হ্যালো মার্শাল আমেরিকান
:: এবিএম সালেহ উদ্দীন ::
অবশেষে দীর্ঘ পাঁচ দিনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান হলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নির্বাচনের দীর্ঘ লড়াইয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন জো বাইডেন। একই সঙ্গে প্রথম নির্বাচিত নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের রানিংমেট হিসেবে কমলা হ্যারিস জোড়া রেকর্ড গড়ে তুলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পাশাপাশি তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্টও হতে যাচ্ছেন।
৩ নভেম্বর মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিরামহীনভাবে সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ হয়। এরপর রাজ্যগুলোতে পর্যায়ক্রমে দিনরাত একযোগে ভোট গণনা শেষে নির্বাচন কমিশন থেকে সরাসরি তথ্য নিয়ে বিখ্যাত টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএন, এবিসি নিউজ, এনবিসি ও ফক্স নিউজ, আলজাজিরাসহ পৃথিবীর অন্যান্য নিউজ মিডিয়ায় ৭ নভেম্বর শুক্রবার একযোগে ফলাফল সম্প্রচার হয়। ৮ নভেম্বর নিজ অঙ্গরাজ্য ডেলাওয়ারের উইলমিংটন শহরে নির্বাচনী কনভেনশন সেন্টারে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দলীয় সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বিশাল জনসমাবেশে ভাষণ দেন।
জীবনের বহু ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিকুলতার মধ্য দিয়ে ৭৭ বছর বয়সের উপান্তে এসে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। একজন সফল রাজনীতিক হিসেবে এটি তাঁর জীবনের চূড়ান্ত সাফল্য। তিনি একজন বিচক্ষণ বিশ্ব রাজনীতিক ও সচেতন ব্যক্তি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি একজন সুশিক্ষিত ভদ্র ও বিনয়ী স্বভাবের আত্মসংগ্রামী মানুষ। কিন্তু তাঁর অসীম ধৈর্য, ব্যক্তিত্ব ও দৃঢ়চেতা মনোভাব তাকে আজ একজন সফল মানুষরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আমেরিকার রাজনীতিতে জো বাইডেন কোনো নতুন নাম নয়। ছাত্রজীবন থেকেই মনের মধ্যে রাজনীতিকে লালন করে তিনি ডেমোক্র্যাট দলে যোগ দিয়ে রাজনীতি শুরু করেন। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিনি ১৯৭২ সালে ডেমোক্র্যাট দল থেকে নির্বাচন করে প্রথম সিনেটর নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন আমেরিকার ইতিহাসে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম সিনেটর। ডেমোক্রেট দলটিকে নিজের দল হিসেবে নির্বাচন করার ক্ষেত্রেও তার একটি ইতিহাস আছে। নিজের শহরে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ার থেকে ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম এ পাস করেন। ছাত্রজীবনে খেলাধুলার পাশাপাশি রাজনীতির প্রতিও তার প্রবল ঝোঁক ছিল। ১৯৬১ সালে হোয়াইট হাউসে অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা জো বাইডেনকে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার প্রতি অনুপ্রেরণা যোগায়।
সিনেটর নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী নেইলিয়া হান্টার এবং এক বছর বয়সী কন্যাসন্তান নাইওমি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। ওই সময় শোকে, দুঃখে বিচলিত বাইডেন অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। ওই দুর্ঘটনায় তার দুই ছেলেও মারাত্মক আহত হন। ঘটনার সময় তিনি ওয়াশিংটন ছিলেন।
২০১৫ সালে তার প্রিয় পুত্র বো বাইডেনও মারা যান। ফলে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থিতা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নিতে পারেননি।
এভাবেই কর্মজীবনের প্রতিটি স্তরে বাইডেনকে অনেক প্রতিকুলতার মধ্যদিয়ে নিজেকে এবং তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে।
বাইডেন সবসময় বাবার আদর্শ মেনে চলেন, যা তার জীবনকে সমুজ্জ্বল করেছে। তার মতে, তার বাবার একটি নির্দেশনা তাকে সর্বদা অনুপ্রানিত করেছে।
বাবা বলেছিলেন, ‘তোমাকে কে কতবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল সেটি বড় কথা নয়; তুমি কত দ্রুত উঠে দাঁড়াতে পেরেছো সেটাই তোমার সাফল্য।’ এই কথাটির উপর ভর করে তিনি নিজেকে সবসময় সুদৃঢ় রাখার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ একটি পরিবার থেকে উঠে তিলে তিলে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রাজনীতিতে প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি সাফল্যের সাথে আট বছর যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডন্ট ছিলেন। সর্বক্ষেত্রেই তিনি সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। ২০২০ সালের তুমুল প্রতিযোগিতার প্রতিটি ধাপ কাটিয়ে উঠে বার্নি স্যান্ডার্সের সঙ্গে প্রাইমারিতে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে উঠে আসেন জো বাইডেন। ২০ নভেম্বর ৭৮তম জন্মদিনের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন জো বাইডেন।
বাইডেনের দীর্ঘ জীবনের পথ চলা মসৃণ ছিল না। অনেক কষ্ট ও ঝুঁকির মধ্যেই তিনি নিজেকে একজন সফল মানুষে পরিণত করেছেন।
বিপদসঙ্কুল পরিস্থিতেও তিনি মনোবল হারাননি। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
উৎসবমুখর বিজয় সমাবেশে সমর্থকদের সামনে এসে তিনি যখন ‘হ্যালো মার্শাল আমেরিকান’ বলে সম্বোধন করলেন, তখনই বিশাল সমাবেশে আগতরা আনন্দে উৎফুল্ল কণ্ঠে নেচে উঠেন। স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ শ্লোগানে গোটা সমাবেশস্থলকে মুখর করে তোলেন। জো বাইডেনের সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের প্রতিটি বাক্য ছিল স্পষ্ট, পরিশীলিত ও বর্তমান বিশ্ব ক্রান্তিকালের প্রেরণা উদ্দীপক এবং যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের জন্য ভরসাময়। তিনি বলেন, ‘আমি এমন একজন প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি’ যিনি কোনো বিভক্তি নয়, সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধভাবে আমেরিকার ঐতিহ্যকে যথাস্থানে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করবেন। তিনি সবার আগে মরনব্যাধি ভয়ংকর মহামারি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেবেন। যিনি লাল রাজ্য বা নীল রাজ্য নয় সর্বপ্রকার কুৎসিত বর্ণবাদকে মুলোৎপাটন করে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মানবতাবোধকে দেখবেন। তিনি বলেন, আমি চাই আমেরিকার আত্মাকে ফিরিয়ে আনতে, এ জাতির মেরুদণ্ড মধ্যবিত্ত শ্রেণির পুনর্গঠন ঘটিয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ফের পুরো বিশ্বের শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। তিনি তার জন্মভূমি যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ন ও সমুন্নত রেখে জনগণের মধ্যে বৈষম্যহীন ঐক্য ফিরিয়ে আনার অঙ্গীকার করেন।
আলো ঝলমল জনাকীর্ণ উৎসবমূখর সমাবেশে বাইডেন ছিলেন দৃঢ়চেতা ও বেশ সংযত।
অপরদিকে প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট, জো বাইডেনের রানিংমেট হিসেবে কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট হওয়ার পাশাপাশি তিনি প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস প্রেসিডেন্টও হতে যাচ্ছেন। একই অনুষ্ঠানের বিজয়ী ভাষণে কমলা বলেন, ‘হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে আমিই প্রথম নারী। কিন্তু আমিই শেষ নই।’ তিনি তার বক্তব্যে আমেরিকার ভোটের অধিকার ১৯তম সংশোধনী পেতে শত বছর আগে নারীর ভূমিকা, ৫৫ বছর আগে ভোটাধিকার সংশোধনীতে নারী আন্দোলনের অবদান এবং সম্প্রতি আধুনিক রাষ্ট্র গড়তে নারীদের ত্যাগের মহিমা আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
নবনির্বাচিত জো বাইডেনের সামনের পথগুলোও হয়ত: খুউব একটা মসৃন হবে না ! এই পথ আরও কঠিন এবং কন্টাকীর্ণ। সর্বপ্রথম তাকে ট্রাম্পের হটকারীমূলক রাষ্ট্রনীতির সব স্পর্শকাতর জন্জাল সরিয়ে সবার মাঝে সমতা ফিরিয়ে অর্থনীতির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে তুলতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে সমগ্র বিশ্বের মানুষের কল্যানার্থী হিসেবে আন্তর্জাতিক বিশ্বে আরও বিশ্বাসযোগ্য অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হবে। মরণঘাতি ভয়ংকর করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে রক্ষা করতে হবে। এজন্য সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের ত্রাতা হিসাবে, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপীয় দেশসমূহের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন এবং ন্যাটোর ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারে সময়োচিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ফিলিস্তিনে অর্থনৈতিক সাহায্য পূণ:প্রতিষ্ঠা সেখানকার আর্তপীড়িত জনগনের পাশে শক্তভূমিকা পালন, রোহিঙ্গাসহ ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের শরনার্থীদের কল্যাণেও মানবিক সাহায্য জোরদারসহ অনেক বড় ভূমিকা নিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে সবার উপরে স্থান দিয়ে বিশ্বের যুদ্ধংদেহী রাষ্ট্রসমূহে শান্তি ফিরিয়ে আনতে অগ্রনী ভূমিকাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপে এগিয়ে আসতে হবে। সকল প্রকার ধর্ম, বর্ণ বৈষম্য দূরীকরণ এবং জনগণের সকল সংশয়, সংশ্লেষ কমিয়ে এক সাহসী ভূমিকা রাখতে হবে।
৮ নভেম্বর রাতের সমাবেশে ৭৭ বছর বয়সী সুঠামদেহী স্মার্ট রাজনৈতিক নেতা জো বাইডেন তাঁর বক্তব্যে পূর্বসূরী প্রেসিডন্ট জন এফ কেনেডি, ১৯৩২ সালের ফ্রাংকলিন রুজভেল্ট, এই যুগের সাবেক প্রেসিডন্ট বারাক ওবামার নীতিবোধ ও উদ্ধৃতি টেনে সন্মান প্রদর্শন করেন।
সকল ধর্মের মানুষের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে তিনি তার শিশুকালের স্মৃতিময় পিতামহ ও মাতামহের একটি কথাকে স্মরণ করে বলেন, পিতামহ বলেছিলেন, ‘জো কিক দ্যা ফেইক, আর মাতামহ বলেন, নো, আসল আর নকল সবকিছুকেই ঈশ্বর দেখেন।’
সময়ই বলে দেবে, সবকিছু উতড়িয়ে বাইডেন কতখানি সফল হবেন। সকলের প্রত্যাশা, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সকল শ্রেণি-বৈষম্যের উর্ধ্বে উঠে সুসমৃদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বে সমুন্নত রাখবেন। সকল প্রকার দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে সমতা ফিরিয়ে সুশীলধারায় এগিয়ে নিবেন। অভিনন্দন। মি. জো বাইডেনের আগামী কেবিনেটকে প্রাণঢালা অভিনন্দন।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, নিউইয়র্ক।