ঘুরে আসা স্বদেশ এবং পল্লীবাংলার স্মৃতি
: : এবিএম সালেহ উদ্দীন : :
পৃথিবীব্যাপী সর্বগ্রাসী মহামারি করোনাভাইরাসের আতঙ্ককে সঙ্গে করেই বলা যায় তড়িঘড়ি নিউইয়র্ক থেকে ঢাকার উদ্দেশে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রওনা হই। শীতের সকাল। সেদিন নিউইয়র্কে বরফ পড়েনি। আগেকার বরফঢাকা শীতের তীব্রতা কমেনি। মেঘলা আকাশের এক গমগমে পরিবেশ। সূর্যিমামার দেখা নেই। এরই মধ্যে দেশে নেওয়ার জন্য রেজভীনের রেডি করে দেওয়া ইয়া বড় লাগেজ দুটো পুত্র রেদওয়ান গাড়িতে তুলে দিল। এবার বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে গাড়িতে উঠলাম।
শীত আছে। তবে শীতের কাঁপুনি নেই। ভারী জ্যাকেট বহন করতে হবে না। এ সময় বাংলাদেশেও তেমন শীত নেই। বরং কয়েক দিনের মধ্যে গরম পড়া শুরু হবে। শুধু স্যুট পরলেই যথেষ্ট। আমার বিদায়বেলায় রেজভীন বারান্দায় কফি হাতে দাঁড়িয়ে। আগেও একবার কফি পান করা হয়েছে। তবু তার সম্মানে জাস্ট এক চুমুক গরম কফিতে ঠোঁট ভিজিয়ে বাকিটা ওর হাতে দিয়ে দিলাম। তার চোখ দুটো ছলছল করছে। আমি যাচ্ছি, সে যেতে পারছে না। বিদায়বেলায় বুকের ধুকধুকানিটা মনে হলো বেড়ে গেছে। তাকে বুঝতে দিলাম না। নীরব ইশারায় হাত নাড়িয়ে বিদায় নিলাম। পুত্র রাইহান ড্রাইভ করছে।
এতক্ষণে আমরা কুইন্স ভিলেজ পেরিয়ে ক্রসআইল্যান্ড পার্কওয়েতে উঠলাম। দুদিকে পাতাবিহীন সারি সারি গাছ দাঁড়িয়ে আছে। শীত যখন আসে, ওদের পাতাগুলো ঝরে যায়। রিক্ততার অনুষঙ্গে ওরা ঘুমোতে থাকে। আবার যখন শীত চলে যায়, নিপাট কুঁড়িতে চিরায়ত সবুজে গাছগুলো জেগে ওঠে। ইতিমধ্যে বেল্ট পার্কওয়ের বুক চিরে আমরা জেএফকে বিমানবন্দরের ৪ নং টার্মিনালে পৌঁছালাম। পুত্রদ্বয় আমাকে কিছুই ধরতে দিল না। লাগেজপত্র গাড়ি থেকে নামিয়ে টেনে রেদওয়ান এয়ারলাইন্সের নির্দিষ্ট কাউন্টারে চলে গেল। আর রাইহান গাড়ি রাখতে চলে গেল পার্কিং লটে। কাউন্টারে বোর্ডিং কার্ড পেতেও খুব একটা দেরি হলো না। বিমানের মহিলা অফিসারকে একগুচ্ছ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলাম। অতঃপর পুত্রদ্বয়কে স্নেহাশীষ জানালাম। তাদের সঙ্গে কোলাকুলি করে বিদায় নিয়ে আমি ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে চলে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে ওরা অদৃশ্য হয়ে গেল।
নিউইয়র্কের শীতার্থ আবহাওয়ায় সেদিন বরফকুঞ্চিত তুষারপাতের ফলে আমাদের উড়োজাহাজ ছাড়তে দেড় ঘণ্টা বিলম্ব হলো। একাকী সফরে মজা নেই। অনেকটা অস্তযৌবনা নারীর মতো। কোনো রসকষ নেই। আগেকার সফরে সঙ্গী জুটে যেত। প্যান্ডামিকের ঠেলায় সবাইকেই চওড়া মূল্য দিতে হচ্ছে।
আমি তো কোনো নামকরা পরিব্রাজক নই। বিশ্বজয়ী নেপোলিয়ন, ইতিহাসের খ্যাতিমান বিশ্ব পরিব্রাজক ইবনে বতুতা নই। দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো বিভূতিভূষণ অথবা ভ্রমণপ্রেমী চিরযৌবন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী নই আমি। আমার তেমন কোনো সাহিত্যজ্ঞানও নেই যে মুজতবা আলী কিংবা বিভূতিভূষণের মতো প্রাণোচ্ছল উদ্দীপনায় শব্দের ফুলঝুরিতে সাহিত্যের বর্ণময় ঔজ্জ্বল্যে সবাইকে মাতিয়ে রাখতে পারব।
এখন শুধু সমাপ্তির ইতিটানা। আমি শ্রান্ত। জীবননৌকার সায়াহ্ন-সন্ধ্যায় ধাবমান একজন ক্লান্ত পথিক। তারুণ্যের নির্মিলিত আস্বাদনকে অতীতের ঘনঘটায় রেখে এখন শুধু নিরাসক্ত গড়িয়ে যাওয়া। রিক্ততার নিরস বিপন্নতায় স্রোতের টানে ভেসে যাওয়া। তবুও কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায় বলতে হয় : ‘আরো এক বিপন্ন বিস্ময়/ আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে।’
জেএফকের ওয়েটিং লাউঞ্জে রসহীন বসে থাকার চেয়ে আরেকবার গরম কফিতে চুমুক দিলে মন্দ হয় না। প্রথমে স্টারবাক কপিশপ খুঁজলাম। পাওয়া গেল না। অতঃপর ম্যাকডোনাল থেকে এক প্যাকেট আপেল পাই এবং ডানকিন থেকে মাজারি সাইজের ব্ল্যাক কফি নিয়ে আবারও কাচের জানালার পাশে গিয়ে বসলাম। ইতিমধ্যে কয়েকজন বন্ধুর সাথে ফোনালাপ হলো। রেজভীনের সঙ্গে কয়েকবার। কিছুক্ষণ পরপর সে শুধু কল দিয়ে যায় : ‘এটা করবে, ওটা করবে। রেস্টরুমে গেলে অবশ্যই টয়লেটের উপরাংশ ওয়াইবস দিয়ে মেজে শুকনো ন্যাপকিন দিয়ে মুছে নিতে হবে। সাবানে হাত ধোয়া আর বারবার হ্যান্ড স্যানিটাইজ তো বাধ্যতামূলক।’ তার নির্দেশিত বয়ান একদিকে মগজে ঢুকছে আর কফির ধোঁয়ায় উদ্্গীরিত হয়ে শূন্যে লীন হয়ে যাচ্ছে।
এতক্ষণে দুবাইগামী যাত্রীতে রুম ভরে গেছে। ৭ নম্বর গেটের ওয়েটিং রুমটি গমগম করছে। কিছুক্ষণ পর সবাইকে আমিরাত এয়ারলাইন্সের বিরাটকায় দ্বিতল জাম্বো ইকে০৪০২ নং ফ্লাইটের যাত্রীদের লাইনে দাঁড়ানোর ঘোষণা ধ্বনিত হলো। আমরা লাইনে দাঁড়ালাম। প্লেনে উঠলাম। প্লেনে ঢোকার পর এয়ার হোস্টেজ সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে সবাইকে যার যার সিটে বসার অনুরোধ জানালেন। হাতের ক্যারিঅনটি মাথার উপরের ক্যাবিনেটে রেখে আমি উইন্ডো সাইডে নির্ধারিত সিটে বসলাম। কানে লাগানো এয়ারফোনে আবার রেজভীনের ফোন বেজে উঠল। বললাম, হ্যাঁ, এখন প্লেনে। এবার সে আমাকে দোয়া পড়ার নির্দেশিকা জারি করল। আমি বললাম, শিরোধার্য।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ও স্নোর মধ্য দিয়ে আমাদের প্লেন রানওয়ে বেয়ে চলা শুরু করছে। ১০ মিনিটের মধ্যে প্লেনটি ক্ষিপ্র গতিতে ঊর্ধ্বাকাশে উঠে গেল।
আমাদের উড়োজাহাজ যখন মেঘমালাকে ভেদ করে সোজা ঊর্ধ্বাকাশের ৩৬ হাজার ফুট উপরে, তখনো নিচের অতলে চোখ গেল। কত নদ-নদী, জঙ্গলাকীর্ণ বন-বনানী, পাহাড়-পর্বত, সুন্দর সুন্দর সাজানো উপত্যকা আর গিরিপথ দেখে দেখে আমরা এখন শূন্য চরাচরে ভাসছি। কোথায় ছিলাম, এখন কোথায় আমরা।
আকাশ যেন অন্তহীন বিস্তৃতির সীমার মধ্যেই বিরাজিত। তবু মানুষ আরও কত উপরে যেতে পারে। আসলে পৌনঃপুনিকতায় লক্ষ্যমাত্রার একটি স্বাভাবিক পরিসীমার মধ্যেই মানুষের পায়চারি। মানুষ চাঁদ পর্যন্ত গিয়েছে, তার উপরে নয়। মাঝে মাঝে আমাদের সুবিশাল জাম্বো বিমানটি পাখির মতো ঝাপটায় উড়ে চলছে। আট ঘণ্টার অধিক আটলান্টিক মহাসাগরের উপর পাড়ি দিয়ে যাওয়ার সময় মাঝে মাঝে বিমানটি অক্লান্ত ওঠা-নামায় দোল খাচ্ছিল। শূন্যে ভেসেও সাগরের হিমেল পরশ ছোঁয়া পাওয়া যায়। জীবনের বাঁকে বাঁকে কত বিস্ময় আর বৈচিত্র্যের সঙ্গে মানুষের দেখা মেলে। সৃষ্টির অতল রহস্যে ডুবেও কোনো কূলকিনারা পাওয়া যায় না।
মাঝপথের বিরতিতে পৌঁছানোর পূর্বেই ঘোষণা দেওয়া হলো, তিরিশ মিনিটের মধ্যে আমাদের বোয়িং দুবাই ইন্টরন্যাশনাল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবে। আস্তে আস্তে বিমানটি নিচের দিকে নামছে। আমার দৃষ্টি অতলান্ত ভূপৃষ্ঠের দিকে। এয়ারপোর্টের কাছাকাছি দুবাই নৌবন্দর। নানা বর্ণের জলযান চোখে পড়ছে। বিপুল জলরাশির সঙ্গে ছোট ছোট নীল-সবুজ হ্রদগুলো নয়নাভিরাম অপূর্ব দৃশ্যের খেলা খেলছে।
নিউইয়র্ক ত্যাগ করার পর সব মিলিয়ে টানা ১২ ঘণ্টা আকাশচারী থাকার পর অবশেষে আমাদের বিমানটি দুবাই এয়ারপোর্টের ভূমি স্পর্শ করল। শূন্যে ভাসমান উত্তুঙ্গ মেঘমালা ভেদ করে এতক্ষণে স্থলত্বের ছোঁয়া পাওয়া গেল।
ছাত্রজীবনে (আশির দশকে) দুবাই গিয়েছিলাম। তখনকার চেয়ে বর্তমানে দুবাই বিমানবন্দরের পরিধি, চাকচিক্য ও শান-শওকত অনেক বেড়েছে। সেই বর্ণনা অন্য কোনো সময় দেওয়া যাবে।
দুবাইতে তিন ঘণ্টা লে ওভার। চেকিংয়ে ঢোকার আগে বিমানবন্দরে সকালের নাশতা সেরে নিলাম। বিমানবন্দরে বেশ কয়েকটি কফিশপ, স্কাক্স বার আছে। আমি স্টারবাকে কফি পান করছি। রেজভীনকে কল দিলাম। ঘুমের ঘোরে ভাঙাগলায় সে ফোন ওঠাল। তার সাথে কথা বলে নিলাম। অতঃপর স্থানীয় সময় দুপুর ১২টার দিকে পুনরায় আমিরাতের ইকে-৫৮৬ বিমানে আমরা ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম।
২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পৌঁছাই। সেদিন ছিল শনিবার। অপরাহ্ণের সায়াহ্ন বিকেলের ঘোলাটে মেঘমালার ফাঁকে আকাশ থেকেই চোখ ছুঁয়েছিল ঢাকা শহরের কূল-উপকূল, দালান-কোঠা, সজল সবুজের ঘন আভরণে। ঊর্ধ্বাকাশ থেকে নিচের দিকে তাকাতেই হৃদয়মন্দিরে অতীতের স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠল। আস্তে আস্তে আমাদের প্লেনটি বিমানবন্দরের মাটি স্পর্শ করল। আমার দেহজুড়ে শিউরে ওঠা উথাল-পাতাল তোলপাড়। বেদনার নিগড় থেকে হৃদয়-মন দুমড়ে-মুচড়ে কেঁদে উঠল।
এতকাল প্রিয় স্বদেশের বাইরে থাকার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সায়াহ্নকালে কত আপনজনকে হারিয়েছি। আত্মীয়-স্বজনসহ জানা-অজানা কত সহজ-সরল মাটির মানুষ এত দিনে নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আমার বিপর্যস্ত ভাঙা হৃদয়ের চাপা কষ্টবোধকে নিয়েই বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশন-সংক্রান্ত কাজ সেরেই দেখি, আমার জন্য এক তরুণ অফিসার দাঁড়িয়ে আছে। সে আমার লাগেজপত্রসহ ইত্যাকার ব্যাপারে হেল্প করল এবং ট্রলিটি গাড়িতে উঠিয়ে দেওয়ার জন্য আমার সাথে বাইরে চলে এল।
এয়ারপোর্টে আমাকে পিকআপ করার জন্য শ্যালক অধ্যাপক ড. তারিক সিরাজী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি নিয়ে অপেক্ষমাণ। সঙ্গে তার ছোট কন্যা নুসরাত এবং শ্যালিকা শিরীন সিরাজীর পুত্র তৌফিক হোসাইন। আরও আছে সস্ত্রীক ছোট শ্যালক তানভীর রেজা সিরাজী এবং তাদের শিশুপুত্র তামিম। বেরোনোর পর তামিমের হাতের বড় একটি ফুলের ঝাপি দ্বারা আমাকে সাদর সম্ভাষণ জানানো হলো।
ঢাকায় তখন বিকেল পাঁচটার মতো। এত দিনে হয়তো ঢাকা শহর ফাল্গুনের ফুটন্ত ফুলে ভরে গেছে। হয়তো রমনার ছায়াঘেরা পার্ক ভরে গেছে কৃষ্ণচূড়ায়। তারুণ্যের নিপাট মেলায় উত্তাল উন্মাদনায় মেতে উঠেছে তরুণ-তরুণী। ভাবনাবৃত্তে অস্তমিত যৌবনের এলোমেলো কথকতা আমার নিবিড় অন্তরে আনাগোনা করছে। এতক্ষণে শরীরের ক্লান্তি ভাবটাও কেটে গেছে।
এই কয়েক বছরে ঢাকা শহরের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। প্রাসাদোপম বিল্ডিং গড়ে উঠেছে শহরের উপকণ্ঠে আনাচ-কানাচে। নতুন নতুন গাড়ির বহর দেখে বোঝার উপায় নেই, বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি দারিদ্র্যপীড়িত জনবহুল দেশ। রাস্তাঘাট তকতকা হয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক জ্যাম কমেনি, বরং বেড়ে গেছে বহুগুণে।
শনিবারের ঘনায়মান সন্ধ্যার আগমনী বার্তায় অপরাহ্ণের মেঘলা ভাব কেটে গিয়ে পশ্চিমাকাশের ঝিলিক ঝিলিক সূর্যালোক আর মিষ্টি বাতায়ন একাকার হয়ে আছে। আকাশের যূথবদ্ধ পাখিরা উড়ে উড়ে ঘরে ফিরছে। বিমানবন্দর থেকে নেমে আসা সড়ক-মহাসড়কের বুক চিরে দুদিকের সুরম্য বর্ণিল দালান-কোঠার দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে আমরা ক্যান্টনমেন্টের চৌহদ্দি পেরিয়ে গণভবনের (প্রধানমন্ত্রীর অফিস) সামনে দিয়ে পুরোনো বিমানবন্দরের কাছাকাছি চলে এলাম। এখানে পতাকাসদৃশ সুন্দর গোলচত্বর নির্মাণ করা হয়েছে। সন্ধ্যার সামরিক প্যারেড স্কয়ার রোড হয়ে শেরেবাংলা নগরের চন্দ্রিমা উদ্যানের গাঢ় আঁধারের কাঞ্চি ধরে সুবিস্তৃত মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে এক নিরিখে সংসদ ভবনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
স্বাধীনতার পূর্বে (আইয়ুব খানের জমানায়) পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম আর্কিটেক্ট এবং বহুমাত্রিক কারিগরের মিলিত প্রয়াসে প্রতিষ্ঠিত এই সুরম্য ভবনের বর্ণময় আলোয় জড়িয়ে আছে কিংবদন্তির সুউজ্জ্বল সম্পৃক্তি। কত শাসক-প্রশাসক ও ঝানু রাজনীতিকের মিলনমেলায় সিক্ত হয়েছে ইতিহাসসমৃদ্ধ ঐতিহ্যবাহী সংসদ ভবন। ছাত্রজীবনের কত ফুলেল সন্ধ্যার বর্ণিল স্মৃতি এখানে লুটোপুটি খায়। কোলাহলমুখর মধুরতম নিবিড় আলো-আঁধারিতে বন্ধুজনের সাথে কত দিন ঘুরে বেড়িয়েছি। কত মোহময় সবুজের শীতল আস্তরণে গাছগাছালির স্নিগ্ধ ছায়ায় কেটেছে চন্দ্রিমা উদ্যানের বিহার সন্ধ্যা। স্মৃতির মণিকাঞ্চন মিশ্রিত ভাবনাবিলাসের মধ্য দিয়ে আলো ঝলসানো ২৭ নম্বর হয়ে সাত মসজিদ রোডের বুক বেয়ে অবশেষে আমরা বাসায় চলে এলাম।
ঢাকায় জরুরি কাজের একটা রুটিন করা আছে। দেশে নেওয়ার জন্য কেনাকাটাসহ অন্যান্য কাজ সেরে এক সপ্তাহ পর ভোলা রওনা হই। আমার সঙ্গে স্নেহভাজন ভাগনে বিল্লাল আছে। তার বাসা সেনানিবাসে। সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আছে। আমার জন্য তাকে কয়েক দিনের ছুটি নিতে হলো। বিল্লাল তার বাসা থেকে ঢাকা সদরঘাট পৌঁছে আমায় কল দিল। আমি তখনো রাস্তায়। ট্রাফিক জ্যামের জন্য এগোতে পারছি না। ধানমন্ডি থেকে বেড়িবাঁধের রাস্তা দিয়ে সোয়ারি ঘাট, বাদামতলী হয়ে অবশেষে সদরঘাট পৌঁছালাম। বিল্লাল টার্মিনালে এসে আমাকে এগিয়ে নিয়ে গেল। লঞ্চে ডাবল সিটের কেবিন পূর্ব থেকেই ঠিক করা ছিল। লঞ্চটি ছাড়বে রাত আটটায়।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম বাহন হচ্ছে লঞ্চ। বিপুল যাত্রী নিয়ে প্রতিদিন সদরঘাট থেকে শত শত লঞ্চ যাতায়াত করে। আমাদের লঞ্চটি বিরাট জাহাজের মতো। ধারণক্ষমতা ৮০০ অথবা আরও বেশি।
সহস্র বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বর্তমান বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহর। প্রাচীনতম ঐতিহ্যের প্রতীক বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে প্রায় সহস্র বছর আগে ঢাকা শহর গড়ে উঠেছিল। সেই ঢাকার শহরায়ণ এখন অনেক বিস্তৃত। একইভাবে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী নৌঘাট কালক্রমে বর্তমানে সদরঘাট নামে দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর ব্যবসা-বাণিজ্য ও চলাচলের অতিপ্রাচীন ব্যস্ততম নৌযানবহুল কোলাহলমুখর ঘাট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে।
ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা নদীর অববাহিকার এক স্রোতে মিশে বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি। বুড়িগঙ্গার জলধারা ধলেশ্বরীর মধ্য দিয়ে স্রোতোবাহী পদ্মা-মেঘনা, তেঁতুলিয়া নদীর বুক বেয়ে সুদূর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে মিশে যায়।
ইতিমধ্যে আমাদের জাহাজ ছেড়ে দিল। কেবিন বয় কফি দিয়ে গেল। কেবিনের সামনের রেলিংয়ের সাথে লাগোয়া চেয়ারে বসে কফি পান করতে করতে বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী দৃশ্যাবলি দেখছিলাম। জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা বহুল রঙিন অযুত স্মৃতির ঘুরপাকের মধ্যে সদরঘাট ছেড়ে লঞ্চ চলছে। কিন্তু দুদিকের দূষিত হাওয়ায় দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ল। লঞ্চের রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি, নদীর পেটভর্তি শুধু কালো পানি। দুর্গন্ধে টিকতে না পেরে কেবিনে গিয়ে বসলাম। বিল্লাল দরজা-জানালা বন্ধ করে দিয়ে এসি এবং ফ্যান ছেড়ে দিল। আগে লঞ্চের রেলিং থেকে দুদিকের জলরাশির খেলা দেখা যেত। এখন সম্ভব নয়। নদীর দুই কিনারের গার্বেজ-আবর্জনা জমতে জমতে বুড়িগঙ্গার পেট পচে গেছে। শহরের দুর্গন্ধযুক্ত নিষ্কাশিত ময়লার সঙ্গে পায়খানা, মৃত জন্তুর হাড়গোড়, টালি-নালার পাইপ পলিথিনের জঞ্জালভরা আবর্জনার স্তূপ স্খলিত হয়ে দূষিত হয়ে গেছে। কালো জলের বুক চিরে দুর্গন্ধযুক্ত বায়ুতে নাড়িভুঁড়ি গলে গলে বুড়িগঙ্গা এখন অসুস্থ ও বিপর্যস্ত।
স্বাধীনতার পর ভূমিদস্যুরা কী না করেছে। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি সোনাঝরা বাংলাদেশের অনেক খাল-বিল, নদী-নালাসহ স্থল ও জলপথের ভূমি-সম্পদকে গ্রাস করে ফেলেছে। লুট করেছে জাতীয় সম্পদ ও হাজার হাজার কোটি টাকা। দেশে সম্পদ লুণ্ঠনকারী দস্যুর অভাব নেই। যাদের দস্যুপনায় দেশের সরকারি ও বেসরকারি ভূমি দখল, নদী দখল, বন উজাড়, ফরেস্ট দখল, রাষ্ট্রীয় সম্পদ এবং গণমানুষের সম্পদ বিদেশে লোপাট হয়ে চলে যাচ্ছে।
একটি রাষ্ট্র ও সমাজ যখন নিরবচ্ছিন্ন খুন, ধর্ষণ, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সন্ত্রাস ও লাগামহীনভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়, তখন সেই বিপদ থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করার জন্য জনকল্যাণমুখী কার্যক্রম এবং একটি নিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক সরকারের কঠোর নীতির প্রয়োগ করা জরুরি হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে তা নেই। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অবক্ষয়ের গ্লানিতে পুরো দেশ জরাগ্রস্ত।
ইতিহাস কিংবদন্তি বুড়িগঙ্গার উচ্ছল ঢেউ ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে। প্রতিদিন হাজার হাজার নৌকা, লঞ্চ-স্টিমার ও নৌযান চলাচল করছে জীর্ণকায় রোগা উটের মতো। দুদিকের ভূমিদস্যুদের গ্রাসে নদীটি প্রাণহীন। মাঝেমধ্যে সরকারিভাবে বুড়িগঙ্গার গভীরতাকে জীবন্ত রাখার জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। নানান হাতের কাজ ও মলামলির পর ক্ষুদ্রাংশ দিয়ে যতটুকু সম্ভব জঞ্জালমুক্ত ও ভরাট করার মধ্য দিয়ে খননকাজ চালানো হয়। কিন্তু তাতে ময়লা পানি দূর করার ব্যবস্থা নেই।
৩০ মিনিটের মধ্যে আমাদের জলযান বুড়িগঙ্গার সঙ্গম ছুঁয়ে ধলেশ্বরীর বুকে চলে এসেছে। এতক্ষণে আমরা উচ্ছল নদীর কলকলানি, ছলছলানি ও উত্তুঙ্গ ঢেউয়ের খেলা দেখতে শুরু করলাম। দক্ষিণের হিল্লোলিত বাতাসের হিমেল পরশ গায়ে লাগছে। রাতের ঝিলমিল চাঁদের একথালা ছায়া পড়ে উত্তাল ঢেউয়ের সাথে দোলদোলায়মান। লঞ্চটি সারা রাত চলবে।
ভোর পাঁচ-ছয়টার মধ্যে চরফ্যাশনের বেড়িবাঁধের বেতুয়াঘাটে গিয়ে থামবে। সেখান থেকে আমরা চরফ্যাশনে পৌঁছাব। লঞ্চঘাটের কুলি আমাদের লাগেজপত্র একটি ইঞ্জিনচালিত অটোরিকশায় তুলে দিল। লঞ্চঘাট থেকে চরফ্যাশন বাজার আড়াই মাইলের মতো। ভোরের হিমেল হাওয়া ভেদ করে ক্ষিপ্র গতিতে পাকা রাস্তার বুক বেয়ে আমাদের অটো চলছে।
যত দূর চোখ যায়, হিমজড়ানো সবুজ আভরণের মাঠ, গাছ-গাছালি ভরা বন-বনানীর অপূর্ব দৃশ্যে অশ্রুসজল মোহময়তা। ইতিমধ্যে আমরা চরফ্যাশনে এসে পৌঁছালাম। আমার ছোট বোনের ছেলে ভাগনে মারুফের বাসায় সকালের নাশতা পর্ব সম্পন্ন হলো। ঘণ্টা দুয়েক রেস্ট নিয়ে মারুফসহ আমরা বাড়ির অভিমুখে রওনা দিলাম।
আমাদের গ্রামের বাড়ি চরফ্যাশন উপজেলার হাসানগঞ্জ গ্রামে। চরফ্যাশন বাজার পাঁচ মাইল উত্তর-পশ্চিমে। যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত পরম শ্রদ্ধেয় বাবা ও মা। আমার বাবা আলহাজ লুৎফর রহমান পণ্ডিত ১২ বছর আগে ইন্তেকাল করেন। তারও ১৯ বছর আগে আমার প্রাণপ্রিয় মা অজুফা খানম এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আমার মায়ের পাশেই বাবার কবরস্থান।
অনেক দিন পর দেশে যাওয়া। স্বদেশের হাওয়ায় দুলে উঠছে মন। জীবনতরীর অবস্থা যা-ই থাকুক না কেন, আমি আপন প্রত্যয়ে বাড়ির অত্যাবশ্যকীয় কাজগুলো সেরে যাওয়ার জন্যই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমাদের বাড়ির পাশেই (একেবারে লাগোয়া) বাবার কৈশোরের ছাত্রজীবনে দাদার গড়া বিরাট পুরোনো বাড়ি। সম্মুখস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, ঈদগাহ, কবরস্থানসহ আরও কত কী। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর ঘুরে দেখছি। চারদিকের সবুজ বন-বনানী, গাছ-গাছালি বাড়ি-ঘর আর বিস্তীর্ণ মাঠ-ঘাট, খাল-বিল ও নদীবেষ্টিত কোলাহলমুখর জনপদ। অনেক দিন পর যেন প্রাণভরে শান্ত-শুভ্র বাতাস নিচ্ছি।
মনে মনে গাইছি : ‘গ্রামছাড়া এই রাঙামাটির গায়/ আমার মন ভোলায় রে।’
আমার প্রিয় ছায়াঘেরা মনোমুগ্ধকর মায়াভরা এই হাসানগঞ্জ গ্রাম। ষাটের দশকের উষালগ্নে এই মৃত্তিকাকোলে আমার জন্ম। যে মাটির গন্ধ আর বাতাস-বায়ুতে বেড়ে উঠেছি শিশুকাল থেকে কৈশোর। জীবনের সবচেয়ে মধুময়, আনন্দঘন গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল সেটি। সেই স্মৃতিঘেরা গ্রামে এসেছি। স্মৃতিতে-সম্ভ্রমে এখনো চোখে ভাসে আমার প্রিয় মাতৃভূমির আলো-আঁধারি আর আধো-ছায়ার কত বর্ণময় দৃশ্য।
তাই তো নিজের বানানো পয়ারে গাই :
‘পাখি গান গায়
গাছ-গাছালির ছায়ায় ছায়ায়,
মধুঝরা মোহমায়ায়/ পল্লিমাতার স্মৃতিছায়ায়
হাওয়ায় হাওয়ায় হৃদয় ছড়ায়।’
আর যদি বাংলা সাহিত্যের মহীয়সী কবি বেগম সুফিয়া কামালের কণ্ঠে বলি:
‘বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি পল্লী মায়ের কোল,
ঝাউশাখে যেথা বনলতা বাঁধি হরষে খেয়েছি দোল।’
পল্লিবাংলার মধুময় গ্রামের ছায়ায়, হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরপাক খায় কত মায়াজালের বিচিত্র রূপের বাহারি মেলার ইতস্তত জীবনকাহিনি। জীবন্ত হয়ে ওঠে আসে কত স্মৃতি, বর্ণকুসুম মমতার বহর। দীপাঞ্চল ভোলার ১৯৭০ সালের প্রলয়ংকরী বন্যা এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাকার স্মৃতিবিজড়িত ছায়াঘেরা এই হাসানগঞ্জ গ্রাম।
এখানকার কত বৈচিত্র্যময় ঘটনার কথা জানি। জীবনের পাতায় পাতায় উন্মোচিত হয়ে ওঠে সোনাঝরা স্মৃতি। জীবনসত্তায় মিশে থাকা সেসব স্মৃতিকাহিনি পর্বে পর্বে সাজানো থাকে হৃদয়ের অন্দরে।
প্রাণপ্রিয় মা ও বাবার কবর জিয়ারত করে সবাই সম্মিলিতভাবে দোয়া করলাম। এবার বাড়িতে আসার আরেকটি কারণ মসজিদ, স্কুল, মাদ্রাসা ও এতিমখানার উন্নয়ন এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কাজ। আমাদের মসজিদটির বয়স ১০০ বছরের বেশি। তখন বাড়িঘর অনেক কম ছিল। এক-দুই মাইলের মধ্যে কোনো মসজিদ ছিল না। আমার দাদা পাঞ্জত আলী হাওলাদারের দানকৃত জমির ওপর ব্রিটিশ আমলে শণের ছাউনিতে সে মসজিদটি গড়ে উঠেছিল। তিন গ্রামের মুসল্লিসমাজ এই মসজিদে নামাজ পড়তেন। সময়ের ঘূর্ণক্রমে সেই মসজিদ এখন বিল্ডিংয়ে রূপান্তরিত।
মসজিদের দক্ষিণ পাশে কবরস্থান। এখানে গাছের শীতল ছায়ায় শান্ত ধারায় কত শত কৃতধন্য মানুষ অনাদিকালের তরে ঘুমিয়ে আছেন। এই প্রাচীনতম কবরস্থানে দাদা-দাদি, বাবা-মা, বহু আত্মীয়স্বজন পড়ে আছেন। প্রতিদিন প্রতিরাত দক্ষিণের হিন্দোলা বাতাস কবরের স্বর্গোদ্যানের উপর দিয়ে বয়ে যায়। মুয়াজ্জিনের সুমধুর আজানধ্বনিতে হাসানগঞ্জ তরঙ্গায়িত হয়।
আহ! পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া কবরের বাসিন্দাগণ কে কোথায় কেমন আছেন। আমরা জানি না। একমাত্র মহামহিম সৃষ্টিকর্তাই ভালো জানেন। মহান প্রভুর দরবারে আমাদের সম্মিলিত প্রার্থনা। আল্লাহ তাদেরকে জান্নাতের পরম ছায়ায় রাখুন।
আমি যখন দেশে, তখন চৈত্রের দাবদাহ বেড়ে উঠেছে। দিনে গরম রাতে হিমেল হাওয়ার উষ্ণ পরশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসত। বাড়ি এবং গ্রামের সকলের সঙ্গ-সান্নিধ্যে সিক্ত হয়ে এই যাত্রার কাজগুলো মোটামুটি সেরে অবশেষে পুনরায় ঢাকার উদ্দেশে রওনা দিলাম। বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে সবুজ-শ্যামল প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে সঙ্গীদের নিয়ে অটোরিকশায় এগোচ্ছি।
মহীয়সী কবি বেগম সুফিয়া কামালের কবিতার কটি লাইন মনে পড়ছে :
‘শিশির সিক্ত শেফালী ফুলে ঘন সৌরভে মাতি
শারদ প্রভাতে সখীগণ সাথে আনিয়াছি মালা গাঁথি।
পল্লী নদীর জলে ভাসাইয়া মোচার খেলার তরী,
কাঁদিয়া ফিরেছি সাঁঝের আলোর পুতুল বিদায় করি।
আগামী দিনের আশা-ভরসার কত না মধুর ছবি
ফুটিয়া উঠেছে আঁখির পাতায় ডুবেছে যখন রবি।’
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক