শিশুদের টিকাদান ও স্বাস্থ্যসহকারীদের অবরোধ প্রসঙ্গ
:: আবু সালেহ আহমদ ::
আমরা জানি আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। শিশুরা হচ্ছে মা-বাবার অত্যন্ত আদরের ধন। কে না চায় তাঁর শিশু সুস্থ থাক? শিশুদের সুস্বাস্থ্য ও সুরক্ষার কথা ভেবে মাননীয় সরকার ১৯৮৯ সাল থেকে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসুচি (ই.পি.আই) চালু করেছিলেন। এ কর্মসুচির আওতায় বর্তমানে শিশুদের যক্ষা,ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি,হাম,পোলিও,নিউমোনিয়া,হেপাইটিস-বি,ধনুষ্ঠংকার ইত্যাদি রোগের প্রতিষেধক টিকা দেওয়া হয়ে থাকে। আর এই কর্মসূচি যারা মাঠপর্যায়ে সরাসরি বাস্তবায়ন করে থাকেন তাঁরা হলেন স্বাস্থ্য বিভাগের স্বাস্থ্য সহকারীগণ। অনেকে তাদেরকে স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে চিনেন। এই স্বাস্থ্য সহকারীগণই বৃষ্টিতে ভিজে রৌদ্রেপুড়ে ঝড়-ঝান্ডা উপেক্ষা করে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যবার্তা, প্রতিষেধকমূলক টিকাদানের পাশাপাশি গ্রামের সহজ-সরল জনগোষ্ঠি যারা প্রায়ই অপুষ্টি, ডায়রিয়া, আমাশয়, যক্ষা, কুষ্ঠ, ম্যালেরিয়া, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি, প্রজনন স্বাস্থ্য, করোনা, দূর্ঘটনা জনিত রোগে জর্জরিত। সর্বপ্রথম তাদের পাশে-দাঁড়িয়ে সেবা দিয়ে থাকেন। তারা ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে কৃমি ও ভিটামিন- এ ক্যাপসুল বিতরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন কর আসছেন। সি.এইচ.সি.পি নিয়োগের পূর্বে তারাই কমিউনিটি ক্লিনিকে ঔষধ বিতরণ করেছেন। এখনো সপ্তাহে দুইদিন কমিউনিটি ক্লিনিকে সেবা প্রদান করে আসছেন। বাড়ি-বাড়ি ঘুরে জীবন ঝুঁকি নিয়ে তারাই এদেশ থেকে গুটিবসন্ত, পোলিও দুর করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠির কাছে অত্যন্ত আপনজন হয়ে উঠেছেন। ইতিমধ্যেই এ কর্মসুচির সু-ফল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। শিশু ও মাতৃ-মৃত্যু কমে আসছে। শিশু অপুষ্টি, অসুস্থতা, পঙ্গুতা থেকে উল্লেখ যোগ্য হারে রেহাই পেয়েছে। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য সহকারীদের টিকাদান কার্যক্রম সফলতার জন্য সরকার ও তার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দেশে বিদেশে পুরস্কৃত ও প্রসংশিত হচ্ছেন। আমরা হয়ত অনেকেই জানিনা স্বাস্থ্য সহকারীগণ কিভাবে গ্রামে-গ্রামে টিকাদানের সেবা দিয়ে থাকেন।
জানা যায়, তারা সাবেক ওয়ার্ডে ৮টি নির্ধারিত টিকাদান কেন্দ্রে মাসে একবার টিকা প্রদান করে থাকেন। শিশুর দেড়মাস বয়স থেকে শুরু করে ১৮মাসের মধ্যে ৫বার টিকাদান কেন্দ্রে নিয়ে আসার মাধ্যমে উল্লেখিত রোগের বিরুদ্ধে প্রতিষেধক টিকা সম্পন্ন করে থাকেন। এছাড়াও তাঁরা ১৫-৪৯বৎসরে মহিলাদেরকে ধনুষ্ঠংকারের টিকা দিয়ে থাকেন। এ টিকা দিলে মহিলা,মা ও শিশু দু-জনই ধনুষ্ঠংকার থেকে বেঁচে থাকতে পারেন। গ্রামের মানুষের কাছে ‘গ্রাম্যডাক্তার’ হিসেবে পরিচিত এসব স্বাস্থ্যসহকারীরা স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তারা আজ অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। তাদেরকে ট্রেনিং প্রদানের মাধ্যমে টেকনিক্যাল মর্যাদা দেওয়ার কথা থাকলেও তা কার্যকরী হচ্ছেনা বলে জানা যায়।৯০ দশকে সরকার এর বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারীরা যেখানে কম বেতন বা সমবেতন পেতেন তারা আজ সকলেই স্বাস্থ্য সহকারী, সহ স্বাস্থ্য পরিদর্শক, স্বাস্থ্য পরিদর্শক এর চেয়ে তিন চার ধাপ বেতন বেশি পেয়ে থাকেন বলে জানা যায়।
বিগত ১৯৯৮ সালে ৬ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য সহকারীদের এক মহাসমাবেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য সহকারীদেরকে টেকনিক্যাল পদমর্যাদা দেওয়ার ঘোষনা প্রদান করলে তা আজও বাস্তবায়িত হয় নি। ২০১৮ সালে সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রীও এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে মাঠভাতা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন দাবি দাওয়া গুলো বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। গত ২০/০২/২০২০ বর্তমান মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সাবেক স্বাস্থ্য সচিব মহোদয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এর ডিজি মহোদয় সহ সকল লাইন ডাইরেক্টর মহোদয় গনের যৌথ স্বাক্ষরে দাবিগুলো ৬ মাসের মধ্যে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছিল। দাবিগুলো অদ্যবধীয় পূরণ না হওয়ায় স্বাস্থ্য সহকারীরা তাদের এসোসিয়েশন এর মাধ্যমে বিগত ২৬/১১/২০২০ ইং থেকে লাগাতর অবরোধ চালিয়ে আসছেন। জানা যায় অন্যান্য সরকারী বিভাগের সমপর্যায়ের চাকুরিজীবী থেকে তারা সুযোগ-সুবিধা কমই পাচ্ছেন। তাদের মাঠভাতা একেবারেই নগণ্য। অন্য বিভাগে মাঠ-পর্যায়ে কর্মচারীদের ছাতা, সাইকেল, কাগজ, কলম, ড্রেস প্রদান কারার রেওয়াজ থাকলেও স্বাস্থ্য বিভাগে তা দেওয়া হচ্ছে না। স্বাস্থ্য সহকারীদের কাজকর্ম তদারকীতে প্রথম যারা পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন তারা হচ্ছেন, সহস্বাস্থ্য পরিদর্শক ও স্বাস্থ্য পরিদর্শক। তারা পূর্বে অনেক বিভাগের সাথে সমান বেতন পেয়ে থাকলেও বর্তমানে পাচ্ছেন অনেক কম। তাদের দাবিগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে।
লেখক: বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও লোক গবেষক।