শিক্ষা অগ্রাধিকার নয়, মানেও নেমেছে ধস!
:: শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ::
আইনস্টাইন বলেছেন, ‘জ্ঞানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কল্পনাশক্তি। ’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কল্পনাশক্তি ও মানুষের সৃজনী ক্ষমতার বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। উভয়েই শিক্ষার উদ্দেশ্য হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন প্রত্যেক ব্যক্তির মধ্যে যে অন্তর্নিহিত সৃজনী ক্ষমতা, কল্পনাশক্তি ও সুপ্ত প্রতিভা থাকে, তার বিকাশ ঘটানোকে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন যেমনটি প্রত্যাশা করেছেন, সে ধরনের উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা, অবকাঠামো, দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষা দর্শন প্রয়োজন তা যে আমাদের নেই, সে কথা বলাই বাহুল্য। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার কেরানি তৈরির যে শিক্ষাব্যবস্থা পয়দা করেছিল, সে ব্যবস্থা ও দর্শনই এখনো কায়েম আছে।
বিংশ শতাব্দীর প্রভাবশালী দার্শনিক মিশেল ফুকোর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বিদ্যালয়, সামরিক বাহিনী এবং কারাগার হলো আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সংগঠন। এসব সমাজ ও রাষ্ট্রিক সংগঠনের প্রধান উদ্দেশ্য ব্যক্তির ওপর নজরদারি চালানো। এসব প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় প্রচলিত শিক্ষার যান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এবং আইনের ভয় দেখিয়ে সমাজ ব্যক্তির সৃজনীশক্তি নিঃশেষিত করে তার দেহ ও মনকে পোষ মানায়; আর এভাবেই অধিকাংশ ব্যক্তি হয়ে ওঠে একান্ত বাধ্যগত প্রজা- যা রাষ্ট্রচালকদের খুবই মনঃপূত; কেননা, খেয়াল-খুশিমতো শাসন চালানোর জন্য পোষ মানা প্রজাকুল অতীব উপযোগী।
প্রচলিত বিদ্যালয়ের ছকে বাঁধা শিক্ষা সৃজনশীল ও মৌলিক চিন্তার অধিকারী ব্যক্তিদের আকাক্সক্ষা যেমন মেটাতে পারে না, তেমন উত্তর দিতে পারে না তাদের অনন্তর জিজ্ঞাসার। ফলে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে স্কুল পালাতে হয়; আইনস্টাইন ও মিশেল ফুকোরা প্রচলিত বিদ্যালয়ের ছকে বাঁধা শিক্ষার বিরুদ্ধে সরব হয়ে ওঠেন। প্রচলিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আনন্দহীন ও যান্ত্রিক শিক্ষার প্রতি বিরক্ত হয়ে কবিগুরু প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শান্তিনিকেতন, যেখানে তিনি গাছের ছায়া বা উন্মুক্ত অকাশের নিচে শিক্ষার্থীদের আনন্দের সঙ্গে পাঠদান করতেন।
শিক্ষার্থীরা ঝরাপাতার মর্মর ধ্বনি, প্রকৃতির অবারিত বাতাস, পাখিদের কলকাকলি এবং কখনো বা ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি দেখতে দেখতে যে পাঠ গ্রহণ করতেন, তা তাদের চেতনা ও মননে গেঁথে যেত; বন্ধুর মতো শিক্ষক, পাঠদান পদ্ধতির অভিনবত্ব ও শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করত।
আমাদের বিদ্যমান বিদ্যালয়-মহাবিদ্যালয়, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠদান পদ্ধতি ও পরিবেশ যান্ত্রিক, একঘেয়ে এবং বিরক্তিকর। কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা এবং একঘেয়ে ও যান্ত্রিক পরিবেশ সত্ত্বেও শুধু পন্ডিত, সুবক্তা ও শিক্ষা-অন্তঃপ্রাণ শিক্ষকদের কারণে কোনো কোনো বিষয়ের পাঠদান হয়ে উঠতে পারে আনন্দময়, আগ্রহোদ্দীপক ও সুগ্রাহী। কিন্তু এ ধরনের শিক্ষকের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। শিক্ষার মানে যে ধস নেমেছে তার অন্যতম কারণ শিক্ষকতার দায়িত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘কোথাও চাকরি না পাওয়া’ ব্যক্তিদের হাতে তুলে দেওয়া। এর মূল দায় রাষ্ট্রকর্তাদের। পৃথিবীর যে কোনো দেশ সেটি গণতান্ত্রিক হোক, সমাজতান্ত্রিক হোক অথবা হোক ‘সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি’র যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও অর্থনীতিতে অগ্রগামী, সেসব দেশে সবচেয়ে শিক্ষিত ব্যক্তিরা শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। এসব দেশে রাষ্ট্রকর্তারা বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে শিক্ষকতা পেশাকে এমনভাবে বিন্যস্ত করেন, যাতে সমাজের সবচেয়ে মেধাবী ব্যক্তিরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহী হন।
এখন প্রাসঙ্গিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে, বাংলাদেশে শিক্ষকদের কী অবস্থা? দুঃখজনক হলো, এ প্রশ্নের উত্তর মর্মান্তিক! প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম বেতন পান বাংলাদেশের শিক্ষকরা। দেশে ৬৫ হাজার ৬২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক রয়েছেন প্রায় ৪ লাখ।
তার মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ সহকারী শিক্ষক এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। আর প্রধান শিক্ষকদের সম্প্রতি দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হলেও এখনো তাঁরা সমপদের বেতন-ভাতা পাননি। তাঁরা ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতনে সাকল্যে বেতন পাবেন ২১ হাজার ৫০০ টাকা। আমাদের পাশের দেশ ভারতেও প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন প্রায় ৩০ হাজার টাকা।
দেশে মেধাবীদের সর্বোচ্চ চাকরি বিসিএস। দৈনিক কালের কণ্ঠের ৫ অক্টোবর, ২০২০-এ ছাপা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিসিএসের ২৬টি ক্যাডারের মধ্যে শিক্ষা ক্যাডার প্রথম পছন্দ দিয়েছেন এমন প্রার্থী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দেখা গেছে, প্রার্থীরা শেষ পছন্দ হিসেবে শিক্ষা ক্যাডার দেন। ফলে যারা এখন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে বিভিন্ন সরকারি কলেজে চাকরি করছেন, তারা অন্য কোনো ক্যাডারে উত্তীর্ণ হতে না পেরেই শিক্ষকতায় এসেছেন। সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবস্থাও একই। অন্য কোনো চাকরি না পেয়েই তাদের বেশির ভাগ শিক্ষকতায় আসছেন। এর সমান্তরালে প্রধান পাবলিক বা জন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মেধাবীরা এলেও অনেকেই শেষ অব্দি থাকছেন না, চলে যাচ্ছেন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ব্রিটেন, আমেরিকা অথবা ইউরোপের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, শিক্ষকরা কেন বেতন-ভাতা নিয়ে চিন্তা করবেন? শিক্ষকদের কাজ হচ্ছে জ্ঞানসাধনা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো বিতরণ। তাহলে পাল্টা এ প্রশ্ন কি করা যায় যে, উন্নত গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকর্ষণ করার জন্য কেন পর্যাপ্ত বেতন-ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়? আমাদের রাষ্ট্রকর্তারাও এ কথা বোঝেন। সে জন্য ২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হয়েছে। তবে শিক্ষা সরকারের অগ্রাধিকার না হওয়ায় গত এক দশকেও এটি বাস্তবায়ন করা হয়নি।
প্রশ্ন উঠতে পারে, বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ তো শিক্ষা খাতেই। তাহলে সরকার শিক্ষায় গুরুত্ব দিচ্ছে না বলে যে কথা সাবুদ করা হচ্ছে, তা তো সঠিক নয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাজেটে শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেখানো হলেও প্রতি বছরই একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রেখে দেওয়া হয়। যেমন ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাত মিলিয়ে বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ১৫.২ শতাংশ। খাতভিত্তিক বরাদ্দ হিসেবে এটি সর্বোচ্চ। কিন্তু শিক্ষা থেকে প্রযুক্তি আলাদা করা হলে শুধু শিক্ষায় এ বরাদ্দ ১১.৬৮ শতাংশ। এদিকে শুধু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, শিক্ষা নিয়ে অনেক মন্ত্রণালয়ই কাজ করে। সে হিসেবে শিক্ষায় ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে জিডিপির ৩.০৪ শতাংশ; কিন্তু এ অর্থবছরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যে বরাদ্দ ছিল তা জিডিপির ২.২ শতাংশ। ফলে শিক্ষায় বরাদ্দ নিয়ে বিতর্ক থেকেই যাচ্ছে।
মূল কথা হলো, শিক্ষায় যে অর্থ বরাদ্দের কথা সে অর্থ বরাদ্দ করা হয় না। দ্বিতীয়ত, বরাদ্দ অর্থের প্রায় সবটাই শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা এবং অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্যয় হয়ে যায়। দুটি জায়গায় বাজেট বরাদ্দ থাকে না বললেই চলে- একটি হচ্ছে শিক্ষার মান রক্ষা ও মানোন্নয়ন; অন্যটি হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা কেন্দ্রগুলোর গবেষণা। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যখন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করে; আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখন স্যানিটাইজার বানায়! বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ওঠানামার প্রক্ষেপণ আইইডিসিআর বা বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তৈরি করতে পারনেনি; সেটি তৈরি করেছিলেন সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন (এসইউটিডি)-এর ডাটা ড্রাইভেন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকরা। বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর এ দীনতার জন্য শিক্ষক ও গবেষকদের দায় নেই, সে কথা বলব না। তবে মূল দায়টি রাষ্ট্রের। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একদিকে গবেষণা বরাদ্দ নেই, অন্যদিকে গবেষণা করার পরিবেশও নেই। অথচ চীন, ভারত, এমনকি পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণা ও উন্নয়নের (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) জন্য মিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করে।
কোন ধরনের উদ্দেশ্য অর্জন করার জন্য একটি সমাজ তার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলবে- এ আলোচনা দিয়ে লেখাটি শুরু করেছিলাম। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তির কল্পনাশক্তি, সৃজনী ক্ষমতা ও সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের জন্য যে পাঠক্রম, দক্ষ শিক্ষক, শিক্ষা দর্শন ও শিক্ষার পরিবেশ প্রয়োজন, তা আমাদের নেই। উপরন্তু ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা, ক্যাডেট কলেজ ও ইংরেজি-মাধ্যম শিক্ষার সমন্বয়ে বাংলাদেশে চলছে এক পাঁচমিশালি ব্যবস্থা। তবে ঔপনিবেশিক প্রভুদের বানানো কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থারও যে মান ছিল, তাও উধাও হতে বসেছে। এখন প্রশ্ন একটাই- পৃথিবীতে কি এমন কোনো দেশ পাওয়া যাবে যারা মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা ছাড়া উন্নত হয়েছে?
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।