সিলেটে সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি : নদী-গ্রাম পানিতে একাকার

আদর্শবার্তা ডেস্ক :
সিলেটে সামগ্রিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। সিলেটে বৃষ্টি কম হলেও ভারতের বরাক নদের শাখা কুশিয়ারার পানিপ্রবাহ বেড়েছে। এতে বিভিন্ন উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। জকিগঞ্জ, কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজার উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। এতে শত শত গ্রাম নদীর সাথে মিশে একাকার হয়ে গেছে।
গত বুধবার সকাল থেকে জকিগঞ্জ পৌর এলাকার নরসিংপুরসহ কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন এলাকার বাঁধ ভেঙে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া বিয়ানীবাজার উপজেলায়ও কুশিয়ারা নদীর বাঁধ ভেঙে ও পানি উপচে প্লাবিত হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম। এছাড়া একই নদীর পানি ফেঞ্চুগঞ্জেও উপচে পড়ে চারটি গ্রাম ও ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার প্লাবিত হয়েছে।
জকিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবদুল আহাদ বলেন, কুশিয়ারা নদীর কয়েকটি স্থানে বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে হু হু করে পানি প্রবেশ করছে। বাঁধগুলো বাঁচানোর জন্য স্থানীয়রা চেষ্টা করলেও সফল হননি। বুধবার ভোরে নরসিংপুরের বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, বাঁধ মেরামতের জন্য এরই মধ্যে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পানি না নামলে সেগুলো মেরামত করা সম্ভব নয়।এদিকে বিয়ানীবাজার উপজেলায় দেউলগ্রাম, গোবিন্দশ্রী, আঙ্গুরা মোহাম্মদপুর, আলীনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে লোকালয়ে প্রবেশ করছে।
এর পাশপাশি গোয়াইনঘাট, বালাগঞ্জ, কোম্পানীগঞ্জ, ওসমানীনগর, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ ও জৈন্তাপুরসহ প্রায় সবকটি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। কোথাও কোথাও পানি বাড়ছে। এসব এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন এসব এলাকার মানুষ।ফেঞ্চুগঞ্জ ও বালাগঞ্জ বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, যে সড়কে যানবাহন চলত, এখন ১০ দিন ধরে সেই সড়কে নৌকা চলছে। নৌকায় মানুষজন বাজার করতে আসছে। বন্যা পরিস্থিতির কারণে বেচাকেনা কম হলেও প্রতিদিন পানির সঙ্গে অনেকটা যুদ্ধ করেই তারা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু রেখেছেন।
এদিকে, দুই দিন ধরে বৃষ্টি কমলেও সিলেট নগরের অভ্যন্তরে জলাবদ্ধতা কাটেনি। শহরের অভ্যন্তরেও বেশ কয়েকটি এলাকা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এর মধ্যে শাহজালাল উপশহর, যতরপুর, মীরাবাজার, তালতলা, জামতলা, মির্জাজাঙ্গাল, মণিপুরি রাজবাড়িসহ বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এখনো পানিবন্দী অনেক বাসিন্দা।শাহজালাল উপশহরের ডি ব্লকের এক বাসিন্দা বলেন, ঘরের নিচতলায় পানি জমে আছে। সড়কে হাঁটুর ওপরে পানি।
নগরের জামতলার আরেক বাসিন্দা বলেন, এক সপ্তাহ ধরে ঘরে পানি। কি করব, কোথায় যাব-তা ভেবে পাচ্ছিনা। জীবনটা দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে।সিলেট জেলা প্রশাসন বলছে, সিলেটের সব উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত ৬ লক্ষ ২৬ হাজার মানুষ জেলায় বন্যা আক্রান্ত অবস্থায় আছেন।শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সিলেট জেলার প্রধান দুই নদী সুরমা ও কুশিয়ারার ৫ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। শুধু সিলেট পয়েন্টে পানি বিপদসীমার নিচে নামলেও বিপদ কাটেনি বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় পানি বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় পানি বিপদসীমার ১৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এছাড়া কুশিয়ারা নদীর শেওলা পয়েন্টে পানি ৩৮ সেন্টিমিটার ওপরে, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১০১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর শেরপুর পয়েন্টে পানি শুক্রবার সন্ধ্যা ৬টায় ১০৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।এদিকে, সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার নিচে হলেও হাওর এলাকায় পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। এখনো রাস্তাঘাট তলিয়ে থাকায় সুনামগঞ্জ সদর, জামালগঞ্জ, শান্তিগঞ্জ, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, মধ্যনগর, ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার নিম্নাঞ্চলে দুর্ভোগ কমছেনা। বাড়িঘর, রাস্তাঘাট থেকে পানি না নামায় মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে।
গ্রামীণ সড়কের পানি থাকায় যাতায়াতের ক্ষেত্রে ভোগান্তি পোহাচ্ছে মানুষ। তাহিরপুর-বিশ্বম্ভরপুর সড়কে এখনো সরাসরি যান চলাচল বন্ধ আছে। জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, সুনামগঞ্জে প্রায় ৪ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত।
এদিকে, সুনামগঞ্জে সড়কের পর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মাছ চাষিরা ৮ হাজার পুকুরের ৪ হাজার ৫০০ টন মাছ মাছের পোনা ভেসে গেছে। চার হাজার পুকুরের পাড় পাহাড়ি ঢল ও বন্যার স্রোতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন চার হাজার মাছ চাষি।
এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এবছর জেলায় ৭ হাজার ৬১৪ হেক্টর জমিতে রোপা আউশের আবাদ করা হয়েছে এর মধ্যে ১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমির আউশক্ষেত পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে। এতে ৩ হাজার ৬০০ কৃষকের ১২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ছাতক ও দোয়ারাবাজার উপজেলার কৃষকদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। জেলায় গ্রীষ্মকালীন সবজি ৩ হাজার ৩৭৭ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি চাষ করা হয়। দুই বারের বানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫ হাজার সবজি চাষি তাদের ৬০০ হেক্টর জমির সবজি ক্ষেত পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৩৩ কোটির টাকার সবজির।
এদিকে, মৌলভীবাজার জেলার সবক’টি হাওর পানিতে টইটুম্বুর। প্লাবিত শত শত গ্রাম। নদী ও হাওর তীরের মানুষ এখন চলমান বন্যা ও দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগে পড়েছেন জেলার ৭ উপজেলার ৪ লক্ষ মানুষ। বিশেষ করে আশ্রয়কেন্দ্রে ও নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়া বন্যার্তরা অন্তহীন দুর্ভোগে পড়েছেন। জেলার বড়লেখা, কুলাউড়া, জুড়ি ও রাজনগর উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে ও সড়কের পাশে আশ্রয় নেয়া বানভাসি লোকজনের সঙ্গে আলাপে এমনটিই জানান তারা। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা বানভাসিরা জানান, গাদাগাদি করে ওখানে থাকতে আর মন চায় না। নিজে উপোষ। নিজেদের গবাদিপশুগুলোর অবস্থাও তাই।
শিশু ও বয়স্করাও অর্ধাহারে অনাহারে। নাওয়া, খাওয়া নেই। বিশুদ্ধ পানি নেই। স্যানিটেশন সুবিধাও নেই। এরই সঙ্গে কেবল রোগবালাই আর দুর্ভোগ। তাই নিজ বাড়িতে ফিরতে চাই। এ জেলার ২০৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ও আত্মীয়স্বজন, বাঁধের উঁচুস্থান ও সড়কের পাশেসহ অন্যত্র আশ্রয় নেয়া মানুষের বসতভিটায় ফেরার এখন প্রতীক্ষা এমন। প্রায় ২০ দিন থেকে বাড়িঘর ছেড়ে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যত্র। আশ্রয় নেয়া বানভাসিদের এখন রাতদিন কাটছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায়।
(নিউজ : দৈনিক জালালাবাদ, ছবি : ফেইসবুক)