ভাটিবাংলায় রাত্রিযাপন এবং আত্মবিদগ্ধ সামষ্টিক মানুষেরা
:: সাইফুর রহমান কায়েস ::
আবারো ভাটিবাংলায় কাটাবো রাত্রি আজ। জীবনরেখা ভাটির দিকে যাচ্ছে বলেই কিনা জানি না ভাটিবাংলা আমাকে খুব কাছে টানছে গত কয়েকবছর ধরে। ঘুরেফিরে একটা মায়াঘোরে আটকে যাচ্ছি বারংবার। এখানে প্রাণ,প্রাণী,মানুষ ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং প্রকৃতির অপার লীলায় আমি মুগ্ধ। আমাকে কবি করে তোলে। বর্ষামঙ্গলে মাতিয়ে রাখে। আমি খুজে ফিরি নিজেকে। শতক্রান্তিকালেও আমি নিবৃত্তিহীন, অদম্য এবং অত্যাবশ্যকীয়ভাবে উদ্যমী। আমার রিদমে চলতে থাকে দমের খেলা। সেই দমের খেলাটি আমার কাছে উপভোগের এবং উদযাপনের বিষয় হয়ে ধরা দেয়। আমার ভীষণ একাকীত্বের ভেতর তোলপাড় করা ঢেউ জাগে। এক ভীষণ অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলে। কোনো বাধ এবং বাধা আমাকে বাধ্য করতে পারে না। আমি তখন হয়ে নিজের রাজ্যের রাজা মশাই। সকল প্রতিবন্ধকতা হয়ে উঠে আমার দাসানুদাস। সৃষ্টির আনন্দে তখন মেতে উঠে আমি হারিয়ে যাই মনোভূমির বিশালতাকে জয় করার নেশায়। শব্দের বিশাল ভাণ্ডারকর তখন আমার কাছে মধুভাণ্ডের মতো লাগে। আমি আকণ্ঠমগ্ন হয়ে পান করতে থাকি শব্দপূর্ণ মদিরার পেয়ালা। এই বিশ্বচরাচরের শব্দপদবন্ধনীর মধ্যে দৃষ্টি ও মন পড়ে যেতে থাকলে আমি আনন্দযজ্ঞে এবং আনন্দসঙ্গে মেতে উঠি।
ভেতরে ইষদোষ্ণতা অনুভূত হলেও বহিরাঙ্গনে মোটামুটি শীতল হাওয়া বইছে। মানুষজন গরম কাপড় গায়ে দিয়ে ঘুরলেও কানটুপি বা বাদরটুপি এখনো পরতে শুরু করেন নি। ফলে শীতের যে শিরশিরানি সেটি এখনো গায়ে কাটা দেয় নি বলে কিছুটা হতাশ। সকালবেলা মুখ থেকে ধুয়া বের করতে করতে এক টুকরো সোনাঝরা রোদে গা হেদানো এখনো চোখে পড়ে নি। দুপুরবেলা স্নানের আগে গায়ে শর্ষের তেল মেখে খড়ের গাদায় ওম নেবার সময় এখনো হয় নি। আহা! কি মজা। খড়ের গাদায় গা এলিয়ে দিয়ে গরম মুড়িভাজা খাওয়ার দিনগুলি আমি খুজে ফিরি এখনো। লাই শাকের ভর্তায় ভুরিভোজ করে ভাতঘুমে কাতরানোর দিন আমি উদযাপন করি। জলপাইয়ের মাখামাখা পুটিমাছের ঝোল আর লাটিমাছের ভর্তা, শুটকীর চেচা ভর্তা, পাটায় পেষা সিদলের ভর্তা ধনে পাতা মিশিয়ে খাওয়া আমার পুরনো অভ্যেস। তেলছাড়া ডিম ভাজি করে সকালের রুটি খাওয়া এখন রুটিনে পরিণত হয়েছে। রাজরোগ থেকে আরোগ্য লাভের কোনো ফুসরৎ আমার কোনোদিনই হবে না। তাই রসনাবিলাসী থেকে রসনাবিয়োগীর খাতায় নামটা লিখিয়ে নিলাম বেচে থাকার জন্য। সুস্থতার জন্য। ইদানিং খাবারে কোনো প্রকার তেলমশলার সংমিশ্রণ এড়িয়ে চলছি। সহকর্মীরা চিড়িয়াখানার জন্তুর মতো হা- করে আমাকে দেখেন। কিছুটা অবাকও হয়। কিন্তু এ হচ্ছে বেচে থাকার আরেক লড়াই। রসনা নিবৃত্তি করতে পারলে অনেকদিন না হোক একটিদিন বেশী বাঁচতে পারি আমি।
ভাটিবাংলা ঘুরে ঘুরে দেখছি অনেকদিন থেকে। দুই হাজার ষোলতে এসে ছাড়িলাম নৌকাপুরাণ ভাটির দিকে। উজান স্রোতে দাড় বেয়ে চলা। বেচে থাকার আরেক লড়াই। জীবনের ক্রান্তিকাল এখন যেমনি পেরুচ্ছি তখনও তেমনি চলছিলো৷ তবে দু হাজার বিশের মতো এতো অমসৃণ কোনোকালেই ছিলো। এখন পুলিশকে সামলাতে হয়, গুণ্ডাকে সামলাতে হয়৷ একসময় পুলিশের সাথে আড্ডা দিতাম, বেডমিন্টন খেলাম লুৎফুর আর আমি। ক্রান্তিলগ্নে এসে পুলিশ কিছুটা ডোমিনিয়ন আচরণ করছে বিভীষণের চাপে পড়ে। আমি কিছুটা মানসিকভাবে আহত বোধ করেছি। এখন আর সেই চাপকে চাপ বলে মানছি না৷ কিছুটা অস্থিরতার দোলাচালে ভুগছি। আমি একটা ক্ষুদ্র মানুষ। কিন্তু এতো দায়ভায় কাধে নিয়ে চলছি। মাঝে মাঝে মনে হয় অরণ্যে আচ্ছাদিত কালিম্পং চলে যাই। কিন্তু ভাটিবাংলা ফেলে কই যাবো? এখানেই আমি যাবতীয় যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতির মন্ত্র খুজে পাই৷ প্রাণের উচ্ছ্বাসে মেতে উঠার উসকানি পাই। বাঊল করিমের গান, রাধারমণের জলে না যাইও, চিড়াবাড়া হাসন রাজার মনের দুখ ফালদি ফালদি উঠে রে, নেশা লাগিলো রে, বাকা দুই নয়নে নেশা লাগিলো। আমি মায়াঘোরের পাশাপাশি নেশার ঘোরও কাটিয়ে উঠতে পারি না। আর পারি না বলেই আমাকে যাযাবরের জীবন বেছে নিতে হয়েছে। যে জীবন দোয়েলের, যে জীবন ফড়িঙের। আমি তাই বলে উঠি, আমি যে নুতন, আমি যে পুরাতন, আমি যে সনাতন, আমি যে তোমারই মতন। একধরনের আয়নাবাজিতে মেতে উঠা জীবন চিলিক মেরে উঠে। সকল ফুটানি লুটিয়ে পড়ে আমার পায়।সকল অসম্ভবের পায়ে বেড়ি পরিয়ে দিতে অকুণ্ঠ সাহস দেখিয়ে সামনে এগিয়ে চলার দৃপ্তকণ্ঠ শপথ নিই।
ভাটিবাংলা হচ্ছে আমার কাছে ব্রহ্মলোক, বিষ্ণু আর শিবের লীলাভূমি। এখানে এলেই মনে হয় আমি আশি হাজার যোনি পরিভ্রমণ এবং পরিক্রমণ করে এসেছি। জ্ঞানচক্ষু মেলে ধরতে দুর্বিনীত হয়ে পড়ি। জীবনের চাকা দুর্বার এবং দুর্নিবার গতিতে সঞ্চালিত হয়।
আমি এখন যেখানে শুবো বলে ঢেরা গেড়েছি এর থেকে অনতিদূরেই আমার সাইজ্বী বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম চিরশান্তিতে শুয়ে আছেন উজান ধল গ্রামে৷ কোন মেস্তুরী নাও বানাইলো রে, কেমন দেখা যায়,ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খি নায়, সারাসিধা ছুবের বেলা কার পানে কে চায়, মদনমাঝি বড় পাজি, মাঝ দরিয়ায় নাও ডুবায় গানটি যখন শুনি তখন আধ্যাত্মিকতার মাঝে ডুবে যেতে থাকি। কিম্বা আমি বাংলা মায়ের ছেলে গানটি যখন শুনি তখন দেশপ্রেমের আকুলতা আমাকে বিলোলিত করে। পৃথিবীর পাঠশালা থেকে জ্ঞানাহরক আমার সাইজ্বী আমাদেরকে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন।
আমার পরম গুরু হাসন রাজা যখন মাইল্লা বুড়ির জ্বালায় অতীষ্ঠ তখন আমি তার সাথে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দেখি। কি দারুণ আত্মবৈদগ্ধতা এবং চিত্তবৈভবে ঋদ্ধ ছিলেন তিনি সেটি তার সৃষ্টিসম্ভারে ডুব না দিলে বুঝা কঠিন৷ যে কারণে তিনি হয়ে উঠেন আমার দুঃখমোচনের আধার এবং আধেয়। আমার উদ্দেশ্যবিহীন জীবন তখন একটা কিনারের লাগল পায়, একটা পথের দিশা পায়।
লোকে বলে বলে রে ঘর বাড়ি ভালা নায় আমার, যখন উচ্চারণ করেন তিনি তখন বিত্তের বৈভব ম্লান হয়ে যায়, চিত্তের বৈভব বেড়ে যায়, জাগতিক চাকচিক্যকে উষ্টা মারতে শেখান আমরা যারা বিত্তের পেছনে ছুটে চিত্তের সুখকে নস্যাৎ করে ফেলি তাদের।
তাই আমিও বাকীটা জীবন সকল ক্রান্তিকালকে জয় করার প্রতিজ্ঞা করি। ভাটিবাংলার নানাপ্রান্তে ও প্রান্তরে থাকা চিত্তবৈভবকে আহরণ করতে চাইবো। লালডেঙ্গি চালের ঘ্রাণে রসনাতৃপ্ত নয়, নিবৃত্তি ঘটাবো। আগের বাহাদুরি যেখানে নাই হয়ে গেছে বলে সাইজ্বী বলে গেছেন।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, শব্দকথা টোয়েন্টিফোর ডটকম।