিলেট সাব-রেজিস্টারী অফিসে নকল নবীশ পদে।দিন চলছিল এক মতো মন্দের ভালই।মাস শেষে বেতন প্রাপ্তি ছিল নিশ্চিত।এখান থেকেই আমার আগমণ উত্তর বিশ্বনাথ বনাম তেলিকুনা মাদ্রাসা।মাদ্রাসায় যে ক’দিন ছিলাম, মাওলানা ওলিউর রহমান’র একজন বিশ্বস্থ সহচর হবার যোগ্যতা করেছিলাম অর্জন।সকল প্রকার হিসাব-নিকাশ’র ভার ছিল আমার উপর অর্জিত।এ সময় ছোট একটি ম্যাগাজিনও বের হয়েছিল চাঁদা দাতাদের নাম সম্বলিত।মাদ্রাসায় তখন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন প্রিন্সিপাল মাওলানা শাহেদ আলী সুনামগঞ্জি, মাওলানা কমর উদ্দিন রাজাপুরী, মাওলানা আব্দুল লতিফ (আশুগঞ্জ বাজারে যিনি হোমিও ডাক্তার ছিলেন বেশ কিছুদিন আগে। এখন আছেন কিনা জানিনা।)ও আমি এক নগণ্য।মাদ্রাসা গৃহটি ছিল বাঁশের বেডাযুক্ত টিনের চালা বিশিষ্ট।চারটি কক্ষ ছিল বিদ্যমান।মাওলানা সাহেবের মেধা, প্রজ্ঞা,দক্ষতা ও সাংগঠনিক সক্ষমতা ছিল প্রখর।তিনির মতো লোক মাদ্রাসার পিছনে লেগে থাকায় আজ হয়েছে সুপ্রতিষ্ঠিত।তখনকার সময় প্রত্যেক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার শিক্ষকদের প্রদান করা হতো রেশন।প্রত্যেক শিক্ষকের থাকতো রেশন কার্ড।আমার নামে মাওলানা সাহেব কার্ড করে একদিন হাতে দেন তুলে। হয়েছিলাম সীমাহীন আনন্দে আপ্লুত।রেশন প্রাপ্তিতে আমার অনেক উপকার হয়েছিল তখন যাপিত জীবনের পথ চলায়।উত্তর বিশ্বনাথ স্কুলে গিয়ে এ কার্ড দিয়েই অনেক দিন রেশন উত্তোলন করেছি, সরকার কর্তৃক যত দিন রেশন ব্যবস্তা চালু ছিল।মাওলানা সাহেব তেলিকুনা গ্রামে আরো প্রতিষ্ঠা করেন তেলিকুনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।একটি গ্রামে পাশাপাশি দু’টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় কি পরিমাণ শ্রম, মেধা ও প্রজ্ঞা’র প্রয়োজন তা যে কেহ অনায়াসে হৃদয়ঙ্গম করতে অসুবিধা হবার কথা নয়।আমি যে ক’দিন তিনির সান্নিধ্য লাভ করেছিলাম, দেখেছি একনিষ্ট এক সাধক, বকধ্যানের তুল্য ছিল এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠার চিন্তায় নিমগ্ন।কি করলে, কার কাছে গেলে, কোথায় গেলে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, অগ্রগতি, সুন্দরতম পথ যাত্রার উম্মোচন সম্ভব তা নিয়ে ভাবতে।তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। আছে তিনির কর্ম প্রচেষ্ঠা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দু’টি শিক্ষার আলো বিতরণ কেন্দ্র।এখান থেকে প্রতিনিয়ত কম বেশি আলোকিত মানুষ হচেছন সৃষ্টি। আবার কেহ কেহ আলোকিত হয়ে আবারো এখানে এসে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে হচ্ছেন নিয়োজিত এবং আলো ছড়াচ্ছেন এলাকায়।
লেখক: সাবেক সভাপতি বিশ্বনাথ প্রেসক্লাব, বিশ্বনাথ, সিলেট।