কোভিড-১৯ যেদিন ভেঙ্গে-চুরে গুঁড়িয়েছিল আমার মন
:: মুহম্মদ আজিজুল হক ::
সুদীর্ঘ তিন মাস যাবত কিছু ন্যিউরোলজিক্যাল সমস্যার কারণে বেশ ভুগে সুস্থ হয়ে উঠতে না উঠতেই গত ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ধরা পড়লাম করোনাভাইরাসে্র নির্মম ফাঁদে। আমার স্ত্রী এবং আমি, একইসাথে। মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ি নি; কিন্তু সম্ভাব্য ভোগান্তি কতখানি হবে; সংসারে আর কতজন আমাদের দ্বারা সংক্রমিত হবে; শ্বাসকষ্ট কি হাসপাতালের দ্বারে দ্বারে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অবশেষে লাশের মিসিলে আমাদেরকে পাঠিয়ে দেবে কিনা -এসব দুশ্চিন্তা যে ছিল না তা হলফ করে বলতে পারি না -বিশেষ করে আমার সহধর্মিনীর ডায়াবেটিস ও আমার ষাটোর্ধ বছর বয়সের বিবেচনায়।
বাসায় ফিরেই দু’জনেই সেলফ-ইম্পোজড কোয়ার্যা ন্টিনে থাকা শুরু করলাম। ২০২০ সালের প্রায় শুরু থেকে আমার বড় মেয়ে দীপ্তি তার ছোট্ট দুটি সন্তানসহ আমাদের সাথে বাসায় অবস্থান কোরছিল। বড়টির বয়স সাড়ে তিন, নাম আইয়াজ, এবং ছোটটির মাত্র তিন মাস, নাম আরিজ। আমার মেয়ের সামরিক কর্মকর্তা স্বামী ডিফেন্স সার্ভিসেস কমান্ড এন্ড ষ্টাফ কলেজে ছিল এক বছরব্যাপী রিগোরাস প্রশিক্ষণে । ফ্যামিলিকে সময় দেয়া কঠিন হবে বিধায় ওদেরকে আমার মিরপুর ডিওএইচএস-এর বাসায় রেখেছিল। এ সু্যোগে আমার নাতিদের এবং বড় মেয়ের আনইন্টারাপ্টিড ও হৃদয়-জুড়ানো অনির্বাচ্য সুখ-সান্নিধ্য আমার স্ত্রী ও আমি প্রাণভরে উপভোগ করছিলাম। বলা নিষ্প্রয়োজন, আমার বড় নাতিটির অবাধ ও অপ্রতিরোধ্য বিচরণ ছিল আমার বাসার প্রতিটি কক্ষে ও কোণে। তার তিন চাকার ছোট্ট সাইকেলে চড়ে সে গৃহাভ্যন্তরে যখন যেখানে ইচ্ছে গমন করতো। হঠাৎ কোরেই আমাদের রুমে তার আসা-যাওয়ায় বাধা দেয়া হোলো। ওর মা এবং আমার বাসার গৃহপরিচারিকাদের ওপর সে ক্ষিপ্ত হোলো। জোর করে ঢুকতে চাইলো। আমাদের দরজায় হাত-পা ছুড়লো। না পেরে চীৎকার করে কাঁদলো। রুমের ভেতরে ওর নানুর (নানীর) এবং আমার খুব কষ্ট হোলো এই ভেবে যে আমাদের রুমে তার প্রবেশে এই আকস্মিক নিষেধাজ্ঞার কারণ ওর বোধগম্যতায় আসবে না কোনোভাবেই। বলা হোলো, নানা-নানুর অসুখ করেছে, ওখানে গেলে তোমারও অসুখ হবে। কিন্তু কার কথা কে শোনে! ও নিশ্চয়ই ভেবে পেল না কেন আমরা অকারণে সহসা ওকে দূরে ঠেলে দিলাম। কেন এমন নিষ্ঠুর হলাম। হঠাৎ কোরে কেন ওর প্রতি আমাদের সব আদর-আহলাদ নিঃশেষিত হয়ে গেল। কেন আমাদের দুয়ার ওর জন্য বন্ধ হোলো। ও কান্নাকাটি কোরলো। নানা-নানু করে চীৎকার কো্রে ডাকলো। ভেতর থেকে বৃথাই তাকে বুঝানোর প্র্য়াস পেলাম। বললাম, “ভাইয়া, আমাদের অসুখ সেরে গেলেই তুমি আমাদের কাছে আবার আসতে পারবে। তখন আবার তোমাকে কোলে নেবো, আদর করবো।” এমনভাবেই আরো তিন চারদিন সে আমাদের রুমে ঢুকতে চেষ্টা কোরে ব্যর্থ হয়ে কান্নাকাটি কোরলো; হাত-পা ছুড়লো। এরপর দু’তিনদিন সে আর আমাদের দরোজার সম্মুখে এলো না। তারপর এক মধ্যাহ্নে আবার এলো। দরোজায় তার সাইকেলের চাকার আঘাত পড়লো। তার হাতের টোকা পড়লো। আমার স্ত্রী ও আমি প্রমাদ গণলাম। ভাবলাম, তাকে পুনরায় ওরা জোর করে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে। আবারও সে কাঁদাকাটি কোরবে। আবার ওর মন ভাঙ্গবে। কিন্তু ঐদিন সে একটুও কাঁদলো না। শুধু বললো, “নানা, আমি চলে যাচ্ছি; আমি আসছি না।” তার এই ছোট্ট কথাটি আমার কানে এক অশুভ ও মর্মপীড়াদায়ক বাণী হয়ে অনুরণিত হোলো –“নানা আমি চলে যাচ্ছি;………নানা আমি চলে যাচ্ছি”………। আমার অন্তর্জগতে সমস্ত আকাশ কালো কোরে এক দুঃসহ বেদনার ঝড় উঠলো। সে ঝড়ে ভেঙ্গেচুরে গুঁড়িয়ে গেল আমার অন্তঃকরণ। আমার প্রবল ইচ্ছে হোলো রুমের বাইরে ছুটে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলি, “না ভাইয়া, তুমি চলে যাবে না! তোমাকে আমি কিছুতেই চলে যেতে দেবো না। তুমি আসো আমার ঘরে।” কিন্তু বাস্তবে তা তো করা যায় নি। এই ভয়ংকর কোভিড-১৯ মহামারির সংক্রমণের সম্ভাব্য বিপদে তো ওকে আমি ফেলতে পারি না। তাই হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সেদিন নীরবে সয়েছিলাম।
আমার বাসা থেকে কয়েক ব্লক পরেই আমার ছোট মেয়ের বাসা। তারও দুটি পুত্রসন্তান। বড়টির বয়স তখন দু’বছর, নাম নীলাভ্র। ছোটটির বয়স চারমাস, নাম সুপ্রভ। বেশ কয়েক সপ্তাহ ওদের বাসায় যাওয়া হয় নি। আর ডিসেম্বরে যখন করোনাক্রান্ত হলাম তখন তো আর যাওয়ার প্রশ্নই এলো না। ছেলে দু’টিকে বেশ মিস করছিলাম; বিশেষ কোরে নীলাভ্রকে। ও আমাকে দেখামাত্রই সবকিছু ফেলে দৌড়ে আসে কাছে। কথা বলা শেখে নি তখনো, দু’একটি শব্দ ছাড়া। আমাকে কখনো বলে নানা, কখনো মামা। কাছে এলেই দু’হাতে ওকে তুলে প্রথমে বুকের সাথে চেপে ধরি। পারস্পরিক হৃদয়ের উষ্ণতা তখন সঞ্চালিত হয় এক বুক থেকে আরেক বুকে, অদৃশ্যে। ভাবলাম ফেইসবুকের মেসেঞ্জারে গিয়ে ওদের সাথে একটু ভিডিও চ্যাট করি। ওপাশে আমার ছোট মেয়ে সেঁজুতি তার ল্যাপটপের ক্যামেরা অন করতেই দেখি সে খাটের ওপর উপবিষ্ট এবং নীলাভ্র তার গা ঘেঁষে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে। বেশ কয়েক সপ্তাহ পর আমাদের দেখা, যদিও ভার্চুয়ালি। আমাকে দেখামাত্র ভাইয়াটির চোখেমুখে, শরীরে আনন্দের যে অভিব্যক্তি আমি লক্ষ্য করেছিলাম তা আমৃত্যু বিস্মৃত হবো না। তার সে আনন্দ দর্শনে একটু অপ্রাসংগিকভাবেই আমার মনে পড়লো নজরুলের “আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে/মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে/………..মন ছুটছে গো আজ বল্গাহারা অশ্ব যেন পাগলা সে।” ওর নানুকে, এবং বিশেষ কোরে আমাকে, দেখে তার আনন্দ যেন সে আর ধরে রাখতে পারছে না। সেই আনন্দের ঢেউকে সামলিয়ে ওঠার জন্যই যেন একটুক্ষণ পরপর তার মায়ের পিঠের আড়ালে সে মুখ লুকাচ্ছিল। আবার থেকে থেকে আনন্দে ঘুরপাক খাচ্ছিল। এভাবে মাত্র মিনিট পনেরো কেটেছে। ভাইয়াটির উল্লাসে তখনো ভাটা পড়ে নি। এমন সময় আমার মেয়ে বললো, “আব্বু, আমরা লাঞ্চ খেতে টেবিলে বোসবো, ঠিক এমন সময় তুমি ভিডিওতে এসেছো। তাই এখন শেষ করি; পরে আবার ভিডিওতে আসবো।” বিদায় নেবার জন্য যেই না নীলাভ্রকে হাত নেড়ে টা-টা বললাম, ও যেন মনোদুঃখে পাথর হয়ে গেল। ও হয়তো ভাবতে পারে নি ভিডিওতে আমাদের এই দেখাশোনা এতটা দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। ওর আনন্দধারায় আমি যেন হঠাৎ কোরেই একটি কাঁচি চালিয়ে সেটিকে টুকরো টুকরো করে কেটে দিয়েছি নিষ্ঠুরভাবে। ও একটি প্রস্তরমূর্তির মতো নিথর ও নির্বাক হয়ে, এক স্থির, করুণ ও নিষ্পলক দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর, হঠাৎ কোরেই তার হস্ত দু’খানা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ভাবখানা যেন ক্যামেরার মধ্য দিয়েই আমি তাকে কোলে তুলে নিতে পারবো। এবার বাধ-ভাঙ্গা দুঃখে আমার কান্না পেল। কোয়ার্যান্টিনের সব বাধা-নিষেধ উপেক্ষা কোরে আমার তখনই ছুটে যেতে ইচ্ছে হোলো ভাইয়াটির কাছে। কোভিড-১৯ মহামারি তার যাতাকলে আরো একবার আমার মনটিকে পিষ্ট কোরে একেবারে গুঁড়িয়ে দিলো।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের আক্রমণ বা কোভিড-১৯ মানুষকে অমানবিক আচরণে বাধ্য করেছে। রোগটি এতটাই সংক্রামক যে রোগাক্রান্ত কোনো ব্যক্তি থেকে বা এ রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ মৃত্যুবরণ করলেও তার লাশ থেকেও এই রোগ ছড়াতে পারে। তাই ভাই ভাইকে, স্ত্রী স্বামীকে, পুত্র পিতাকে, এক কথায় অতি আপনজনও তার আপনজনকে হাসপাতালে পাঠিয়ে আর দেখতে যায় নি বা যেতে পারে নি। এমনকি এ রোগে অতি আপনজনের মৃত্যু হলেও তার জানাযা ও দাফন-কাফনে সম্পৃক্ত হয় নি। দূরে থেকে যতখানি পেরেছে খেয়াল রেখেছে, রোগীর অবস্থা মনিটর করেছে। অথচ, মানুষ আপনজনকেই তো সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে, জীবনে-মরণে কাছে পেতে চায়। দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত বা মরণাপন্ন মানুষ তার আপনজনদের সামীপ্য কামনা করে, বুকে, মুখে, ললাটে তাদের প্রীতিময় ও স্নেহশীল হাতের স্পর্শ চায়, মুমূর্ষু রোগীর শ্বাসযন্ত্র যখন রুদ্ধ হয়ে আসে, তখন সে শয্যাপাশে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে প্রিয়মুখগুলি খুঁজে ফেরে, মৃত্যুযন্ত্রণা মোকাবেলায় জিহবা যখন কাষ্ঠবৎ হয়ে যায় তখন মুখে পানি চায়, যদিও তা ব্যক্ত করার শক্তি তখন তার থাকে না।
গত বৎসরাধিক কালব্যাপী কত করুণ কাহিনী যে শুনেছি তার ইয়ত্তা নেই। কত নাবালক অবুঝ বাচ্চারা যে দেখেছে তাদের অসুস্থ বাবা বা মাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তারপর, হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে তাদের বাড়িতে ফিরে আসার অধীর প্রতীক্ষায় তারা কাটিয়েছে কত দিন কত রাত, কিন্তু প্রিয় বাবা বা মা আর ফেরে নি। বাবা যে কোথায় গেল কেন যে আর ফিরে এলো না তা আর তাদেরকে বোঝানো যায় নি। এইতো মাত্র কয়েকদিন পূর্বে আমাদের প্রতিবেশী ফ্লাটের প্রৌঢ় মালিক করোনা ও অন্যান্য জটিলতায় মারা গেলেন। ভদ্রলোকের দুই প্রবাসী মেয়ে তাদের সন্তানদের নিয়ে দেশে ফিরলেন। সেই সন্ধ্যায় আমার ফ্ল্যাট থেকেই তাদের হৃদয়বিদারক কান্নাকাটিতে গভীর বিষণ্নতায় মন ভরে গেলো। একটি ছোট্ট মেয়ের আর্তক্রন্দনে নিদারুণ মর্মবেদনা অনুভব করলাম। মেয়েটি নানা নানা করে চীৎকার করে তার প্রিয় নানাকে ডাকছে আর কাঁদছে। কিন্তু নানা তো তার আর কোনোদিনই ফিরে আসবে না।
লেখক: চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত