জীবনের কথা, পর্ব-৫১
এবারে বৃটেনের রাণীর খেতাব প্রাপ্ত বাঙালীদের মধ্যে ব্যতিক্রমী শতবর্ষী দবিরুল ইসলাম চৌধুরী
:: মোঃ রহমত আলী ::
প্রতি বছর বৃটেনের রাণীর জন্ম দিনে যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা বিশেষ অবদান রাখেন তাদের সম্মানিত করার একটা রেওয়াজ বহুদিন যাবৎ প্রচলিত রয়েছে। এ সম্মান বিভিন্ন উপাধিতে প্রদান করা হয়ে থাকে। যেমন নাইটহুড (স্যার), সিবিই, ওবিই, এমবিই প্রর্ভতি। এ গুলির আলাদা আলাদা নামকরণে বিশেষ বিশেষ মর্যদা রয়েছে। যার মাধ্যমে যিনি এটা লাভ করেন তা তাঁর কার্যের উপর ভিত্তি করেই প্রদান করা হয়ে থাকে।
জানা যায় বৃটেনের রাজা পঞ্চম জর্জ প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে অনেক সাধারণ মানুষকে সম্মান জানানোর পদক্ষেপ নেন। আর সে হিসাবে প্রথমে মাত্র একটি বিষয়ে ১৯১৮ সালে সম্মাননাটি প্রদান করা হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে এটি সামরিক এবং সাধারণ নাগরিক – এ দুটি অংশে বিভাজিত হয়ে যায়।
তবে অন্যান্যের মত বাঙালীরাও এ খেতাব লাভ করে থাকেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য। প্রতি বছরই একাধিক পুরুষ বা মহিলা এ সম্মান লাভ করে থাকেন। এত তারা সম্মানিত বোধ করেন ও নামের শেষে এ সমস্ত পদবী যুক্ত করে অনেকটা নতুনভাবে নিজকে আত্মপ্রকাশ করার প্রচেষ্ঠা চালান। এ সম্মান প্রাপ্তি উপলক্ষে তাদের জন্য কমিউনিটির পক্ষ থেকে নানাভাবে সংবর্ধনার আযোজন করা হয়ে থাকে। দেশে গেলেও তারা বিশেষভাবে সম্মানিত হন। মনে করা হয়ে থাকে যে, ব্রিটিশরা একদিন আমাদেরকে শাসন শোষন করেছিল তারাই এখন আমাদেরকে সম্মানিত করছে সুতরাং এটা কম কিসে।
আসলে ব্রিটিশদের খেতাব বা উপাধি দেয়ার প্রবনতা নতুন কিছু নয়। সে সময়ও তারা বিভিন্ন উপাধি দিয়ে লোকজনকে উৎসাহিত করেছে যখন তারা আমাদের দেশ শাসন করেছিল। এ উপাধিগুলির মধ্যে রায় বাহাদুর, খান বাহাদুর, চৌধুরী প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
বৃটেনের রাজ বংশের উত্তরাধিকারী যিনি হন তিনিই এ সমস্ত উপাধি দিয়ে থাকেন। কিন্তু যিনি এ সমস্ত উপাধি প্রদান করেন তিনি বা তারা কোন সময়ই কিছু পাওয়ার আশা করেন না। কারণ তাদের কোনো কিছুর অভাব নাই। ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, মান-সম্মান থেকে শুরু করে সবকিছুই তাদের রয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতো তারা বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিভিন্ন নেতা এবং সেলিব্রেটদের কাছ থেকে উপহার পান। যেমন ব্রিটেনের বর্তমান রাণীর বাসভবন বাকিংহাম প্যালাস থেকে ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিক বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকে পাওয়া উপহারের একটি তালিকা থেকে জানা যায় যে, এতে রয়েছে মূল্যবান জুয়েলারি ও অলংকার। তার পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু ‘অস্বাভাবিক’ উপহারও। কয়েক বছর আগে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টের সহধর্মীনী মিশেল ওবামা রাণীকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন এক বাক্স লেমন ভেরবেনা চা, একটি মোমবাতি, মধুভর্তি দুটি ছোটো বোতল এবং হানি বাটারের একটি জার। তা ছাড়াও মিশেল রাণীকে টিফানি অ্যান্ড কোম্পানির একটি সিলভার হানিকম ও বি বাড ভেইস উপহার দেন। এক সময় আইল্যান্ডস’র গভর্নর রাণীকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন ‘এক বস্তা লবণ’। আর জার্মান প্রেসিডেন্ট জোয়াকিম গক রাণীকে উপহার দিয়েছিলেন ব্রান্ডেনবার্গ গেইটের একটি ‘মার্জিপান মডেল’।
যা হউক, বৃটেনে এবার বেশ কয়েকজন রাণীর খেতাব পেয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন শতবর্ষী দবিরুল ইসলাম চৌধুরী ওবিই এবং কাউন্সিলর লুৎফুর নীলিমা খান, সাবেক কাউন্সিলর সাজ্জাদ মিয়া, সেলিব্রেটি শেফ অলি খান ও শিক্ষক সৈয়দ আফসার উদ্দিন পেয়েছেন এমবিই। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের কাজের অবদানের জন্য এ খেতাব পেয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে ব্যতিক্রমী করোনাভাইরাস দুর্গতদের সহযোগিতা করার লক্ষ্যে গত রমজান মাসে নিজের বাগানে পায়ে হেঁটে সাড়ে চার লাখ পাউন্ড তহবিল জোগাড় করে অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার (ওবিই) খেতাবে ভূষিত হয়েছেন যুক্তরাজ্যে বসবাসরত শতবর্ষী বাঙালি দবিরুল ইসলাম চৌধুরী।
পূর্ব লন্ডনের বো এলাকার বাসিন্দা দবিরুল ইসলাম চৌধুরী রানির এই পদক পাওয়ার পর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এই দুর্লভ সম্মান পেয়ে তিনি নিজেকে অত্যন্ত ভাগ্যবান বলে মনে করছেন। এ জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে সবার প্রতি ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তিনি ব্রিটেনের বাঙালি সমাজ, বয়স্ক সমাজ এবং অভিবাসী সমাজের পক্ষ থেকে এই ওবিই পদক গ্রহণ করছেন।
গত রমজান মাসের প্রায় পুরো সময় দবিরুল ইসলাম চৌধুরী রোজা রেখে প্রতিদিন তার বাড়ির পেছনের ৮০ মিটার বাগানে পায়ে হেঁটে মোট ৯৭০ বার চক্কর দিয়েছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ, ব্রিটেন এবং আরও কিছু দেশের করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত মানুষের সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা। তার এ প্রচেষ্ঠা সফল হয়েছে।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন টম মুর তার বাড়ির বাগানে পায়ে হেঁটে স্বাস্থ্য-কর্মীদের জন্য যেভাবে চাঁদা তুলেছিলেন তা দেখে উৎসাহিত হয়েছিলেন তিনি। তাই তিনি একইভাবে পায়ে হেঁটে মোট চার লাখ ২০ হাজার পাউন্ড (বাংলাদেশি প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা) সংগ্রহ করেন।
এর মধ্যে এক লাখ ১৬ হাজার পাউন্ড দেয়া হয় ব্রিটেনের স্বাস্থ্য বিভাগ এনএইচএসকে। বাকি অর্থ ৫২টি দেশের ৩০টি দাতব্য প্রতিষ্ঠানে দান করা হয়। তার এ পুরো প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করে বৃটেনের জনপ্রিয় টেলিভিশন মাধ্যম চ্যানেল এস। তিনি জানান, রানির দফতর থেকে ওবিই পদক প্রাপ্তির চিঠি পেয়ে তিনি বেশ অবাকই হয়েছিলেন। বলেন, আমরা যখন কোন একটা ভাল কাজ করি তখন বিশেষ কোন প্রাপ্তির কথা সাধারনত মাথায় রাখি না। তবু এই স্বীকৃতির জন্য তিনি খুবই আনন্দিত।
আর এই পদক তার জীবনের স্বাভাবিক কর্মকান্ডে বিশেষ কোন পরিবর্তন আনবে না বলে মন্তব্য করেন দবিরুল ইসলাম। তবে তার কাজ যদি অন্য কাউকে উৎসাহিত করে তাহলেই কেবল তিনি খুশি হবেন বলে জানান।
রানির পদক পাওয়ার পর তিনি যেসব দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কিত সেগুলোর প্রতি মানুষের সমর্থন আরও বাড়বে বলে তিনি আশা করেন। তার ছেলে আতিক চৌধুরী বলেন, দবিরুল ইসলাম চৌধুরী তার জন্মস্থান সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের বাংলা ফিমেল অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি চ্যারিটির সঙ্গে যুক্ত। যা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দরিদ্র, অসহায় ও অনাথ মেয়েদের জন্য প্রতিষ্ঠানটি ভরণপোষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানে মোট ৩২০ জন মেয়েও রয়েছে। তাদের উচ্চশিক্ষার দায়িত্ব ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েছে বলে তিনি জানান। রানির পদক পাওয়ার পরও চৌধুরী পরিবার এ নিয়ে কোনও আনন্দ-উল্লাস করার সুযোগ পাননি। আতিক চৌধুরী জানান, তার বাবা বয়োবৃদ্ধ বলে মহামারির সময়ে সেলফ আইসোলেশনে রয়েছেন। ফলে একমাত্র তিনি এবং একজন সেবাকর্মী ছাড়া কারও সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারছেন না।
দবিরুল ইসলাম চৌধুরীর জন্ম ১৯২০ সালে বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায়। ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে উচ্চশিক্ষার আশায় ১৯৫৭ সালে তিনি বিলেতের পথে পাড়ি জমান। এরপর তিনি সেন্ট অলবান্স শহরে বসবাস করেন এবং সেখানে একজন কমিউনিটি লিডার হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধের সমযয়ও তিনি অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। (চলবে)।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক ও দর্পণ ম্যাগাজিন সম্পাদক। ইমেইল: rahmatali2056@gmail.com