কমলা হ্যারিস – নারীর ক্ষমতায়নে গণতান্ত্রিক বিশ্ব জয়
:: তানিজা খানম জেরিন ::
এই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র- জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট এবং ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সিনেটর কমলা দেবী হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯তম প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। যদিও নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফল পেতে যুক্তরাষ্ট্রবাসীকে চারদিন উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠায় কাটাতে হয়েছে পরিশেষে নয়দিনের মাথায় নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল ঘোষনা করেন। আমেরিকার গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিজয়ী প্রেসিডেন্টকে বিজয়ী অভিবাদন বা শুভেচ্ছা কোনটাই এখন পর্যন্ত জানায়নি। উপরন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কারচুপি ও বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের ভোট পুন:গণনার জন্য মামলা রুজু করেছেন। আমেরিকাসহ বিশ্ববাসীর সবাই জেনে গেছে জো বাইডেন ৩০৬টি ইলেক্ট্রোরাল ভোট পেয়ে এবং সাত কোটি বিরান্নব্বই লাখ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট এবং কমলা দেবী হ্যারিস ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গণতন্ত্রের আদি প্রবক্তা হিসেবে আমেরিকার বিশ্বে যে সুনাম এবং ঐতিহ্য রয়েছে গত নির্বাচনের পর বর্তমান প্রেসিডেন্টের ফলাফল মেনে না নেওয়ার একগুয়েমির কারণে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের সুনামে কিছুটা হলেও বিশ্ববাসীর কাছে মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। আমেরিকার স্বাধীনতার ১৪৪ বছর পর যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা ১৯২০ সালে প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছিলেন এরই ধারাবাহিকতায় ১৯২২ সালে প্রথম নারী সিনেটর হিসেবে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যে রেবেকা ল্যাটিমার ফেলটন নির্বাচিত হন পরবর্তীতে ১৯৩২ সালে আরকানসাস অঙ্গরাজ্যে হেইতি কারাওয়ে সরাসরি ভোটে সিনেটর নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে প্রথম নারী গভর্ণর হিসেবে নিলি টেইলো রস ১৯২৪ সালে ওয়াইমিং অঙ্গরাজ্য থেকে নির্বাচিত হন। নারীদের ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রায় এবারের নির্বাচনে আফ্রিকান এশিয়ান বংশোদ্ভূত কমলা দেবী হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। যদিও কমলা হ্যারিসের আগেও দুজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে লড়েছিলেন; ১৯৮৪ সালে ডেমোক্রেটিক দল থেকে জেরালডিন ফেরারো এবং ২০০৮ সালে রিপাবলিকান পার্টি থেকে সারাহ পলিন নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন। স্মর্তব্য ২০১৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে রুডহাম হিলারি ক্লিনটন প্রার্থী হয়ে সর্বোচ্চ পপুলার ভোট পেয়েও নির্বাচনে জয় লাভ করতে পারেনি। কমলা হ্যারিস নির্বাচনে জয়ী হয়ে নারীদের মনে যে আশার আলো দেখিয়েছেন এতে আমি নিশ্চিত আগামী দশকেই আমরা হয়তো নারী প্রেসিডেন্ট পেয়ে যাবো।
কমলা হ্যারিসের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে কিন্তু তার এই অবস্হানে আসার পিছনে রয়েছে কঠিন লৌহ-ইস্পাত এক সংগ্রামের উপাখ্যান। ১৯৫৮ সালে কমলা দেবীর মা শ্যামলা গোপালান ব্রেষ্ট ক্যান্সার গবেষণার উপর PhD করার জন্য ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশ থেকে আমেরিকায় পা দেন। পরবর্তীতে আফ্রিকান জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত ডোনাল্ড জে হ্যারিসের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১৯৬৪ সনে ২০শে অক্টোবর ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের অকল্যান্ডে কমলা দেবী হ্যারিস জন্মগ্রহন করেন। তিনি অ্যালমেডো কাউন্টি জেলা অফিসে তার কর্মজীবন শুরু করেন তারপর ধাপে ধাপে সানফ্রান্সিসকোর অ্যাটর্নি অফিসে ও সিটি অ্যাটর্নি এবং অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দুইবার নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে কমলা হ্যারিস ২০১৬ সালে প্রথম এশিয়ান আফ্রিকান নারী হিসেবে ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটর নির্বাচিত হন। এবারের নির্বাচনে আমেরিকার ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়ে জো বাইডেনের সহযোগী হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আমেরিকা এবারের নির্বাচনে পেয়েছেন ৭৮ বছর বয়সী সবচেয়ে বয়স্ক প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয় টার্মে যদি না জো বাইডেন নির্বাচনে দাঁড়াতে না পারেন তবে কমলা হ্যারিসই হবেন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা মতে কোন না কোন কারণে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসকেই পাওয়ার সম্ভাবনা বেশী।
বর্তমান আধুনিক বিশ্বের অনেক দেশেই রাষ্ট্রপরিচালনায় সর্বোচ্চ পদে নারী সমভাবে দেশ পরিচালনা করেছে। উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দর নায়েকের পথ অনুসরণ করে বিশ্বের অনেক দেশেই প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, চ্যান্সলর নারী ক্ষমতায়নের অগ্রযাত্রায় সামিল হয়েছেল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী নারী নেতৃত্বের মধ্যে রয়েছে আর্জেন্টিনার ইসাবেলা পেরন, ভারতের ইন্দিরাগান্ধী, ইসরাইলের গোল্ডামায়ার, গ্রেটবৃটেনের মার্গারেট থেচার এবং তেরেসা মে, জার্মানের চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মেকেল, শ্রীলঙ্কার চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা, ইন্দোনেশিয়ার মেঘবতী সুকর্ণ পুত্রী। আরো উল্লেখ্য বর্তমান বিশ্বে পঁচিশটিরও বেশী দেশে রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন নারী নেত্রী। স্মর্তব্য বিশ্বের অনেক দেশেই নারী ভোটাধিকার পেতে দেরী হয়েছে। বিশ্বে সর্ব প্রথম নিউজিল্যাণ্ডের নারীরা ১৮৯৩ সালে ভোটাধিকার লাভ করেন। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আফ্রিকাসহ রাজতান্ত্রিক অনেক দেশেই নারীদের ভোটাধিকার এখনও বর্তমানে নেই। বর্তমান শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়নের ভরা মৌসুমেও অনেক দেশেই নারীদের সমঅধিকারের দাবীতে সোচ্চার থাকতে হচ্ছে; এই বিশ্ব ভ্রমাণ্ডে নারীরা সকল ক্ষেত্রেই আত্মমর্যাদার সাথে লড়াই করে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিশ্বে অনেক দেশেই নারীর ক্ষমতায়নতো দূরের কথা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই নারীরা আজও নির্যাতিত, বঞ্ছিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত ও অত্যাচারিত হচ্ছে । সমঅধিকারের লড়াইয়ে নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই নারীদেরকে সুসংগঠিত হয়ে সমঅধিকারের আন্দোলন সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। আমরা আমেরিকানবাসী হিসেবে অবশ্যই গর্বিত যে আমরা একজন নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিসকে পেয়ে গর্ববোধ করছি। আশা করি গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে আমেরিকা আগামী দশকে অবশ্যই একজন নারী প্রেসিডেন্ট পাওয়ার ইতিহাস গড়বে। কমলা হ্যারিস যে আশার আলো প্রজ্জ্বলন করেছে বিশেষ করে এশিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান নারীরাও সেই পথ অনুসরণ করে বিশ্ব দরবারে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হয়ে বিশ্বে নারীদের মুখ উজ্জ্বল করবে। একবিংশ শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়ন বিশ্বের সর্বত্র সমভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লড়াইয়ে নতুন প্রজন্ম আরো সোচ্চার ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে এই আশাবাদ সর্বক্ষণ। অজস্র অভিনন্দন ও রক্তিম শুভেচ্ছা নারীদের অগ্র-প্রতীক গণতান্ত্রিক বিশ্ব জয়ী কমলা হ্যারিস।
(লেখক: কলামিস্ট, নিউইয়র্কে বসবাস করেন।)