জীবনের কথা, পর্ব-৪৮
লন্ডনের বাংলা টাউন আর বৈশাখী মেলার আয়োজন নিয়ে শংকা জাগে মনে
:: মো. রহমত আলী ::
আমার সৌভাগ্য যে, লন্ডনের বাংলা টাউন ও বৈশাখী মেলা দু’টির উদ্বোধনের সময় আমি একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। এ দু’টি বিষয় বিলাতের বঙালীদের মধ্যে যতটানা আনন্দ উচ্ছাস লক্ষ্য করা যায় তার চাইতে বেশী বাংলাদেশসহ বহির্বিশে^র বাঙালীদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। আর হওয়ারই কথা কারণ বৃটেনের একমাত্র চায়না টাউন ছাড়া অন্য কোন দেশের নামে কোন টাউন গড়ে উঠেছে বলে আমার জানা নেই।
অনুরুপভাবে কালো সম্প্রদায়ের লোকদের কার্নিভ্যাল ছাড়া অন্য কোন দেশের নববর্ষ নিয়ে কোন মেলা অনুষ্ঠিত হতেও আমি দেখিনী। ভারত বা পাকিস্তানী সম্প্রদায় চেষ্টা করেও তা বাস্তবায়িত করতে পারে নাই বলে শুনেছি। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্য কোন দেশ তো কল্পনাই করে নাই।
বাংলাটাউন প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯৭ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। তবে এর পূর্বে অনেক কাজ করতে হয়েছে এটা বাস্তবায়নের জন্য। এ পর্যায়ে যাদের ভূমিকা সবচাইতে বেশী তারা হচ্ছেন, সে সময়ে স্থানীয় টাওয়ার হ্যামলটেস কাউন্সিলের বাঙালী কাউন্সিলরবৃন্দ। প্রশাসনিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও সরকারী পর্যায়ের যাবতীয় স্বীকৃতি আদায় করতে স্থানীয় কাউন্সিলে তারা রীতিমত নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতে হয়েছে। বলা হয়েছিল বিভিন্ন জাতী গোষ্ঠীর আবাস্থল এই বৃটেনে কোন একটি মাত্র সম্প্রদায়ের লোকজনের জন্য কিছু বাস্তবায়িত হলে অন্যরা তাতে হীনতা বোধ করবে তাই এটা না করাই ভাল। কিন্তু এরপরেও বাঙালী কাউন্সিলারগণ অন্য সম্প্রদায়ের কাউন্সিলারদের সহযোগিতা আদায় করে তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়েছেন। তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন, কাউন্সিলর রাজন উদ্দিন জালাল, কাউন্সিলার গোলাম মর্তুজা, কাউন্সিলার মোহাম্মদ আলী,কাউন্সিলার সৈয়দ মিজান, কাউন্সিলার আতাউর রহমান, কাউন্সিলার সোনাহর আলী প্রমূখ । অন্য যারা সহযোগিতায় ছিলেন, তাদের মধ্যে মাইকেল কীথ, কাউন্সিলর আলবার্ট জেকব, কাউন্সিলার মার্ক টেইলন ও কাউন্সিলার ডেনিস জোনস প্রমূখ। এর সাথে বাংলাদেশ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন ও ব্রিকলেন বিজনিস এসোসিয়েশনের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য। আরো অনেক সংগঠন বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে যাতে বাঙালী কমিউনিটির নেতৃবৃন্দও যোগ দেন। সাথে সাথে কাউন্সিলের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষেরও সংশ্লিষ্টতা ছিল।
প্রথমে বাংলাটাউন পরিকল্প বা বাস্তবায়নের জন্য কাউন্সিলের পক্ষ থেকে একটি উপকমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির দায়িদ্ব ছিল বাংলাটাউনের রূপরেখা ও ভবিষ্যৎ কর্মপস্থা নিয়ে কাউন্সিলকে একটি বাস্তবধর্মী পরামর্শ দেয়া। এ কমিটির সুপারিশ মোতাবেক যে সমস্ত পরিকল্পনা করা হয় তার মধ্যে ছিল, রাস্তার উভয় পার্শে লাইট পোস্টগুলিতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার লাল ও সবুজ রং এর সাথে সোনালী আভায় সজ্জিত করা, একটি তোরণ নির্মাণ, এ এলাকার সবগুলি রাস্তার নামে ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলা নামকরণ করা ইত্যাদি। তা ছাড়া বাংলাটাউনের উপযুক্ত একটি স্থানে বাংলাদেশের আদলে, সুপারীগাছ, নারিকেল গাছ, কাঠাল গাছ সহ অন্যান্য গ্রামীন অবকাঠামো তৈরী করা। তা ছাড়াও পর্যটকদের জন্য টাওয়ার ব্রিজ থেকে ব্রিকলেন পর্যন্ত রিক্সা সার্ভিসের ব্যবস্থা করা।
এ সমস্ত কার্যক্রমের কিছুটা উদ্বোধনের সময় বাস্তবায়িত না হলেও পরবর্তীতে তা করা হয়। এর সাথে মেয়র লুৎফুর রহমানের সময়ে ব্রিকলেন জামে মসজিদ সংলগ্ন একটি বড় লাইট পোস্ট এ এলাকার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধিতে আরো ভূমিকা রাখে। তবে এর নামকরণে কিছুটা বিলম্ব করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত শুধু বাংলাটাউন না করে উক্ত ওয়ার্ডের নামের সাথে সংযুক্ত করে ‘স্পীটালফিল্ড বাংলাটাউন‘ করা হয়। তবে এ নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। তাদের ধারণা ছিল বাংলাটাউন নামকরণ কোন সময় নির্বাসনে চলে যাবে নামের অন্য অংশ যুক্ত থাকলে। এক সময় সে প্রচেষ্টাও হয়েছে। বাংলাটাউন মূছে ফেলার ষড়যন্ত্র হয়েছে। তবে বাঙালীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ফলে তা সম্ভব হয়নি। এরপর এটাকে “প্যারিশ টাউন” করারও পকিল্পনা করা হয়। কিন্তু অবস্থা বেগতিক দেখে উদ্যোক্তারা তাদের পরিকল্পনা থেকে সরে যান।
তবে সবচইকে বড় কথা হলো পূর্বে যেখানে এ এলাকার বাঙালী ব্যবসায়ীদের আধিক্য ছিল তখন তা বিভিন্ন কারণে কমে যাচ্ছে। তাই আগামীতে এ নিয়ে অনেকের মত আমারও শংকা জাগছে বাঙালীদের লালিত এ স্বপ্নগুলি কতদিন টিকে থাকবে ও আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করে চলবে।
এ বাংলা টাউনের উপর ভিত্তি করেই এখানে বৈশাখী মেলা আরম্ভ হয়েছিল এক সময়। যদিও এর আগে তা বাংলাদেশ মেলা হিসাবে অনুষ্ঠিত হতো দেশ বিকাশ নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে। প্রথমে স্থানীয় ব্যবসায়ি পরে বৈশাখী মেলা ট্রাস্ট উদ্যোগে এবং এখন টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের ব্যবস্থাপনায় তা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এ মেলাটি প্রথমে ব্রিকলেন, পরে আলতাব আলী পার্ক ও এ্যালেন গার্ডেন নিয়ে তা সম্প্রসারিত করা হয়। এরপর স্থান সংকুলান না হওয়ায় সেটা স্থানীয় বড় পার্ক উইভার্স ফিল্ডে স্থানান্তরিত হয়। এরপর কিছু দিন তা ভিক্টোরিয়া পার্কেও অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে তা আবারও উইভার্সফিল্ডে অনুষ্ঠিত ফিরে এসেছে। তবে তা বৈশাখী মেলা নামকরণ হলেও বাংলাদেশে যখন বৈশাখ মাস থাকে তখন তা অনুষ্ঠিত হয়না। এর কারণ তখন বৃটেনের আবহাওয়া কিছুটা ঠান্ডা থাকে। এ জন্য তা মে অথবা জুন মাসে অনুষ্ঠিত হয়। কোন কোন সময় তারও কিছু পরে হয়।
বাংলাটাউন ১৯৯৭ সালের ১২ অক্টোবর উদ্বোধন করা হলেও তা লোকাল গভর্ণমেন্ট কমিশন কর্তৃক ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে, এ টাউনে একবার বোমাও বিস্ফোরিত হয়েছিল। তারিখ ছিল ১৯৯৯ সালের ২৪ এপ্রিল। এতে কয়েকজন হতাহত হয়েছিল। বর্ণবাদী নাৎসী সন্ত্রাসীরা এ কান্ড ঘটিয়েছিল যাতে এখান থেকে এশিয়ানরা চলে যায়। তবে তাতে বাঙালীদের সাথে সাথে বৃটেনের শেতাঙ্গরাও নিন্দা করেছিলো।
বাংলা টাউনে বাঙালী নামে আরও যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেগুলি হচ্ছে, কবি নজরুল সেন্টার, ব্রিকলেন মসজিদ, আলতাব আলী পার্ক। এর অনতি দুরে রয়েছে ওসমানী স্কুল ও বঙ্গবন্ধু স্কুলসহ বাঙালীদের নানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তবে সেগুলিও কালের পরিক্রমায় কতদিন টিকে থাকবে সে শংকাও আছে আমার মনে। কারণ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নাড়ির টান অন্য জায়গায়। তারা এ সবের ধার ধারে না অথবা সেগুলির ইতিহাস জানে না।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com