আমরা আশা করবো রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে ওআইসি বাংলাদেশের পাশে থাকবে: সৌদি রাষ্টদূত জাবেদ পাটোয়ারী
মোঃ নাসির, বিশেষ প্রতিনিধি :
রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে মিয়ানমারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনকে (ওআইসি) দৃঢ়ভাবে পাশে চায় বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভবিষ্যতে বড় ধরণের সঙ্কটের আশঙ্কাকে মাথায় রেখেই কূটনৈতিকভাবে সমাধানের পথ খুঁজছে দেশটি।
একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে)মামলা পরিচালনায় ৫ লাখ ডলার দিয়েছে বাংলাদেশ। ৫৭টি মুসলিম দেশের সংগঠন ওআইসি’র পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের চলমান বৈঠকে তহবিল সংগ্রহ অভিযানে বাংলাদেশ এ অর্থ প্রদান করেছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রশ্নে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার আইনি লড়াইয়ে সহায়তায় এ অর্থ ব্যবহার করা হবে।
ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থায় (ওআইসি) বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘গাম্বিয়াকে আইনি লড়াইয়ে সহায়তা দেওয়ার জন্য আমরা ইতোমধ্যে ওআইসির তহবিলে এ অর্থ প্রদান করেছি।’
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারে শুরু হওয়া অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশনের (ওআইসি) পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পুনর্বাসনে বাংলাদেশকে সব রকমের সহযোগিতা করতেও আহ্বান জানান সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ওআইসিতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী।
৫৭ জাতির ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের কাউন্সিল বা সিএফএম বৈঠকের ৪৭তম অধিবেশনে শুক্রবার (২৭ নভেম্বর) তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়ে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করেন। খবর সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রের।
জানা যায়, সিএফএম বৈঠকের ৪৭তম অধিবেশনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও করোনা আক্রান্ত হওয়ায় তিনি যেতে পারেননি। তার অনুপস্থিতিতে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ওআইসিতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এ বৈঠকে যোগ দিয়েছে।
সূত্র মতে, দুই দিনের অধিবেশনে ওআইসির সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিশেষ করে সংস্থাটির সদস্য নয় এমন দেশগুলোতে মুসলিম সংখ্যালঘু ও জনগোষ্ঠীদের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
এতে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সঙ্কটের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তিন বছর আগে এক সেনা অভিযানের মাধ্যমে এই জনগোষ্ঠীর সদস্যদের প্রতিবেশী বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে বাস্তুচ্যুত করার বিষয়টি নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, নিজের বক্তব্যে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং ওআইসিতে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারি রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর চার দফার প্রস্তাবের বিষয়টি উত্থাপন করেন।
ড.জাবেদ বলেন, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতনের মুখে ১১ লাখ রোহিঙ্গা সেখান থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবিক কারণে এসব রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে এ সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ একাধিকবার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা এবং সামগ্রিকভাবে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও সেখানে ফিরে যায়নি। রোহিঙ্গাদের বিরাজমান এ সমস্যা এখন কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
আমরা আশা করবো বিরাজমান এ সঙ্কট নিরসনে ওআইসি বাংলাদেশের পাশে থাকবে এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে পুনর্বাসনে তারা আমাদের সব রকমের সহযোগিতা করবেন।’
সূত্র মতে, গত বছরের নভেম্বরে ওআইসি, কানাডা ও নেদারল্যান্ডের সমর্থনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজে’তে মামলা করে গাম্বিয়া। আইসিজেতে ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর এর প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
২৩ জানুয়ারি আইসিজে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধে অন্তবর্তীকালীন আদেশ জারি করে। নাইজারে সিএফএম’র বৈঠকে ঢাকার প্রতিনিধিদলে নেতৃত্বদানকারী ড.জাবেদ পাটোয়ারী বলেন, ‘ওআইসির জেনারেল সেক্রেটারিয়েট এখন আইসিজে-তে গাম্বিয়ার লড়াইয়ে সহায়তার জন্য একটি বিশেষ হিসাব খুলেছে। আর পশ্চিম আফ্রিকার দেশটিও তহবিলের জরুরি প্রয়োজনের ইঙ্গিত দিয়েছে।’
গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী দাউদা এ জালো সিএফএম-এ রোহিঙ্গা মামলার সর্বশেষ আপডেট উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন, ‘এ আইনি মামলার জন্য আমি ওআইসি’র সদস্য দেশগুলোর কাছে জরুরি, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের আহ্বান জানাচ্ছি। সিএফএম-এ রোহিঙ্গা সঙ্কট মূল আলোচ্য বিষয় হিসেবে উঠে আসে
এ সম্মেলনে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম নিয়ে ভীতি মোকাবিলায় মুসলমানদের ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এর আগে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকটি উদ্বোধন করেন নাইজারের প্রেসিডেন্ট মাহামাদু ইসোওইফু। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ওআইসির মহাসচিব ড. ইউসুফ আল ওথাইমিন। দেশটির রাজধানী নাইজারের মহাত্মা গান্ধী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবারের অধিবেশন।
দুই দিনের অধিবেশনে ওআইসির সদস্য দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে আলোচনা করছেন। বিশেষ করে সংস্থাটির সদস্য নয় এমন দেশগুলোতে মুসলিম সংখ্যালঘু ও জনগোষ্ঠীদের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।
উদ্বোধনী অধিবেশনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে দেশটির আন্তর্জাতিক সহায়তা বিষয়ক স্টেট মিনিস্টার রিম বিন্ত ইব্রাহিম সিএমএফের প্রেসিডেন্সি নাইজারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইব্রাহিম ইয়াকুবুর কাছে হস্তান্তর করেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর ওআইসির সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধি দলের প্রধানরা পূর্বনির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী মুসলিম বিশ্ব সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বহুপাক্ষিক ইস্যুতে ভাষণ দেবেন। আশা করা হচ্ছে সদস্য দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা বৈঠকের মধ্যেই পরবর্তী ওআইসি মহাসচিব নির্বাচিত করবেন।
সিএমএফ বৈঠকের অধিবেশন চলাকালে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা রোহিঙ্গা গণহত্যা বিষয়ে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসে (আইসিজে) মামলা করা গাম্বিয়াকে কীভাবে সহযোগিতা করা যায় সে বিষয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের ধনী-গরিব সব দেশেসুষম বণ্টন এবং ওআইসির সদস্য মধ্যপ্রাচ্যের তেল-সমৃদ্ধ দেশগুলোতে কাজ করা বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার প্রসঙ্গে আলোচনা করেন ড.জাবেদ পাটোয়ারী।
শনিবার (২৮ নভেম্বর) যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা এবং ওআইসির মহাসচিব ও ৪৭তম সিএফএমের সভাপতি দুই দিনের বৈঠক শেষ করেন।