শিকড়ের সন্ধানে: সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার থেকে
সাদেকুল আমিন:
আজ রবিবার, ২৩ই জানুয়ারি, ২০২২ ইংরেজি। ইংরেজি নতুন বছর শুরু হয়েছে মাত্র তিন সপ্তাহ দুই দিন হল। বছরের প্রথম থেকেই যুক্তরাজ্যে করোনা ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ছড়াচ্ছে খুব দ্রুত।
গতকাল ছিল শনিবার, ২২.০১.২০২২ তারিখ। বিশেষ করে এই তারিখটি আমার কাছে বেশ স্বতন্ত্র মনে হয়েছে। কারণ, এতে মোট ৮টি সংখ্যা আছে আর এই ৮টি সংখ্যা আবার ইন্দো-আরবি সংখ্যা পদ্ধতির প্রথম ৩টি সংখ্যা নিয়ে গঠিত। এই ৩টি সংখ্যা হল ০, ১ এবং ২। নিউমেরলজিতে এই তিন সংখ্যার অর্থ ব্যাখ্যা করেছে বিভিন্ন ভাবে। যেমন, নম্বর ০ একটি নতুন শুরুর ইঙ্গিত দেয়, নম্বর ১ হচ্ছে প্রাথম সংখ্যা যা নতুন অধ্যায় শুরু করার জন্য অনুরোধ করে এবং নম্বর ২ অংশীদারিত্ব, সম্পর্ক এবং সম্প্রীতির প্রতিনিধিত্ব করে। আর ২০২২ সালের যোগফল ২+০+২+২ = ৬ হওয়ার কারনে সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী এ বছর হল 6 Universal Year. বাহ! বেশ মজার ব্যাপার, তাই না! আর যারা সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করেন তারা এ সবের অন্য কোন অন্তর্নিহিত অর্থ আছে কি না তা আরও ভালো বলতে পারবেন।
যাই হোক, রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় এ দিন সবাই একটু রিলাক্স মোডে থাকেন। আমার বেলায়ও এর কোন ব্যতিক্রম ছিল না। লন্ডনে, এখন শীতের মৌসুম এবং আজ বেশ ঠান্ডা পড়েছে। দিনের মধ্যাহ্ন ধীরে ধীরে শেষের দিকে এগোচ্ছে। আর সূর্য তার আপন গতিতে পশ্চিম আকাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখন হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপের নোটিফিকেশনে একটি পোস্ট আমার নজর কাড়লো। যার শিরোনাম ছিল “করিমগঞ্জ যেভাবে ভারতের অংশ হলো”। লেখক ড. অরুণদত্ত চৌধুরী। আর, লেখাটি আমাকে পোস্ট করেছেন লন্ডনে আমার অত্যন্ত প্রিয় ব্যাক্তি এডভোকেট মোহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ। যিনি বহুমাত্রিক জ্ঞান ও গুনাবলি সম্পন্ন একজন মানুষ। তিনি আশির দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
লেখাটি আমার নজরে আসার সাথে সাথে আমি তা এক নিঃশ্বাসে পড়ার চেষ্টা করি। প্রবন্ধটি বেশ তথ্যবহুল। উল্লেখ্য যে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় সিলেটে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। আর ওই গণভোটে সিলেটের মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট দেন। এতে তৎকালীন সিলেট সহ করিমগঞ্জের অনেক অজানা তথ্য ছিল। গণভোটের সময় সিলেট জেলার ডিসি ছিলেন বিয়ানীবাজার আলীনগর গ্রামের ছইয়দ নবীব আলী। আর করিমগঞ্জ মহকুমার মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন জকিগঞ্জের এম এ হক। পরে তিনি ডিআইজিপি ছিলেন। তিনি এক সময় ঢাকাস্থ জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সভাপতিও ছিলেন। তঁর সংসদীয় এলাকা জকিগঞ্জ ও কানাইঘাট। পরে তিনি তাঁর এলাকার এমপি নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশের ভূমিমন্ত্রী ছিলেন। করিমগঞ্জের ভবিষ্যত অবস্থান নিয়ে তৎকালীন এ দুই উর্ধতন সরকারি কর্মরতার ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির একটি ইন্ট্রীগিংগ (intriguing) বিবরণ ছিল এখানে। লেখাটি পড়ে আমার বেশ কিছু অজানাকে জানা হয়ে গেল এবং নিজের কিছু ভুল ভ্রান্তিও দূর হল। একটি সুন্দর লেখার জন্য লেখককে ধন্যবাদ। আর, পোস্টটি আমাকে পাঠানোর জন্য আমি ইজ্জত উল্লাহ সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে একটি ম্যাসেজ পাঠালাম। পরে, উনার সাথে ফোনে কথা বলে উনার কাছ থেকে টুকিটাকি কিছু সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঠিক তথ্যের নিশ্চয়তা সম্পর্কে নিশ্চিত হলাম।
গত প্রায় ১২২ (১৯০০-২০২২) বছরে, বঙ্গ বা বাংলা অঞ্চল মোট ৪ বার ভাগ হয়। ১৯০০ থেকে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত ব্রিটিশ শাসন আমলে ভারতীয় প্রদেশ বঙ্গ বা বাংলা ৩ বার ভাগ হয় এবং পরে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান (পূর্ববঙ্গ) ভাগ হয়।
১৯০৫ সালে ব্রিটিশরাই প্রথম বাংলাকে ভাগ করে। ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯শে জুলাই, ঘোষণা করেন এবং ১৬ই অক্টোবরে মাত্র তিন মাসের মধ্যেই তা বাস্তবায়িত হয়। তারা বৃহত্তর হিন্দু পশ্চিম অঞ্চল থেকে বৃহত্তর মুসলিম পূর্বাঞ্চলকে পৃথক করে। আর সিলেটকে কেটে আসামের সঙ্গে জুড়ে দেয়। ওই সময় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর প্রতিবাদ করেন এবং সিলেটকে নিয়ে তিনি একটি কবিতাও লিখেন –
“মমতাবিহীন কালস্রোতে
বাংলার রাষ্ট্রসীমা হোতে
নির্বাসিতা তুমি
সুন্দরী শ্রীভূমি।”
দ্বিতীয়বার, ১৯১১ সালে পৃথকীকরণের মাত্র ছয় বছর পরে বাংলাকে আবার সেই পূর্বাবস্থায় ফেরানো হয়। পশ্চিম অঞ্চলের বাঙালিদের আবেগকে তুষ্ট করার জন্য ও স্বদেশী আন্দোলনের দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ বাংলাকে পুনরায় একত্রিত করেন।
এই পরিবর্তনের ১০ বছর পর, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কবি কাজী নজরুল ইসলাম মাত্র ২২ বছর বয়সে লিখেন তাঁর কালজয়ী বিদ্রোহী কবিতা। যা ১৩৯ বা প্রায় ১৫০ পঙতির কবিতা। এই কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে তিনি “বিদ্রোহী কবি” পরিচিতি পান। কবি তাঁর বিদ্রোহী কবিতার এক পর্যায়ে লিখেন –
“আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে।
মহা-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত!”
আর, তৃতীয়বার বাংলা ভাগ হয়, কবি নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতা লেখার ২৬ বছর পর। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট, যখন ভারত উপমহাদেশ থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটে তখন। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ থেকে প্রত্যাহার করার আগে, একে দু’টি পৃথক ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত রাষ্ট্রে ভাগ করে। আর, দেশ ভাগের সময় ব্রিটিশরা তাদের সুচতুর ও দক্ষ আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাচ এবং স্বার্থান্বেষী সহযোগীদের সহায়তায় স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে স্থানীয় জনগণকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের pen-pusher-দেরকে দিয়ে একটি জাতিগত জনগোষ্ঠীর পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনদের আলাদা জাতীয় পরিচয়ে বিভক্ত করে। তৎকালীন ব্যারিস্টার ও পরে স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের কলমের খোঁচার মাধ্যমে আঁকা মানচিত্র নিয়ে তখন পৃথিবীর বুকে আবির্ভুত হয় দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্র দু’টি হল ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান। ব্রিটিশ ভারতীয় প্রদেশ বঙ্গকে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত করে দেওয়া হয়। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি রাজ্যে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ (বর্তমানে বাংলাদেশ) পাকিস্তানের একটি প্রদেশে পরিণত হয়।
কিন্ত পাকিস্তান ভৌগলিকভাবে দুটি পৃথক অংশে বিভক্ত ছিল; পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান। আর এ দুটি অংশের দূরত্ব ছিল প্রায় ১০০০ মাইল।
চতুর্থবার, ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান (আগের পূর্ববঙ্গ ও বর্তমান বাংলাদেশ) একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে এবং নতুন একটি মানচিত্র নিয়ে পৃথিবীর বুকে আবির্ভুত হয় স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশ।
বর্তমান বাংলাদেশ আটটি বিভাগ নিয়ে গঠিত। বিভাগগুলো হল – বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট। আর, সিলেট বিভাগ চারটি জেলা নিয়ে গঠিত। যথাক্রমে – হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও সিলেট। সিলেটের এই চারটি জেলাকে ৩৫টি উপজেলায় বিভক্ত করা হয়েছে এবং উপজেলাগুলো আবার ৩২৩টি ইউনিয়ন পরিষদে বিভক্ত।
তবে, বর্তমান সিলেট বিভাগ ব্রিটিশ আমলে বৃহত্তর সিলেট জেলা ছিল, যা পাঁচটি মহকুমা নিয়ে গঠিত ছিল। যথা- সিলেট সদর, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ ও করিমগঞ্জ।
উপমহাদেশের মানচিত্রে র্যাডক্লিফের একটি উপচে পড়া কলমের খোঁচায় আর স্থানীয় জটিলতার কারনেই করিমগঞ্জ মহকুমাটি এখন আর সিলেটের সাথে নেই। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এই মহকুমাটি কেটে রেখে দেওয়া হয় ভারতে।