প্রচ্ছদ

আমেরিকার ঐতিহ্য কি ফিরিয়ে আনতে পারবেন বাইডেন-কমালা ?

  |  ১৮:১০, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: মোঃ নাসির ::

আমেরিকার ২০২০ সালের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন বলা যায় একেবারে দোড়গোড়ায়। এক্সট্রা অর্ডিনারি কোনো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে নির্বাচন হবে ৩ নভেম্বর মঙ্গলবার। ট্র্যাডিশন অনুযায়ী নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

এবার আমেরিকার ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ দেশে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল থাকলেও প্রধান দুটি দল হচ্ছে ডেমক্র্যাটিক পার্টি ও রিপাবলিকান পার্টি বা জিওপি। বিশ্বাসের দিক থেকে ডেমক্র্যাটদের উদারনৈতিক বলে মনে করা হয়। রিপাবলিকানদের কনজারভেটিভ গণ্য করা হয়। বিশ্বাসের দিক থেকে যে দল যা-ই হোক, আমেরিকার স্বার্থ সব দলের কাছে সবার উপরে।

দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমেরিকার নির্বাচন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। তার মধ্যে প্রার্থী নির্বাচন। দ্বিতীয় টার্ম না হলে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী প্রায় চূড়ান্ত থাকেন। অর্থাৎ প্রথম টার্মের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টই দলের প্রার্থী থাকেন, যদি বিশেষ কোনো পরিস্থিতি দেখা না দেয়। এবার তাই রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও মাইক পেন্স।

ডেমক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নির্বাচনেও এবার প্রাথমিক বাছাইপর্বে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যায়নি। সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অনেকটা সহজেই দলের প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন। কৌতূহল ছিল ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কাকে পছন্দ করেন বাইডেন, সে নিয়ে। সে কৌতূহল নিবৃত্ত হয়েছে গত ১২ আগস্ট। ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর কমালা হ্যারিসকে জো বাইডেন তাঁর বাণিজ্য মেট হিসেবে নির্বাচিত করেছেন। ২০১৬ সালে হিলারি ক্লিনটনের রানিংমেট ছিলেন ভার্জিনিয়ার সিনেটর টিম কেইন।

কমালা হ্যারিসকে নিয়ে ডেমক্র্যাটিক দলে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। কমালা হ্যারিস সিনেট নির্বাচনেও অনেকটা ইতিহাস সৃষ্টি করে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর জন্ম, বড় হওয়া, শিক্ষা, সংস্কার সবই আমেরিকায়। তার পরও পেছনে লেগে আছে বংশোদ্ভূতের তকমা। কমালা হ্যারিসের পিতা জ্যামাইকান। মা ভারতীয়। জনসম্মুখে প্রথম ভাষণেই তিনি নিজেই বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। কোনো রকম রাখঢাক করেননি। মিসেস কমালা বলেছেন, উচ্চতর শিক্ষা নিতেই পিতা-মাতার এ দেশে আগমন। এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে রাজপথে তাদের পরিচয় ষাটের দশকে। যে বর্ণবাদ ও বৈষম্য আজও সমাজে রয়ে গেছে। যার বিরুদ্ধে এখনো আন্দোলন হচ্ছে। তাদের নিয়ে আমেরিকার জনগণ অত্যন্ত আশাবাদী ও আস্থাশীল।

প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জো বাইডেন বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জনগণকে বিভক্ত করছেন।’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনা সম্পর্কে তাঁর কথাবার্তা এবং অব্যবস্থাপনা দিয়ে সংকটকে গভীর করে তুলেছেন। আসলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ২০১৬ সালে নির্বাচিত হওয়া থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক করোনা সংকট নিয়ে যা বলছেন সবই প্রশ্নবিদ্ধ এবং জনস্বার্থবিরোধী বলে মনে করেন অভিজ্ঞ মহল। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রাক্্-নির্বাচনী চারটি জাতীয় বিতর্কের জরিপেই পিছিয়ে ছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিভিন্ন সংস্থা জনগণের মধ্যে যেসব জরিপ চালায়, সেসব জরিপের ফলাফলও তার পক্ষে ছিল না। নির্বাচনের দিন পর্যন্ত মানুষ আশা করেছিলেন ডেমক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনই জয়ী হবেন। কিন্তু অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়ে ঐতিহ্যগতভাবে পপুলার ভোটে হেরে গিয়েও ইলেকটোরাল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প সবাইকে হতবাক করে দেন।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েও ট্রাম্প তার নানাবিধ বিতর্কিত কার্যক্রম এবং কথাবার্তা অব্যাহত রাখেন। ১৯ জানুয়ারি শপথ নিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প প্রথমেই তার নির্বাহী আদেশে আঘাত হানেন অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। অভিবাসীবিরোধী পদক্ষেপে তার চূড়ান্ত প্রতিহিংসা প্রকাশ পায় মুসলমানদের বিরুদ্ধে। তিনি তার বিভিন্ন আদেশ ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে বারবার আদালত এবং জনবিক্ষোভের সামনে বাধাগ্রস্ত হলেও অভ্যাস থেকে ফিরে আসেন না। মানুষকে অবহেলা, অবজ্ঞা, অমর্যাদা করা, উল্টাপাল্টা কথাবার্তায় প্রাজ্ঞরা কেবল বিরক্ত নন, যাদের ভোট নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের অনেকেও ট্রাম্পের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। প্রাক্তন ৩ জন প্রেসিডেন্ট বুশ জুনিয়র, ওবামা ও ক্লিনটনও ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কর্মে বিতর্ক কখনোই তার পিছু ছাড়েনি। মুক্তবুদ্ধির মানুষ, সংস্কৃতিমান, প্রগতিশীল, সংবেদনশীল মানুষ এবং আমেরিকার ইতিহাস-ঐতিহ্যে বিশ্বাসী মানুষ সবাই তার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বাইরের যেসব দেশ তার বিজয়ের জন্য নৈতিক, অনৈতিক নানা পন্থায় ট্রাম্পকে সহযোগিতা করেছিল, তাদের মধ্যেও অনেকে এখন দূরে দূরে থাকছে। অনেকের সঙ্গে বিরোধেও জড়িয়ে গেছেন ট্রাম্প।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের ওপর নানা কারণে যারা বিরক্ত, আস্থাহীন তারা সবাই উজ্জীবিত ও উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন জো বাইডেন-কমালা হ্যারিসের ব্যাপারে। যারা ট্রাম্পের ওপর ক্ষিপ্ত! যারা ট্রাম্পের কাজে-কর্মে ক্ষতিগ্রস্ত, যাদের স্বপ্ন আজ দুঃস্বপ্নে পরিণত, তারা এখন ট্রাম্পের শাসন থেকে মুক্তি চান। অনেকেই বিশ্বাস করেন, বর্তমান বিশ্বব্যাপী যে করোনা মহামারি, আমেরিকা যাতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত, প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই যে মহামারি, সেই করোনা সংকট মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প ব্যর্থ। তার অব্যবস্থাপনা ও অবহেলায় সংকট আরও গভীর হয়েছে। ট্রাম্পের কারণেই বিশ্বব্যাপী আমেরিকার শ্রেষ্ঠত্ব, প্রভাব-প্রতিপত্তি, আমেরিকার কূটনীতি, ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অনেকের বিশ্বাস।

এই সবকিছু থেকে মুক্তি পেতে, আমেরিকা যে মানুষের স্বপ্নের দেশ, অভিবাসীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল, সেই বিশ্বাস ও আদর্শ ফিরিয়ে আনতে এখন আমেরিকার নাগরিক, বিদেশের মিত্র দেশ সবাই জো বাইডেন-কমালা হ্যারিসের ওপর ভরসা ও বিশ্বাস করতে চাইছেন। তারা আমেরিকাকে নেতিবাচক অবস্থা থেকে বের করে এনে পূর্বের মহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবেন বলে বিশ্বাস করতে চাইছেন। আজ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে সবাই হতাশ। বাইডেন-কমালা এরই মধ্যে আমেরিকাকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন। তাদের লড়াই, তাদের স্বপ্ন, তাদের ভবিষ্যৎ বাইডেন-কমালার স্বপ্ন, লড়াই একাকার। আমেরিকার রাজনীতিতে নতুন এক মাত্রাও যুক্ত হয়েছে তাদের ঘিরে।

জো বাইডেন-কমালা হ্যারিস পারবেন তো সবার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দিতে? নাকি ট্রাম্পের মতো হতাশ করবেন তারাও? তার চেয়েও বড় প্রশ্ন, নাকি এবারও ২০১৬ সালের মতো সবার সব প্রত্যাশা, সব স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যাবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে বিজয়ের মধ্য দিয়ে?

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, আদর্শবার্তা; নিউ জার্সি, আমেরিকায় বসবাসরত।