প্রচ্ছদ

আরেকটি রক্তাক্ত দিন, শিক্ষার্থী পুলিশসহ ঝরলো শতপ্রাণ

  |  ২১:৩৭, আগস্ট ০৪, ২০২৪
www.adarshabarta.com

আদর্শবার্তা ডেস্ক :
সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি চলছে। আর অসহযোগের প্রথমদিনেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। দেশজুড়ে ঘটেছে ভয়াবহ সংঘাত, হামলা, সংঘর্ষ, ভাংচুর, গুলি। এতে আরেকটি রক্তাক্ত দিন পার করলো স্বাধীন বাংলাদেশ। নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন পুলিশ, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সাধারণ মানুষসহ ৯৫ জনেরও বেশি। মৃতের সংখ্যা শত ছাড়িয়ে যেতে পারে আর আহতের সংখ্যা কত তা হয়তো কল্পনাতীত!
সিলেটসহ সারাদেশে সংঘাত-সংঘর্ষ, গুলি, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ায় রোববার রাত সাড়ে ১০টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অন্তত ৯৫ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৪ জন পুলিশ সদস্য। শুধু সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ১৩ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
দিনভর সংঘর্ষে দিনভর সংঘর্ষে নরসিংদীতে ৬ জন, ফেনীতে ৮ জন, লক্ষ্মীপুরে ৮ জন, সিরাজগঞ্জে ১৩ পুলিশসহ মোট ২২ জন, কিশোরগঞ্জে ৪ জন, রাজধানী ঢাকায় ৮ জন, বগুড়ায় ৫ জন, মুন্সিগঞ্জে ৩ জন, মাগুরায় ৪ জন, ভোলায় ৩ জন, রংপুরে ৪ জন, পাবনায় ৩ জন, সিলেটে ৫ জন, কুমিল্লায় পুলিশ সদস্যসহ ৩ জন, শেরপুরে ২জন, জয়পুরহাটে ১ জন, হবিগঞ্জে ১জন, ঢাকার কেরাণীগঞ্জে ১ জন, সাভারে ১ জন ও বরিশালে ১ জনসহ ৯৫ জন নিহত হয়েছেন।
সিলেটের গোলাপগঞ্জে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর বাহিনীর গুলিতে ৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক লোক। দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে গোলাপগঞ্জ পৌরশহর ও ঢাকা দক্ষিণ এলাকায়। বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা লাশ নিয়ে শহরে বিক্ষাভ করে। হামলা করেছে থানায়, উপজেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। হবিগঞ্জেও হামলা-সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে ১ জনের।
দিনভর কোথাও ঘটেছে সংঘর্ষ, কোথাও পুলিশের গুলি, কোথাও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের গুলি এবং কোথাও আন্দোলনকারীদের হামলা। তবে বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ ও হামলা ঠেকাতে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে সেনাবাহিনী সদস্যরা।
আন্দোলনকারীদের বিপরীতে কাল সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেন সরকার দলের নেতা-কর্মীরা। এ সময় তাদেরকে পথচারীদের মোবাইল ফোন তল্লাশি করতে দেখা গেছে। শিক্ষার্থী বা আন্দোলনকারী সন্দেহ হলেই তাদের ওপর চড়াও হন তারা। তবে পুলিশকে তাদের বাধা দিতে দেখা যায়নি।
এ অবস্থায় রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সারাদেশে কারফিউ বলবৎ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ঢাকাসহ সব বিভাগীয় সদর, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, শিল্পাঞ্চল, জেলা ও উপজেলা সদরের জন্য কার্যকর হবে। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফ মাহমুদ প্রথম আলোকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংষ্কার দাবির আন্দোলনকে ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গত ১৯ জুলাই সারা দেশে কারফিউ জারি করে সরকার। প্রথমে ওই দিন রাত ১২টা থেকে কারফিউ চলে। পরে এলাকাভেদে আলাদাভাবে বিরতি (শিথিল) দিয়ে কারফিউ চলে আসছে।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ১৩ পুলিশ নিহত :
অতর্কিত হামলায় সিরাজগঞ্জ জেলার এনায়েতপুর থানার ১৩ পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে থানার এক পুলিশ সদস্যও হামলায় নিহত হয়েছেন।
রোববার বিকেলে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক বার্তায় সন্ত্রাসী হামলায় এই পুলিশ সদস্যদের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
পুলিশের রাজশাহী রেঞ্জের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (অপারেশনস অ্যান্ড ক্রাইম) বিজয় বসাক বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্য সদস্যরাও তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন। তাঁরা থানায় গিয়ে ১১টি লাশ পেয়েছেন। এর মধ্যে আটটি লাশ মসজিদের পাশে স্তুপ করা অবস্থায় পাওয়া গেছে। তিনটি লাশ পাওয়া গেছে পুকুরে। বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য এখনো নিখোঁজ।
ঘটনা সম্পর্কে সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) মোহাম্মদ হান্নান মিয়া বলেন, প্রথমে হাজারখানেক মানুষ দলবেঁধে থানার দিকে আসে। সেখানে তাঁরা কিছুক্ষণ অবস্থান করে চলে যায়। পরে কয়েক শ’ মানুষ অতর্কিতে থানায় এসে হামলা চালায়। তাঁরা আগুন ধরিয়ে দেয়। এখন পর্যন্ত ১১-১২ জন পুলিশ সদস্যের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, সারাদেশে ১৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানায় ১৩ জন নিহত হয়েছেন। কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জে নিহত হয়েছেন একজন।
ডিএমপির যাত্রাবাড়ী ও খিলগাঁও থানা; টাঙ্গাইলের গোড়াই হাইওয়ে থানা; বগুড়ার সদর, দুপচাঁচিয়া ও শেরপুর থানা এবং নারুলী পুলিশ ফাঁড়ি; জয়পুরহাট সদর থানা; কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে থানা; রংপুরের গঙ্গাচড়া, মিঠাপুকুর, পীরগাছা, পীরগঞ্জ, বদরগঞ্জ ও গংগাচড়া; ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর ও আশুগঞ্জ থানা; সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর, উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর থানা; হবিগঞ্জের মাধবপুর ফাঁড়ি; ময়মনসিংহ রেঞ্জ অফিস; নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপারের কার্যালয়; দিনাজপুর সদর থানায় আক্রমণ করেছে। আহত পুলিশ সদস্য প্রায় তিন শতাধিক।
এদিকে অসহযোগের প্রথম দিন কাল সিলেটসহ দেশের প্রায় প্রতিটি এলাকায় খুলেনি দোকান পাট। ঘুরেনি গাড়ির চাকা। প্রায় অচলই ছিলো দেশ। জরুরী প্রয়োজনেও মানুষ ব্যাংক-বুথে টাকা তুলতে পারেননি।
দূরপাল্লার বাস চলাচলের কাউন্টারগুলো ছিলো পুরোপুরি ফাঁকা। বেশির ভাগ টিকিট কাউন্টারের দরজা ছিল অর্ধেক নামানো। এ অবস্থায় ধৈর্যের শেষ সীমায় আওয়ামী লীগ পৌঁছে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন দলের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক। তিনি বলেছেন, ধৈর্য ধরা মানে দুর্বলতা নয়। তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াত জঙ্গিগোষ্ঠী যে অরাজকতা করছে, তা প্রতিহত করতে হবে। এ জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেছেন, আলাপ আলোচনার মাধ্যম শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যার সমাধান করতে চাই। সন্ত্রাসীদের দমনে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ সরকারের
এদিকে, শিক্ষার্থীসহ সব অভিভাবককে ঘরে ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে সরকার। রোববার বিকেলে এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন জায়গায় ‘জঙ্গি’ হামলা হচ্ছে। হামালকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রেস উইং নিশ্চিত করেছে।
সুপ্রিম কোর্টসহ সব আদালত বন্ধ ঘোষণা :
পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সোমবার থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ এবং সারা দেশের নিম্ন আদালত বন্ধ ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. সাইফুর রহমান বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
প্রধান বিচারপতি প্রয়োজন মনে করলে যেকোনো স্থানে হাইকোর্টের বেঞ্চ বসাতে পারবেন। এ ছাড়া মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও সারাদেশের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত খোলা থাকবে।
আবারো তিন দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা :
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে সোমবার থেকে তিনদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে সরকার। আগামী বুধবার পর্যন্ত এই ছুটি বলবৎ থাকবে। নির্বাহী আদেশে এই ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ শিবলী সাদিক। এই আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও প্রাণহানি বাড়ার পর কারফিউ জারি করা হয় গত ১৯ জুলাই রাতে। পরে ২১ থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। পরে ২৪ ও ২৫ জুলাই সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সীমিতভাবে চলে সরকারি-বেসরকারি অফিস।
পরিস্থিতি আরো স্বাভাবিক হলে গত রবি, সোম ও মঙ্গলবার অফিস চলে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। পরে গত বুধবার থেকে স্বাভাবিক সময় ধরে চলছে সরকারি-বেসরকারি অফিস।
‘মার্চ টু ঢাকা’ আজই :
‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ৬ আগস্ট থেকে পরিবর্তন করে ৫ আগস্ট করার ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। রোববার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের এক পোস্টে এ তথ্য জানিয়েছেন তিনি। ওই পোস্টে তিনি লিখেন, ‘পরিস্থিতি পর্যালোচনায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আগামীকালই সারা দেশের ছাত্র-জনতাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আহ্বান জানাচ্ছি।
এর আগে শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আলোচনার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলনকারীরা। ডাক দেয় অসহযোগের। আর এর শুরুতেই ঝরে গেলো অগুনতি প্রাণ।