মানহীন শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ কত দূর যাবে?
:: শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ::
‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ বলে যে সর্বজনস্বীকৃত একটি স্বতঃসিদ্ধ আছে, সেটি কি বাংলাদেশে এসে লাপাত্তা হয়ে গেল? করোনা মহামারির কারণে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ৮ মাস ধরে বন্ধ। পিইসি, জেএসসি ও বার্ষিক পরীক্ষা বাতিল– এ পর্যন্ত যৌক্তিক কারণেই মানা যায়। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা কেন বাতিল হলো? মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, স্নাতক ও মাস্টার্স হচ্ছে শিক্ষাজীবন ও পরবর্তী কর্মজীবনের ভিত্তি। ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট, অফিস-আদালত– সবকিছু খুলে দেয়া হলো; বিশেষজ্ঞদের সাবধান বাণী, করোনা মহামারি কোনো কিছুই তোয়াক্কা করা হলো না! এখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করার সময় করোনা মহামারিকে দাঁড়া করা হলো অজুহাত হিসেবে? তাহলে শিক্ষার মানের কথা কে ভাববে? অটোপাসওলারা যখন চাকরি পাবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে গিয়ে সমস্যায় পড়বে, তখন কি হবে? সরকারি তরফে কোনো সদুত্তর নেই। কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই।
>>> শিক্ষার উপযোগিতা ও পরমার্থ তো তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। বাঙালির স্বাধিকারের ম্যাগনাকার্টা ‘ছয় দফা’ প্রস্তুত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালি অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়েছিলেন। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের সূচনা, শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানসহ মুক্তিযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের স্বাধীন সত্তার বিকাশ ও মুক্তবুদ্ধি চর্চাকে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষকদের উপহার দিয়েছিলেন ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ। বাঙালি জাতির এই অবিসংবাদিত নেতা প্রথম শিক্ষা কমিশনের প্রধান করেছিলেন একজন বিজ্ঞানীকে। শিক্ষার প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল সহজাত অনুরাগ এবং শিক্ষকদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা।
>>> প্রায় এক দশক ধরে শিক্ষার কী এমন হলো যে, শিক্ষার মান তলানিতে এসে ঠেকল? কয়েক বছর ধরে আমরা লক্ষ করলাম, সারা দেশে জিপিএ-৫-এর উজান বইছে! মানের কোনো বালাই নেই। পরীক্ষা পাসের সোনার দিনার দিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের খুশি করার এক অসুস্থ প্রবণতা চলল বছরের পর বছর। হালের দু-এক বছরে সেটি কিছুটা কমেছে। সঙ্গে চলল প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সর্বনাশা আয়োজন। আর একজন সাবেক বামপন্থী শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে জাতির এই সর্বনাশটা হলো।
>>> প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোচিং-বাণিজ্য, অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার চাপ, ও জিপিএ-৫-এর অস্বাভাবিক উল্লম্ফনের কারণে শিক্ষার মান কমে গেল। এতটাই কমল যে, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও সরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণই হতে পারছে না। তাহলে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি মেডিকেল কলেজওয়ালারা কি শিক্ষার্থী-বৈরী, নাকি শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিপক্ষ?
>>>
>>> এমন ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। মূলত এই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রবেশ-দরজায় শিক্ষার্থী যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি জারি রেখেছে বলে, শিক্ষার মান কিছুটা হলেও আছে। বুয়েট এবং কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু মানসম্পন্ন স্নাতকই তৈরি করছে না, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ দুটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের সুনামও আছে। লেজুড়বৃত্তির ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতির কারণে একদা প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের শিক্ষা ও গবেষণার গড়পড়তা মানে বেশ অবনতি হয়েছে এবং হচ্ছে। (এখানে বলে রাখা ভালো যে, আমি লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বিরোধী, কিন্তু আদর্শিক শিক্ষক ও ছাত্ররাজনীতির একনিষ্ঠ সমর্থক।) এতটা নাজুক অবস্থার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখনো একটা মান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার প্রধান কারণ হচ্ছে প্রবেশ-দরজায় শিক্ষার্থীদের মান যাচাই-বাছাইয়ের ব্যবস্থা। তিন দশক আগেও মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত, নেপাল, ভুটান ইত্যাদি দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসতেন। আর এখন আমাদের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার জন্য যাচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া ও ভারতে।
>>> শিক্ষায় সরকারের কি তাহলে কোনোই সাফল্য নেই? সাফল্য আছে, যেমন বছরের শুরুতে কয়েক কোটি শিক্ষার্থীর মধ্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়ে-শিক্ষার্থীর এনরোলমেন্ট উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি, গ্রাম ও মফস্বলের বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো উন্নয়ন ইত্যাদি। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে যেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেই মানে নেমেছে ধস! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও সরকারি মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় ৭০ শতাংশ জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর ফেল করার মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে, শিক্ষার্থী তথা শিক্ষার মান কোথায় নেমেছে!
>>> ২০১৬ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কবিগুরুর ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ নামের কবিতার লাইন এবং কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার শব্দ পরিবর্তন করে, অনেক শক্তিমান লেখককে নির্বাসিত করে ‘হিন্দু’ বলে। পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তনে বিশেষজ্ঞ, সুস্থ-সচেতন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রত্যেকটি মানুষ আঁতকে ওঠেন। তাদের মতে, এ অবস্থা চলতে থাকলে মুক্তচিন্তা ও অবাধ জ্ঞানচর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে; ভবিষ্যতে আর জন্ম হবে না রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন বোস, জীবনানন্দ, জয়নুল আবেদিন, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমামের মতো কোনো প্রতিভাবান ব্যক্তির; জন্ম নিতে থাকবে কাদের মোল্লা, বাংলা ভাই ও তেঁতুল হুজুরদের মতো ধর্মান্ধ চরমপন্থীরা। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তাশূন্য করে ধর্মান্ধতার দিকে ঠেলে দেয়ার দায় কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার অস্বীকার করতে পারবে?
>>> ২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন সর্বশেষ অক্টোবর ২০১৯ : উচ্চশিক্ষা ও চাকুরির সক্ষমতা’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, স্নাতক পাস করার পর এক-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী এক থেকে দুই বছর পরেও চাকরি পাননি। এতে প্রতিফলিত হয়েছে শিক্ষার মানের করুণ চিত্র এবং শিক্ষার্থীদের চাকরি সক্ষমতার নাজুক অবস্থা। এই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পলিটেকনিক থেকে পাস করা ৭৫ শতাংশ স্নাতক, কলেজ থেকে পাস করা ৩০ শতাংশ স্নাতক এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ২০ শতাংশ স্নাতক এক বছরের বেশি সময় ধরে বেকার (দ্য ডেইলি স্টার, ১১ অক্টোবর, ২০১৯।)
>>> মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ দিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের খুশি করার সর্বনাশা সরকারি নীতি; মানের অবনতির কারণে শিক্ষার্থীদের ৭০ শতাংশের ভালো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় ফেল; এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ স্নাতকদের এক-তৃতীয়াংশ থেকে ৪০ শতাংশের বেকারত্ব বাংলাদেশের শিক্ষার মানের বড় ধরনের অবনতির খবর দিচ্ছে। এদিকে ভারত, চীন, শ্রীলঙ্কা, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা বৈধ-অবৈধভাবে নানা চাকরি করে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি দেশের বাইরে পাচার করে দিচ্ছেন। প্রতিবছর এই বিদেশিরা করই ফাঁকি দিচ্ছেন ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি (দৈনিক কালের কন্ঠ, ৬ ফেব্রয়ারি, ২০২০।) শিক্ষার মানের এই অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন কি তোলা যায় না যে, বাংলাদেশ সংবিধানের শিক্ষাসংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা সরকার অনেক ক্ষেত্রে পালন করছে না, এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে লঙ্ঘনও করছে?
>>> সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র (ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য … (খ) সমাজের প্রয়োজনের সহিত শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করিবার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রাপ্ত নাগরিক সৃষ্টির জন্য … কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রায় ৫০ বছর হতে চলল, কিন্তু একই পদ্ধতির গণমুখী ও সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলো না। এটি সব সরকারের সম্মিলিত ব্যর্থতা। আর শিক্ষাকে সমাজের প্রয়োজনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করা এবং সেই প্রয়োজনসিদ্ধ করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও সদিচ্ছাপ্রাপ্ত নাগরিক সৃষ্টির ব্যাপারে সরকারগুলো আংশিকভাবে সফল। কিন্তু গত এক দশকে শিক্ষার মানে যে ধস নেমেছে, সে দায় কে নেবে? সম্প্রতি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা বাতিল করে আমরা কয়েক ধাপ পিছিয়ে গেলাম। এখন কি এ প্রশ্ন করা যায়– মানহীন এই শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ কত দূর যাবে?
(লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অপরাধ বিশ্লেষক।)