বালাকোট থেকে কানাইঘাট: এক রক্ত পিচ্ছিল পথের যোগসূত্র
:: সরওয়ার ফারুকী ::
রুশ বিরোধী জিহাদী আন্দোলনের সময় কবি আল মাহমুদ তাঁর “হত্যাকারীদের মানচিত্র” কবিতায় লিখেছিলেন,
“একবার মধ্যরাতে এই ঢাকায় এক আফগান যুবক
আমাকে ঝাপটে ধরে কে’দে বলেছিল
না না আফগানিস্তান আমার দেশ, আমার—
ভালবাসা————।
শওকত,
হে পাঠান যুবক! বলো
আফগানিস্তান আজ কার দেশ নয়? আফগানিস্তান
সব স্বাধীন মানুষের অপহৃত মাতৃভূমি। শুধু
হত্যাকারীদেরই কোন মানচিত্র থাকে না,
নেই!”-
দিকে দিকে লাঞ্ছিত মানবতার মুক্তি আন্দোলনের এক পারস্পরিক পরম্পরাগত যোগসূত্রথাকে। ইতিহাস তার এই পরিক্রমা ধরে রাখে যুগ হতে যুগান্তরে।
বালাকোট। রক্তের অক্ষরে লেখা এক নাম। উপমহাদেশের লক্ষ কোটি মুক্তিকামী মানুষের‘স্বপ্নের মৃত্যু’র নাম এই বালাকেট ময়দান। শাহ আব্দুল আজীজ (রঃ) এর বিপ্লবী ঘোষণা“দারূল হরব” এর প্রভাবে প্রভাবিত এক মর্দে মুজাহিদ তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে আযাদীআন্দোলনের যে সংগ্রামী আন্দোলন সূচনা করেছিলেন বালাকোটের ময়দান ছিল তারআত্মদানের স্থান।
১৮৩১ সালে আহমদ শহীদ (রঃ) তার শিষ্যদের নিয়ে বহুমুখি ষড়যন্ত্রের ফলে শিখ ও বৃটিশলাল শেয়ালদের দ্ধারা শহীদী অমিয় পেয়ালা পান করে যখন জান্নাতের পথে চলে গেলেন তখনতার স্বপ্নের মৃত্যু হতে দেননি এ উপমহাদেশের আরও লক্ষ লক্ষ মর্দে মুজাহিদীন। ১৮২৬ সালেযে শহীদী কাফেলার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে ভারত ভিবক্তির মধ্য দিয়ে তা চুড়ান্তপূর্ণতা লাভ করে।
ইতিহাসের কোন ঘটনাই সম্পর্কহীন নয়। কার্যকারণ পরম্পরার ফলেই ঐতিহাসিক ঘটনারসুত্রপাত হয়। ১৭৫৭, ১৮৫৭, ১৯৪৭ সালের ঐতিহাসিক ঘটনাবলী পরস্পর অতপ্রোতভাবেজড়িত। মাওলানা শাহ আব্দুল আজিজ (রঃ) এর বিপ্লবী ফতোয়া উপমহাদেশের নি®প্র্রাণমুসলমানদের রক্তের মাঝে এক শিহরণ জাগিয়ে দিল। এই বিপ্লবী ফতোয়ার প্রভাবে তারই শিষ্যসাইয়েদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে এবং তার জামাতা মাওলানা আব্দুল হাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রমাওলানা ইসমাঈল শহীদের সেনাপতিত্বে গঠন করা হল মোজাহিদ বাহিনী। এই মোজাহিদবাহিনীর একমাত্র লক্ষ ছিল খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্টা করা এবং তার পথে প্রতিবন্ধকতাসৃষ্টিকারী (শিখ ও ইংরেজ)দের বিরুদ্ধে জেহাদ পরিচালনা করা। নব গঠিত এই মোজাহিদবাহিনী ১৮২৬ সালে রায়বেরিলী ত্যাগ করে এবং এ মোজাহিদ বাহিনীর সংখ্যা অতি অল্পদিনেই ১২হাজার হতে ১লক্ষে উপনীত হয়। ১৮৩০ সালে এই বাহিনী পেশোয়ার দখল করে।বালাকোটের যুদ্ধের আগ পর্যন্ত শিখদের সাথে বেশ কয়েকটি সংঘর্ষেই সাইয়েদ আহমদকে লিপ্তহতে হয় এবং প্রায় সব যুদ্ধেই শিখরা মোজাহিদ বাহিনীর সাথে পরাজিত হয়।
নবগঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে কেন্দ্র করে সাইয়েদ আহমদ পরবর্তী পর্যায়ে ইংরেজ কবলীত সাবেক‘দারূল হরব ভারত’ পুনরুদ্ধারের জন্য আরও অধিক শক্তি সঞ্চয় করতে প্রস্তুতি গ্রহন করেন।অপর দিকে পরাজিত শিখ নেতা রনজিৎ সিংহও প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হয়। তারাইংরেজদের সাথে আতাঁত করল এবং দ্বিমুখী শক্তির মেকাবেলা করার জন্য মোজাহিদ বাহিনীওপ্রস্তুত হল। মোজাহিদ বাহিনীর অনেক উপজাতীয় পাঠান সৈন্যেরা শিখদের অর্থলোভ সংবরণকরতে পারলনা। এই ত্রিমুখী শত্র“র দেয়ালে পরিবেষ্টিত বাহিনী বালাকোট নামক ময়দানেযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে বীর বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়ে। ইতিহাসের পাতায় রক্ত রঞ্জিত এ যুদ্ধেবিশ্বাসঘাতক খুবি খাঁ নামক এক পাঠানের বিশ্বাস ঘাতকতায় সাইয়েদ আহমদ বেরলভী ওমাওলানা মাহ ইসমাঈল দেহলভী (রঃ) ১৮৩১ সালে শাহাদাৎ বরণ করেন। ভারতবর্ষীয়ইতিহাসের এই পট পরিবর্তনশীল যুদ্ধে কানাইঘাটের দু’জন বীর মাওলানা মুজাহিদ অংশ গ্রহণকরেছিলেন বলে জানা যায়। বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মুহিউদ্দীন খান এর অভিমতঅনুযায়ী এদের একজন ছিলেন ছোট মেয়াছাবের বাবা এবং অপরজন ছিলেন ———–। (এব্যাপারে মুহিউদ্দীন খান সাহেব সহ বিশেষজ্ঞদের অভিমত বিস্তারিত নেয়া প্রয়োজন।) কিন্তু এযুদ্ধ কি থেমে গিয়েছিল। না, থামেনি। আযাদী আন্দোলন চলতে থাকে এক রক্ত পিচ্চিল পথবেয়ে।
১৮৫৭ সাল। ঐতিহাসিক ‘সিপাহী বিপ্লব’এর মাধ্যমে আযাদির জন্য পাগলপারা মজলুমজনতার ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটে। বালাকোটের শহীদি কাফেলা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেসমগ্র ভারত ব্যাপি। কিন্তু দুর্ভ্যাগ্যের কালোমেঘ দির্ঘায়িত হল। ব্যার্থ হল সিপাহী বিদ্রোহ।১৮৫৭ সালের এই ব্যার্থতা আযাদী আন্দোলনের পুরো প্রকৃতি পরিবর্তন করে দেয়। স্থানে স্থানেইংরেজ চক্ষু এড়িয়ে চলে শিক্ষা সংস্কুতির চর্চা ও জেহাদের অনুকূল কাজ।
অবশেষে ১৮৬৬ সালে মাওলানা কাসেম নানতুবী (রঃ) এর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্টিত হয় বিশ্বখ্যাতবিদ্যাপিঠ ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’। হাজী ইমদাদুল্লাহ (রঃ) পবিত্র মক্কা শরীফে এ সংবাদ শুনারপর বলে উঠলেন, “সোবহানাল্লাহ! আপনারা মাদ্রাসা প্রতিষ্টা করেছেন। আপনি কি জানেনগভীর রাতে কি পরিমান মস্তক এজন্য সিজদায় পড়ে থাকে।”
দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম শিক্ষক ছিলেন মোল্লা মাহমুদ সাহেব আর প্রথম ছাত্র ছিলেনমাহমুদুল হাসান। এই দুরুল উলুম দেওবন্দের আদলেই পরবর্তীতে অসংখ্য অগনিত মাদ্রাসায়ছেয়ে যায় পূরো ভারতীয় উপমহাদেশ।
আযাদী আন্দোলনের পথ পরিক্রমা বেয়ে ১৯১৯ সালে ২৩শে নভেম্বর শুরু হয় প্রথম খেলাফতসম্মেলন। যে খেলাফত আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন আলী ভ্রাতৃদ্ধয় ও দেওবন্দের প্রথমছাত্র মাওলানা মাহমুদুল হাসান।
গোটা উপমহাদেশের এ উত্তেজনাকর মুহুর্তে কেমন ছিল জৈন্তিয়া খাসিয়া পাদদেশের এ অঞ্চল।পাহাড়ী হিমেল হাওয়ায় বেড়ে উঠা এ অঞ্চলের গণমানুষের রক্ত জেহাদী জোশে টগবগ করতেথাকে। মাওলানা মহমুদুল হাসান এর সহচর্যে দেওবন্দেরই এক কৃতি ছাত্র ইব্রাহীম তশ্না ফারুকী১৮৯৮ সালে দেওবন্দ মাদ্রাসার আদলে উমরগঞ্জে এসে প্রতিষ্টিত করেন মাদ্রাসায়ে ইমদাদুলউলুম এবং উক্ত অঞ্চল কেন্দ্রিক চলতে থাকে তাহযীব তামাদ্দুনের চর্চা। ১৯০৬ ইংরেজীতেএখান হতেই প্রবর্তিত হয় দেশের প্রথম ইসলামী জলসা। ইসলামী জলসার এ ভিন্নধর্মীআয়োজনের মাধ্যমে আযাদী আন্দোলণের স্পিরিট ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছিল সাধারণ চাষাভুষাকৃষক জনতার মাঝে অত্যন্ত চুপিসারে। ১৯২২ সাল। বৃটিশভারত জুড়ে দুর্বার গতিতে চলছেখেলাফত আন্দোলন। ইবরাহীম তশ্না প্রবর্তিত ইসলামী জলসা সমুহ তখন খেলাফতআন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু তথা ঝঢ়রৎরঃ ঈবহঃবৎ হয়ে উঠেছে। ঠিক এমনই সময় ১৯২২ সালের২৩শে মার্চ কানাইঘাট মাদ্রাসার জলসা উপলক্ষে বিশাল জনসভা আহুত হয়। হযরত ইব্রাহীমতশ্না (রঃ) এর সভাপতিত্বে জলসার কার্যক্রম শুরু হলে বৃটিশ ইসলাম বিরোধী সরকার উক্তজলসা নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারার জারি করে। সুরমা ভেলির কমিশনার জ্বে. ই. ওয়েবষ্টারঘঠনাস্তলে উপস্তিত হন। ঘঠনার প্রেক্ষাপঠে জনতার মাঝে দারুন ক্রোধের সৃষ্টি হয়। কমিশনারগুর্খা ও পুলিশ বাহিনীকে গুলি বর্ষনের আদেশ প্রদান করলে ঘঠনাস্থলেই শহীদ হন: মৌলভীআব্দুস সালাম (বায়মপুর), মোঃ মুসা মিয়া (দুর্লভপুর), আব্দুল মজিদ (নিজ বাউরবাগ), হাজীআজিজুর রহমান (সর্দারী পাড়া), ইয়াসিন মিয়া (চটিগ্রাম)। এই ঘঠনার জের ধরে কানাইঘাটেরজনগনের উপর অকথ্য নির্যাতন চালানো হয়। ধরে নিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় নেতৃত্বেথাকা ইবরাহীম তশ্না (রঃ) সহ অনেক বুজুর্গানে দ্বীনকে। জেলখানায় যখন তাঁর উপর অকথ্যনির্যাতন চালানো হয় তখন তিনি গর্জে উঠে বলেছিলেন, “বন্দি অবস্থায়ও আমরা স্বাধীনতারসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি। ইহা কখনও মনে করবেন না যে আমরা এখানে বৃথা সময় নষ্ট করছি।আমরা কখনও খৃষ্টান সরকারের ভয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম ত্যাগ করতে পারিনা। রূহ জগতেআমরা করুণাময় আল্লাহর কাছে ওয়াদা করেছি যে আমরা দ্বীনের জন্য ও ন্যায় বিচারের জন্যসংগ্রাম করবই করব।” এ দীপ্ত উচ্চারণ স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে কালের ফলকে৷
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় আমাদের গৌরবের রাজমুকুট যেসব শহীদদের মাথায় পরানোরকথা ছিল তারা আজ ইতিহাসের অন্তরালে পড়ে রয়েছেন। নতুন প্রজন্মের কেউ জানেনা সেইসব বীর শহীদদের নাম যারা বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে বৃহত্তর জৈন্তিয়া’র মধ্যে প্রথম শহীদহওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। আজও তাদের নামে হয়নি কোন দাতব্য প্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা অথবা অন্য কোন কিছু। ৪১ বছরের ছোট্ট ফিতায় ইতিহাস বন্দি বলেই হয়তবাআজ আর প্রয়োজন হচ্ছেনা এই সব আত্বত্যাগী মহাবীরদের। এ ব্যাপারে প্রশাসন এবং সুধীসমাজের পক্ষ হতে সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অপেক্ষায় রয়েছে দেশবাসী।
ইতিহাসের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় এ অঞ্চলও তার গর্বীত অংশীদার। ১৮৩১ সালেবালাকোটের ময়দানে যেসব বীর শহীদানদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে আযাদী আন্দোলনেরসুচনা হয়েছিল উপমহাদেশের আরেক নিভৃত পল্লী কানাইঘাটের বীর শহীদদের জীবনদানেরমাধ্যমে সেই শহীদি মিছিল আরও দীর্ঘ হয়েছিল। বালাকোট হতে কানাইঘাট আজ হয়ে উঠুকবিশ্বজুড়ে প্রান্তরে প্রান্তরে মানবতার মুক্তি আন্দোলনে লক্ষ বনীআদমের অনুপ্রেরনাস্থল এইআমাদের কামনা এই আমাদের প্রত্যাশা।
#তথ্যসুত্রঃ আযাদী আন্দোলনে আলেম সমাজের সংগ্রামী ভূমিকা– যুলফিকার আহমদকিশমতী, সিলেটের মাটি ও মানুষ–জনাব ফযলুর রহমান।