প্রচ্ছদ

দুর্ভোগ, ভোগান্তি, সংকটে সিলেটের বানভাসিরা

  |  ০৬:৩৩, মে ১৯, ২০২২
www.adarshabarta.com

আদর্শবার্তা ডেস্ক :

সিলেটের নগর এবং গ্রাম থেকে গ্রামান্তর নদীর পানি আর বানের জলে একাকার। বৃষ্টি না হলেও ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি পানিতে সিলেটের নদী ও হাওরের বুক আরো ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সিলেট নগরীতে আরও দুই ইঞ্চি পানি বেড়েছে।

এছাড়া জেলার উপজেলাগুলোতেও বন্যার পানি বেড়েছে। এ অবস্থায় সিলেট জেলা ও মহানগরের অন্তত: ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সুনামগঞ্জের চিত্রও প্রায় একই। এসব মানুষ বিশুদ্ধ পানি, খাবার, বিদ্যুত ও নানামুখী সংকটে দুর্বিষহ সময় কাটাচ্ছেন। এছাড়া বানভাসি মানুষ গবাদিপশু নিয়েও মহা বিপাকে পড়েছেন।

বুধবার আকাশে সূর্যের দেখা মিললেও পানি হ্রাসে কোন প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বুধবার বেলা ১২টায় পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সিলেটের প্রধান নদী সুরমা কানাইঘাট (সিলেট) পয়েন্টে বিপদসীমার ১২৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সুরমা সিলেট পয়েন্টে ১৩ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপদসীমার ৪২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে সুনমাগঞ্জ পয়েন্টে ১৭ সেন্টিমিটার কমে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এছাড়া কুশিয়ারা নদীর পানি অমলসিদ (সিলেট) পয়েন্টে ২০ সেন্টিমিটার বেড়ে এখন বিপৎসীমার ১৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপরদিকে শেওলা (সিলেট) পয়েন্টে নদীটির পানি বেড়েছে আট সেন্টিমিটার, এখন তা বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের পূর্বাভাসে আরো বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট ও সুনামগঞ্জের নি¤œাঞ্চলের কতিপয় স্থানে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হতে পারে।
নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সিলেট ফায়ার সার্ভিস অফিস, সিলেট বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, উপমহাপুলিশ পরিদর্শকের কার্যালয়, কোতোয়ালি থানা, বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়, তোপখানা সড়ক ও জনপথের কার্যালয়, সোবহানীঘাট পুলিশ ফাঁড়ি, বিদ্যুতের আঞ্চলিক কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পানি ঢুকেছে। নগরীর বন্যাকবলিত এলাকা ও উপজেলাগুলোর বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি।

প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও বানভাসি মানুষের সূত্রে জানা গেছে, সিলেট নগরের অন্তত ৩০টি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকায় হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি আছে। উপজেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্লাবিত হয়েছে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও সিলেট সদর উপজেলা। জেলার ১৩টি উপজেলার হাজারো গ্রাম পানিতে একাকার।

সিলেট নগরের তপোবন, সুরমা ও লেকসিটি বুধবার সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে দুর্ভোগের ভয়াবহ চিত্র। সিলেট নগরের এই তিন এলাকার অবস্থান পাশাপাশি। এসব এলাকায় এখন থই থই পানি। এসব এলাকার কয়েকশ’ পরিবার এখন ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে। তিনটি এলাকার মূল রাস্তাসহ পাড়া-মহল্লার রাস্তায় কোথাও হাঁটুপানি, আবার কোথাও কোমরসমান। পানিতে ময়লা-আবর্জনা ভাসছে। ছড়াচ্ছে উৎকট দুর্গন্ধ। কোথাও কোথাও গ্যাসের লাইন থেকে বুদ্বুদ করছে গ্যাস। রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করলেও তা ছিল সীমিত। বাসিন্দারা তাই নৌকা ও ভ্যানে করেও চলাচল করছে।

স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, এই তিন এলাকার পাশে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। ফলে এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষক-শিক্ষার্থী বসবাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। ফলে পানিতে ভিজে হেঁটে হেঁটেই তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করছেন। হাঁটতে গিয়ে অসাবধানতাবশত অনেকে পা পিছলে দুর্ঘটনায়ও পড়ছেন। তবে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউই বাসার বাইরে বেরোচ্ছেন না। পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় পাড়া-মহল্লার বেশ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ আছে।

একাধিক শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তপোবন, সুরমা ও লেকসিটি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা মেস করে থাকেন। কয়েকশ’ শিক্ষার্থী এসব এলাকার মেসে থাকছেন। বন্যার পানি ক্রমাগত বেড়ে চলায় কয়েক দিন ধরে মেসে নিয়মিত বুয়া আসছেন না। ফলে খাবারের সমস্যায় পড়েছেন শিক্ষার্থীরা। পানি থাকায় একাধিক মেসের ছাত্রীরা ক্যাম্পাসের আবাসিক হল ও অন্যত্র থাকা বান্ধবীদের বাসায়-মেসে আশ্রয় নিয়েছেন।

শুকনা খাবার গলা দিয়ে নামেনা :
সিলেট নগরের বন্যাক্রান্ত আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন অনেকে। তাঁদের খেতে দেওয়া হচ্ছে শুকনা খাবার। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের একটাই ভাবনা, বন্যা পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হবে, কবে ফিরতে পারবেন বাড়ি। যদিও পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। সুরমা নদীর অধিকাংশ পয়েন্ট বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

সিলেট কিশোরী মোহন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ষাটোর্ধ্ব রেজিয়া বেগম। একই আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন তাঁর ছেলে কবির হোসেন (৩৫) ও নাতি ফারহান হোসেন। বন্যা পরিস্থিতি তুলে ধরে রেজিয়া আরও বলেন, ‘একটু একটু করি পানি বাড়ছিল। মঙ্গলবার সকালে আর ঘরে থাকা যায়নি। কাঁথা-কম্বল নিয়া বাইরে আইতে ওইছে। আশ্রয় নিছি স্কুলে। ইখানে গত মঙ্গলবার রাইত চিড়া আর গুড় দিছে। হুকনা খাওয়ার (শুকনা খাবার) গলা দিয়া নামে না। চিড়া ভিজাইয়া গুড় দিয়া মাখিয়া খাইছি।’

রেজিয়ারা থাকেন নগরের যতরপুর এলাকার নুরুল হকের কলোনিতে। সোমবার রাত থেকে পানি বাড়তে থাকে। মঙ্গলবার সকালে সেটি প্রায় বুকপানিতে পৌঁছায়। তিনি বলেন, ‘ঘরের আসবাবসহ সবকিছু খাটের উপর তুলে রেখে এসেছি। ছেলে কবির হোসেন সকালে ঘরে গেছে অবস্থা দেখতে। আশ্রয়কেন্দ্রে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছে না। খাওয়ার পানির জন্য সিটি করপোরেশনের একটি গাড়ি রয়েছে স্কুলের সামনে। এ ছাড়া স্কুলের শৌচাগার রয়েছে। বিদ্যুৎ-ফ্যান সবই রয়েছে। তবে খাওয়ার সমস্যা আছে। আশ্রয়কেন্দ্রে শুকনা খাবার দিলেও রান্না করার কোনো ব্যবস্থা কিংবা রান্না করা খাবার সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। এ ছাড়া বৃষ্টিতে ভিজে শরীরে জ্বর এসেছে। ওষুধের ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।’

আশ্রয়কেন্দ্রটি সিটি করপোরেশনের ১৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায়। ওই এলাকার মীরাবাজার, যতরপুর এলাকার বাসিন্দারা থাকছেন ওই কেন্দ্রে। পাঁচতলার এ ভবনটিতে ৪২টি পরিবারের ১৭৫ জন বাসিন্দা আশ্রয় নিয়েছেন।
এদিকে, সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, আগামী কয়েক দিন এই বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। তাছাড়াও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টিও কমছে না। তাই পাহাড়ি ঢল নামায় পানি বাড়ছে।

এদিকে, নগর ছাড়াও সিলেট জেলার ১৩ উপজেলা ও সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে জকিগঞ্জ, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, সিলেট সদর, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার এবং সুনামগঞ্জের ছাতক, সদর, তাহিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলায় সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানি। এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেমন ত্রাণ তৎপরতা কম, তেমনি নেই উদ্ধার তৎপরতা। বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। অজানা আতংকে মানুষজন নির্ঘম রাত পার করছেন। এ অবস্থায় সেসব এলাকায় মানবিক সংকট দেখা দিতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।

তবে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত বুধবার বলেন, জেলায় ২৭৪টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৭৮টি ব্যবহার হচ্ছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ৬ হাজার ৪৭৫ জন। ২২০টি গবাদিপশুও আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই পেয়েছে। মানুষজন রাতের বেলা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকলেও সকালে অনেকে বেরিয়ে গেছেন নিজেদের ঘরবাড়ি দেখতে কিংবা কাজে যোগ দিতে। তাঁরা রাতের বেলা এসে আবার আশ্রয় নেবেন বলেও জানিয়েছেন।

বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন দেড় লাখ গ্রাহক :
বন্যায় সিলেট নগরসহ বিভিন্ন উপজেলার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রায় সাড়ে ১১ লাখ গ্রাহকের মধ্যে দেড় লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে।
সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগ এবং সিলেট পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ ও ২-এর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে সিলেট বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দুটি উপকেন্দ্র ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির দুটি উপকেন্দ্রে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে চারটি উপকেন্দ্রের গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। (দৈনিক জালালাবাদ)