দুই হাজার বিশের বিষাদময় বড়দিনের প্রার্থনা
:: তানিজা খানম জেরিন ::
বৈশ্বিক করোনাকালে এবারের বড়দিন পালন হবে নিরানন্দের; থাকবেনা কোন উপহার বিতরণ ও চার্চের প্রার্থনা এবং আত্মীয় স্বজনের সাথেও দেখা-সাক্ষাত, সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে এবার নিজ ঘরে বসেই বড় দিনের উৎসব স্বল্প পরিসরে পালন করতে হবে। কিছু কিছু চার্চে হয়তোবা প্রার্থনা হবে কিন্তু বেশী সংখ্যক চার্চেই প্রার্থনা ভার্চুয়াল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী বিশ্বে সর্বত্রই একইরকম ভাবে ভার্চুয়াল প্রার্থনা হবে। বড়দিন শুধুমাত্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়েরই শুধু বড় উৎসব নয় বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রেই এই উৎসবটিকে প্রধান ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পালন করে থাকেন এবং দু’শতাব্দী ধরে সামাজিক অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। স্মর্তব্য যীশু খ্রিস্টের জন্মের চার’শো বছর পর্যন্ত বড়দিন পালন নিষিদ্ধ ছিল কালের প্রবাহে এই বড়দিন উৎসবটি বিশ্বে আজ সামাজিক অনুষ্ঠানে রূপ নিয়েছে এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে সবাই সাড়ম্বরে পালন করে থাকেন।
দুই হাজার বিশ বছর পূর্বে ইজরায়েলের নাসারাতের বেথেলহাম নগরে এক কুমারী মাতা মরিয়মের গর্ভে অলৌকিক-ভাবে যীশু জন্ম গ্রহণ করেন। খ্রিস্টান ধর্ম অনুসারীদের মতে যীশুকে নিয়ে তিন ধরণের মতবাদ আছে; এক অংশ অনুসারীদের মতে যীশু নিজেই ঈশ্বর রূপে পূজিত হয় আরেক অংশের মতে যীশুকে মনে করা হয় ঈশ্বরের পুত্ররূপে বাকীদের ধারণা যীশু ঈশ্বর প্রেরিত বণী-ঈসরাইলের শেষ নবী হিসেবে। উল্লেখ্য অনেক নবী রাসূলেরই বিশেষ মুজেজা ছিল ঠিক তেমনই যীশু হাতে ছুঁয়ে দিলেই কুষ্ঠ রোগী ভালো হয়ে যেতো এবং অনেক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুক্তভুগীরাও তার কাছে গেলে আরোগ্য লাভ পেতো। বাইবেলে উল্লেখিত তেত্রিশ খ্রিস্টাব্দে পিলাতের রাজা অন্যায় ভাবে যীশুকে চাবুক মারে পরে রোমীয়রা যীশুকে ক্রশবিদ্ধ করে। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা মনে করে যীশুকে ক্রসবিদ্ধ করায় তার অনুসারীরা পাপ থেকে মুক্তির পরিত্রাণ পাবে।
শীতকালীন উৎসব, হানুকা, বড়দিন এবং নববর্ষ ঘিরে যে আনন্দ উৎসব মানুষের মনে বিরাজ করে ছিল তা এবারের করোনাক্রান্তি সব লণ্ড ভণ্ড করে দিল এইদিন গুলি পালনের জন্য মানুষ সারা বছর পরিকল্পনা করে থাকে। করোনা শুধু আমাদেরকে ঘরবন্দী করে রাখেনি বরং আমাদেরকে মানসিক ও অর্থনৈতিক সর্বদিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত করে রেখেছে। অদৃশ্য অনুজীব করোনা ভাইরাস দুইহাজার বিশ সনকে দুইহাজারবিষময় করে অর্থনৈতিক সঙ্কট, খাদ্য ঘাটতি, কর্ম-হীনতা ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বড়দিনের উৎসব হিসেবে নভেম্বর ও ডিসেম্বর এই দুইমাস মানুষ শুধু কেনা-কাটায় ব্যস্ত থাকে ক্রিসমাস ট্রি ও ক্রিসমাস কার্ডের জন্য আলাদা শপিং সেন্টার খোলা হয়ে থাকে এবার এই অদৃশ্য করোনা ভাইরাসের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষতি সহ ব্যবসায়ীরা বিরাট আয়ের উৎস থেকে বঞ্চিত হলো। আমেরিকায় প্রতিবছর বড়দিনের ছুটির পূর্বেই আড়াইকোটি মানুষ আসে শুধু ভ্রমণ করতে তা এবার কমে আধাকোটিতে নেমে এসেছে। আমেরিকার বিভিন্ন শহরের আলোকসজ্জ্বা ক্রিসমাস ট্রি ও বিভিন্ন দর্শনীয় স্হান পরিদর্শন করার জন্য এবার সব কিছু থেকেই পর্যটক এবং আমাদের শহরের মানুষও বঞ্চিত হলো কারণ মানুষ প্রতিক্ষণই আতঙ্কে দিন-কাটাচ্ছে আগামীকাল কি হবে! বড়দিন উপলক্ষে প্রতিবছরই মানুষ শপিংয়ে যেতো এবং সারারাত শপিং করতো এবার শপিংয়ে না গিয়ে বেশীর ভাগই ক্ষেত্রেই অনলাইনে শপিং সেরেছেন। জরিপ অনুযায়ী এবার আশি ভাগ মানুষই সরাসরি স্টোরে যায়নি এবং যাট ভাগ মানুষ অনলাইনে শপিং করেছেন।
নিউইয়র্কে থ্যাংকস গিভিং ডে পালনের পূর্ব থেকেই নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন শহর শপিংমল, রেষ্টুরেন্ট, চার্চ ও বাড়ী ঘর, নার্সিংহোম রাস্তার উপর যে আলোকসজ্জ্বায় আলোকিত করা হয় সত্যিই দৃষ্টিনন্দন মানুষ এক স্টেট থেকে অন্য স্টেটে লং ড্রাইভে বের হয়ে যায় এই নয়নাভিরাম রূপ উপভোগ করার জন্য। নিউইয়র্কে ক্রিসমাস ট্রি দেখার জন্য নতুন নিয়ম বেঁধে দিয়েছেন নিউইয়র্ক সিটির মেয়র ডি ব্লাসিও- টিকেট কেটে নির্ধারিত পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছয় ফিট দূর থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্রিসমাস ট্রি দেখতে হবে উপর্যোপরি এ আইন ভঙ্গ করলে জরিমানাও করা হবে এর পরিপ্রক্ষিতে নিউইয়র্ক সিটিতে ক্রিসমাস ট্রির লাইটিং দেখার জন্য পঁচাত্তর ভাগ লোক সমাগম নেই বললেই চলে শুধু নিউইয়র্ক শহরেই এ আইন প্রযোজ্য নয় অন্যান্য অঙ্গরাজ্য গুলির নিয়মনীতিও একইরকম। নিউইয়র্কের মত নিউ অরল্যান্স শহরেও সবচেয়ে বেশী আলোকসজ্জ্বা করা হয় পুরো শহরে সেখানেও এবার মানুষের প্রবেশ নিষেধ ছিল ঐ শহরের লোকজন এবার গাড়ীতে ভ্রমণ করেই আলোরসজ্জ্বার প্রদর্শনী পর্য়বেক্ষণ ও উপভোগ করেছেন এভাবেই বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন আঙ্গিকে শহরের আলেকসজ্জ্বিত রূপ বিভিন্ন নিয়মে প্রদর্শন করা হয়।
বড়দিন উপলক্ষে লক্ষ লক্ষ শিশু অপেক্ষায় থাকে সান্তাক্লস ওদের স্বপ্ন পূরণ করতে আগেরদিন রাত্রেই ওদের কাছে উপহার রেখে যাবে শিশুদের কাছে এটা একটা স্বপ্নময় রাত প্রতিটি শিশুই ওদের স্বপ্ন পূরণের আশায় থাকে এবং ওরা সান্তাক্লসের কাছে ওদের উইশ
চিঠি লিখে পাঠায় এবং সান্তাক্লস ওদের ইচ্ছা পূরণ করে দেবে শিশুরা মনে করে এবং বাস্তবে আমি আমার দুই বাচ্চাকে দেখেছি যখন ওরা স্কুলে পড়তো তখন স্কুলে ওরা ওদের টিচারের কাছে উইশ চিঠি লিখতো এবং স্কুল থেকে ওরা ওদের টিচারের কাছে থেকে গিফট নিয়ে আসতো এবং বাচ্চারাও টিচারকে গিফট দিতো। এবারের করোনায় প্রতিটা বাচ্চাই স্কুলে শীতকালীন কনসার্ট ও বড়দিনের উৎসব পালনের এবং বন্ধু বান্ধবের বাসায় পার্টি থেকেও বঞ্চিত হলো। বড়দিনের মূল অর্থ হলো ভালোবাসা, শান্তি, সততা, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, পাপ ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখা এই শিক্ষাই যীশুর জন্মোৎসবে যীশু পালন করতে বলেছেন। আমরা নিজেদের দৈনন্দিন জীবনেই যদি কাজে না লাগাই তাহলে আমাদের আগামী প্রজন্ম কিভাবে মানবতার কাজ করবে আমাদের প্রতিটা মানবের উচিত সবাই সবার সম্মান রক্ষা করে নতুন প্রজন্মকে মানবতা মূলক কাজে উৎসাহিত করা এটাই হলো সহমর্মিতা ও মানবতামূলক কাজ কাউকে ঘৃনা করে কেউ সাফল্য অর্জন করতে পারেনা। আমাদের প্রতিটা মা-বাবার উচিত ছেলে-মেয়েকে হিংসা-বিদ্বেষ ভূলে সকল জাতি ধর্ম, বর্ণ, উঁচ নিচ সব ভেদাভেদ ভুলে শুধু মানবতার জন্য কাজ করে যাওয়ার জন্য এটাই হলো মানবের মহৎ কাজ এটা সব ধর্মেরই কথা। আমাদের বাচ্চাদেরকে স্কুল থেকে শিক্ষকরা এই শিক্ষাই দিয়ে থাকে মানব কল্যাণ হলো বড় কাজ এবারের করোনার পরও যদি মানবের মনন চিন্তার পরিবর্তন না হয় তাহলে আমরা এই বিজ্ঞানের আবিস্কারের পিছনে কেন ছুটি তাহলেতো আমরা আদি যুগেই ফিরে যাইনা কেন আমাদের টিকাও লাগবেনা আবিস্কারেরও দরকার হবেনা। যীশুর জন্মোৎসব উপলক্ষে আমি নতুন প্রজন্মের কাছে একটা কথাই বলবো অন্ধকারের পর আলো আসবেই তোমরা তোমাদের বিজ্ঞানের গবেষণা চালিয়ে যাও এবং মানব কল্যাণমূলক কাজে এগিয়ে যাও বিশ্বকে নতুন রূপে গড়ে তোল এক মানব হও নতুন বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে। আগামী বড়দিন নিরোগ পৃথিবীতে করোনামুক্ত বিশ্বে নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে পালনের প্রত্যাশায় সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা।
তানিজা খানম জেরিন
কলামিস্ট, নিউইয়র্ক,আমেরিকা