রাজনীতি নিষিদ্ধের রাজনীতিঃ
আহমেদ ইকবাল চৌধুরী:
এ যেন মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। বিপ্লবী বা অন্তবর্তি সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত এরকমই প্রতিয়মান হচ্ছে। কোন কোন ক্ষেত্র ইউরোপ, আমেরিকার সরকারের মত U Turn পরিলক্ষিত হয় যা সত্যিই প্রশংসনীয়। তবে এমন কিছু সিদ্ধান্ত আছে যে গুলো নেওয়ার পর পিছনে ফেরা যায় না। সুতরাং ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না- এই প্রবাদটি যথার্থ।
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কর্মকান্ডকে দুই ভাগে বিশ্লেষন বা মুল্যায়ন করতে হবে, আর তা না হলে যে কোন মানুষের মনে ছাত্রলীগের প্রতি বৈষম্যমুলক আচরন করা হয়েছে বলে একটা Sympathy তৈরী হবার আশংকা থেকেই যায়। ১৯৭১ পুর্ববর্তি ছাত্রলীগ আর ১৯৭২ পরবর্তি ছাত্রলীগ কে একই ভাবে মুল্যায়ন করা ঠিক হবে না বলে আমার ব্যক্তিগত মতামত।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রলীগ কে নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করেছেন। ১৯৭২ পর্রবর্তি ছাত্রলীগ বিশেষ করে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের ৫ই আগষ্ট পর্যন্ত ছাত্রলীগের কর্মকান্ড বিশ্লেষন করলে ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হবার জন্য যথেষ্ট কারন রয়েছে, বিশেষ করে জুলাই- আগষ্টে ২০২৪ এর গনহত্যার বিচার করলে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ ঘুরে দাঁড়াতে হলে অন্তত আরো কয়েক যুগের প্রয়োজন হবে। কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে – ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করলে কি বৈষম্যহীন Inclusive সমাজ প্রতিষ্টায় সহায়ক? পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মানবতা বিরোধী আপরাধ বা গণহত্যা চালানোর জন্য যুগে বিভিন্ন সংগঠন নিষিদ্ধ হয়েছে। কিন্ত সেই সংগঠন গুলোকে কি চিরতরে নির্মুল করা সম্ভব হয়েছে? অবশ্যই না। একটি আদর্শ কে নিষিদ্ধ করা যায়, কিন্ত নির্মুল করা যায় না, যতক্ষন পর্যন্ত তার বিপরীতে আরেকটি ভালো আদর্শ দাঁড় করানো না যায়। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে জুলাই বিপ্লবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহায়তাকারী সকল রাজনৈতিক দলের উচিত হবে একতাবদ্ধ হয়ে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ গনহত্যার চিত্র ১৮ কোটি মানুষের কাছে তুলে ধরে নিজেদেরকে গনমুখী ও জনবান্ধব দল হিসেবে গড়ে তুলে যাতে করে মানুষ শেখ হাসিনা ও তার অনুসারীদের সব সময় আসামীর কাটগডায় দাঁড় করায়।
আর সরকারের দায়িত্ব হবে জুলাই বিপ্লবকে ধারন করে সঠিক বিচারের মাধ্যমে প্রকৃত গণহত্যকারীদের/দোষীদের বিচার করা। সমাজে ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্টা করলেই কেবল বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্টার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। তখন নির্বাহী আদেশে নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হবে না। উদাহরন স্বরুপ বলা যেতে পারে আওয়ামী- মুসলীমলীগের কথা। এতবড় একটা দল ইতিহাস থেকে সহসাই হারিয়ে গেল, নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হয়নি।
আওয়ামিলীগের গত সাঁড়ে পনেরো বছরের গুম, হত্যা, নির্যাতন, টাকা পাচার, শেয়ায়ার কেলেংকারি,সর্বত্র দলীয়করন, রিজার্ভ চুরি, ক্রস ফায়ার, পিলখানা হত্যা, আয়না ঘর, সর্বপরি ২০২৪ এর জুলাই – আগষ্ট গনহত্যার সুষ্ট বিচার করলে আওয়ামিলীগ নামক দলটি মানুষের মনিকোঠায় স্থান পাবে না। ২০০৮ সালে যে আওয়ামিলীগের ভোট ছিল ৩০% এর উপরে, ২০২৪ সালে সেই আওয়ামিলীগ নিজে ক্ষমতায় থেকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ৫%-৬% ভোট পেল, সেই আওয়ামিলীগ কে নিয়ে রাষ্ট্রের এত মাথা ঘামানোর কোন কারন দেখি না।
আর একান্তই যদি আওয়ামিলীগ বা ছাত্রলীগ কে নিষিদ্ধ করতেই হয়, তবে কিছু সঠিক প্রক্রিয়া গ্রহন করা দরকার ছিল। সবচেয় বড্ প্রক্রিয়া হচ্ছে জাতীয় ঐক্যমত, জনসচেনতা তৈরী করে গন শোনানীর মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে আইনের মাধ্যমে, আগে সকল আপরাধে বিচার করে সিদ্ধান্ত নেয়া যেত। তাছাড়া, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যেমন United Nation এর UNOCT, US এর The Bureau of Counterterrorism এবং European Union এ বিগত ১৫ বছরের সকল সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের নথি উপস্থাপন করা যেত। আন্তর্জাতিক ভাবে একটি জনমত তৈরী করা যেত। একটি অন্তবর্তি সরকার নির্বাহী আদেশে এরকম একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে কতটুকু প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন, তা বোধগম্য নয়।
আওয়ামিলীগ শুধু একটা রাজনৈতিক দল নয়। কিছু কিছু আওয়ামিলীগার (সবাই না) এই দলটির মতবাদ কে ধর্মীয় মতবাদের মত লালন করে, সুতরাং নিষিদ্ধ করে নিশ্চিন্ন করা যাবে না। সাময়িক এ সিদ্ধান্তের সুফল দেখা গেলেও এটি Sustainable হবে না। বরং তাদের সঠিক বিচার করে আত্নউপলদ্ধি ও আত্নসুদ্ধির সুযোগ দেয়াটাই বান্চনীয়। আর তা না হলে বৈষম্যহীন ঐক্যবদ্ধ জাতি গড়ার জন্য যে আত্নত্যাগ, হাজারো শহীদের আত্নাহুতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে।
লেখকঃ ব্যাংকার, লন্ডন প্রবাসী