প্রচ্ছদ

হমিসাইড, সুইসাইড ও জেনোসাইড

  |  ১৯:৩৮, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২০
www.adarshabarta.com

:: শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ::

হত্যাকান্ড নিষ্ঠুর, তা যে কোনো প্রাণীরই হোক না কেন। যে কোনো প্রাণী তা হরিণ, কবুতর, হাতি, বানর, বুনোহাঁস যা-ই হোক তাকে হত্যা করা হলে প্রাণীটির বুক ও গলা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে; আর্তচিৎকারে কাতরাতে থাকে প্রাণীটি। তারপর একসময় প্রাণীটির শরীর নীরব হয়ে যায়। বেঁচে থাকার (নির্মম) প্রয়োজনে মানব প্রজাতির আমিষের দরকার হয়, আর সে প্রয়োজন মেটাতে তাকে দিনে নিদেন পক্ষে একবার ও সপ্তাহে কয়েক দফা মাছ-মাংস খেতে হয়। ফলে প্রতিদিনই হত্যার শিকার হয় অসংখ্য গৃহপালিত প্রাণী, নদী ও সমুদ্রের মাছ, বন্যপশু। মনে পড়ে মানবজাতির মহত্তম শিক্ষক ও দার্শনিক গুরু গৌতম বুদ্ধকে, যিনি আড়াই হাজার বছর আগেই বলেছিলেন, ‘জীব হত্যা মহাপাপ’।

যাই হোক, ‘অ্যানিমল রাইটস’ বা প্রাণী অধিকার বা পশু-পাখি হত্যার পক্ষ-বিপক্ষের যুক্তিতর্ক আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমি আলোচনা করতে চাই মানুষের হত্যাকান্ড নিয়ে, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘হমিসাইড’। আর এ ইংরেজি ‘সাইড’ শব্দটি ভয়ঙ্কর এক শব্দ; কেননা, ‘সাইড’ সমন্বয়ে গঠিত কয়েকটি শব্দ তো রীতিমতো মর্মান্তিক, যেমন ‘হমিসাইড’, ‘সুইসাইড’ ও ‘জেনোসাইড’। এর প্রথমটির অর্থ হত্যা, অবশ্য অন্য কারও দ্বারা; দ্বিতীয়টির অর্থ আত্মহত্যা; এবং তৃতীয়টির অর্থ অগণন মানুষের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ। সংখ্যাতাত্ত্বিক বিচারেও মানুষের সমাজ-সভ্যতার চলমানতা, ও ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের ওপর এ তিন ধরনের হননকান্ডের অভিঘাত নানামুখী, নানামাত্রিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডির হিসাব অনুযায়ী নানা কারণে প্রতি বছর ৮ লাখ লোক আত্মহত্যা করছে। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করছে! বয়স্ক ও তরুণ- এ দুই বয়সের মানুষের মধ্যেই আত্মহত্যার প্রবণতা অধিক পরিলক্ষিত হয়; আবার লিঙ্গভিত্তিক বিভাজনে আত্মহত্যার প্রবণতা নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে দ্বিগুণের বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৭ সালে প্রতি লাখের মধ্যে নারী আত্মহত্যার হার ছিল ৬.৩, অথচ পুরুষ আত্মহত্যার হার ১ লাখের মধ্যে ছিল ১৩.৯।

বিভিন্ন দেশের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, প্রতি বছর ৪ লাখের বেশি মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হয়। গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজের স্টাডি অনুযায়ী ২০১৭ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৪ লাখ ৫ হাজার মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে, যা সশস্ত্র সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসী হামলায় নিহত মানুষের সম্মিলিত সংখ্যার তিন গুণ বেশি। কোনো কোনো দেশে মার্ডার বা হত্যাকান্ডই মানুষের মৃত্যুর বড় একটি কারণ। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ২০১৭ সালে ভেনেজুয়েলায় হত্যাকান্ড ছিল মৃত্যুর তৃতীয় বৃহৎ কারণ, হন্ডুরাসে চতুর্থ ও গুয়েতেমালায় পঞ্চম বৃহৎ কারণ। প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ হত্যাকান্ড হয়, তার হারে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পশ্চিম ইউরোপ, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যে বছরে প্রতি ১ লাখ জনে হত্যাকান্ডের হার একজনের কম। অথচ এল সালভেদর, ভেনেজুয়েলা, হন্ডুরাস, গুয়েতেমালা ও মেক্সিকোয় এ সংখ্যা প্রতি ১ লাখে ৩০।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে প্রতি লাখে হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল ২.৪ জন।

হত্যাকান্ডের জন্য বিভিন্ন দেশে রয়েছে হমিসাইড ল। হত্যাকান্ডের নৃশংসতা ও হত্যাকারীর ইচ্ছা বা সংকল্পের দৃঢ়তার ওপর ভিত্তি করে হত্যাকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করা হয় এবং শ্রেণিবিভাজিত হত্যার জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তি। ইচ্ছাকৃত ও নৃশংসতম হত্যার জন্য রয়েছে সর্বোচ্চ দন্ড; কোনো দেশে এটি মৃত্যুদন্ড, কোনো দেশে যাবজ্জীবন আবার কোনো দেশে এটি প্যারোলসহ ১০ বছরের অধিক কারাদন্ড। ব্রিটেনে হত্যাকান্ডকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়- মার্ডার ও ম্যানস্লটার; প্রথমটি বেশি নৃশংস, দ্বিতীয়টি কম নৃশংস। সুস্থ মস্তিষ্কের কোনো ব্যক্তি অপরাধমূলক ইচ্ছা নিয়ে কাউকে হত্যা করলে তাকে বলে হমিসাইড বা মার্ডার। মার্ডারের ক্ষেত্রে গিল্টি ইনটেনশন বা অপরাধমূলক ইচ্ছা থাকতে হবে; এবং অপরাধমূলক ইচ্ছার অনুপস্থিতিতে হত্যাকান্ডটি হবে ম্যানস্লটার, আর সেজন্যই এটি কম নৃশংস বা দ্বিতীয় ডিগ্রির হত্যাকান্ড।

যুক্তরাষ্ট্রে হত্যাকান্ডকে দুই শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে- ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার ও সেকেন্ড ডিগ্রি মার্ডার। ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার বা প্রথম মাত্রার খুন অধিক নৃশংস বলে এ অপরাধে দায়ী ব্যক্তিকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। কোনো ব্যক্তি যখন পূর্বপরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় অপরাধমূলক অভিপ্রায় নিয়ে কাউকে হত্যা করে, তাকে প্রথম মাত্রার হত্যাকান্ড বলে। বাংলাদেশের দন্ড আইনেও হত্যাকান্ডের দুটি বিভাজন আছে। একটি ‘কালপাবল হমিসাইড অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার’; অন্যটি ‘কালপাবল হমিসাইড নট অ্যামাউন্টিং টু মার্ডার’।

এরপর আসা যাক জেনোসাইড বা গণহত্যা প্রসঙ্গে। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে ৫০ থেকে ৭০ মিলিয়ন অর্থাৎ ৫ থেকে ৭ কোটি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৯৪ সালে হুতু ও তুতসিদের দ্বন্দ্বে তিন থেকে ছয় মাস সময়ের মধ্যে ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এ-দেশীয় দোসররা নয় মাসে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীর ১৫টি ভয়াবহতম গণহত্যায় ১৫ কোটি ৮৩ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়।

হত্যা, গণহত্যা ও আত্মহত্যার ইতিহাস হচ্ছে ব্যক্তিক, পারিবারিক ও সামষ্টিক বিয়োগান্ত ঘটনার আলেখ্য। হত্যাকান্ডের শিকার ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের স্বজনদের কান্না ও আর্তচিৎকার থেকে আমরা বুঝতে পারি প্রতিটি হত্যাকান্ড কতটা মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক। আর গণহত্যার ইতিহাস পড়লে তো আমরা শিউরে উঠি। কী করে মানুষ তার নিজ প্রজাতির হাজার হাজার, লাখ লাখ, কোটি কোটি মানুষকে পাখির মতো গুলি করে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে, কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে! কী করে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হন্তারক চেঙ্গিস খান ও তার সৈন্যরা ২৪ ঘণ্টায় ১২ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- মানুষ কেন হত্যা করে? কেন মেতে ওঠে তারই ভ্রাতৃপ্রতিম মানুষের গণহত্যায়? এমন কী পরিস্থিতি তৈরি হয় যখন মানুষ নিজেই তার নিজের জীবন নিয়ে নেয় বা নিয়ে নিতে বাধ্য হয়? কোনো সুইসাইড নোট বা প্রামাণিক কারণ না থাকলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছে, সে ছাড়া আত্মহত্যার কারণ জানা সম্ভব নয়। কোনো কোনো আলোড়ন সৃষ্টিকারী আত্মহত্যা নানা অনুমান ও রহস্যের ডালপালা বিস্তৃত করতে জ্বালানি সরবরাহ করে থাকে। রহস্য উন্মোচন করতে রচিত হতে পারে গ্রন্থ, লেখা হতে পারে প্রবন্ধ এবং অবতারণা করা হতে পারে সুবৃহৎ গবেষণার; যেমনটি হয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে।

গণহত্যা ইতিহাসের এক অনিবার্য ও অন্ধকার দিক। অনিবার্য বলছি এ কারণে যে, মানুষের ইতিহাসের আদিকাল থেকে ক্ষমতা, আধিপত্য ও দখলকে কেন্দ্র করে গোত্রে গোত্রে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে যুদ্ধ, হানাহানি ও সশস্ত্র সংঘাত ছিল, এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণ আপাতত দৃশ্যমান নয়। ব্যাপক বিধ্বংসী হলেও যুদ্ধ ও হানাহানির বিপদ ও অনাচার থেকে মানুষ নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। সারা পৃথিবী যখন করোনাভাইরাস-সৃষ্ট মহামারীর কারণে অস্বাভাবিক একটি সময় অতিক্রম করছে, তখনো সিরিয়ায় যুদ্ধ চলছে। সন্ত্রাসী হামলা চালানো হচ্ছে আফ্রিকার অনেক দেশে। চীন ও ভারতের মধ্যে লাদাখের দখল নিয়ে এক দফা যুদ্ধ হয়ে গেছে। কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চলছে, সৌদি আরব হামলা চালাচ্ছে ইয়েমেনে, ইয়েমেনও হামলার জবাব দিচ্ছে নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি মিসাইল দিয়ে।

স্মর্তব্য যে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারী শুরু হওয়ার পরও বিশে^র শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো নিবৃত্ত হয়নি প্রথম বিশ^যুদ্ধ থেকে; এবং ওই মহামারীতে ১০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। করোনাভাইরাস-সৃষ্ট মহামারীর সময়ও বন্ধ হয়নি সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন, কাশ্মীর, ফিলিস্তিন ও লাদাখের সশস্ত্র সংঘাত। এর মধ্যেই দক্ষিণ চীন সাগরের মালিকানা ও আধিপত্য নিয়ে চীনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, ভারত ও জাপানের তুমুল উত্তেজনা শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে- পৃথিবী কি আবারও বড় ধরনের সংঘাত, হত্যা ও রক্তপাতের দিকে এগিয়ে চলেছে?

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক।