প্রচ্ছদ

উপজেলাকে সংসদীয় কনষ্টিটুয়েন্সিতে রূপান্তর করে সংসদের আসন সংখ্যা ৫০০ করার প্রস্তাব

  |  ১৩:১০, নভেম্বর ৩০, ২০২৪
www.adarshabarta.com

সাদেকুল আমীন:

বাংলাদেশে, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে ৫ই আগস্ট কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটে। স্বৈরাচারী সরকারের প্রধান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার তিন দিন পর, এক কঠিন সময়ে ৮ই আগস্ট একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষ্যে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন ও নির্বাচন সংস্কার কমিশনসহ অন্যান্য সংস্কার কমিশনের বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা উল্লেখ করেন।

এখানে, যে সমস্ত সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে তা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। রাষ্ট্র মেরামত করার জন্য এই বিষয়গুলি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করা প্রয়োজন। এদিকে এসব সংস্কার নিয়ে রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের মধ্যে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। এছাড়াও বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিশেষ করে টেলিভিশন টকশোতে এসব নিয়ে নিয়মিত তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। এখানে আমরা এসব বিষয়ে কিছু যৌক্তিক মতামত তুলে ধরার চেষ্টা করব। যাতে উত্থাপিত এই মতামতগুলি সম্মানিত সংস্কার কমিশনের সদস্যগণ, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাগণ এবং প্রধান উপদেষ্টা বিবেচনা করবেন।

এসব বিষয়ে আমাদের মতামত প্রকাশের আগে আমরা বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান ও নির্বাচন ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট তুলে ধরতে চাই।

জাতীয় সংসদ (ন্যাশনাল পার্লামেন্ট) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। এই জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয় ৭ই মার্চ ১৯৭৩ সালে। আজ থেকে ৫১ বছরেরও কিছু দিন আগে। এর আগে এটি ছিল বাংলাদেশের গণপরিষদ। এটি ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত দেশের অস্থায়ী সংসদ ছিল। এই অস্থায়ী সংসদেই ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও গৃহীত হয়েছিল।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ হচ্ছে ইউনিক্যামেরালিজম (Unicameralism) বা এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা। এতে মোট ৩৫০টি সংসদীয় আসন রয়েছে যার মধ্যে ৩০০টি নির্বাচিত আসন এবং ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন রয়েছে।

জাতীয় সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছর। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী প্রতি পাঁচ বছর পরপর জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন, দেশের মানুষ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদের ৩০০ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত করে।

বাংলাদেশের বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থা হল ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট ভোটিং (First-past-the-post voting)। যেখানে ভোটাররা একক প্রার্থীকে ভোট দেয় এবং সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থী নির্বাচনে জয়ী হয়।

গত ৫১ বছরে বাংলাদেশে ১২টি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু, এই ১২টি সাধারণ নির্বাচনের মধ্যে থেকে অল্প কয়েকটি নির্বাচন ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলোতেই জনগণের সাংবিধানিক অধিকারের প্রকৃত প্রতিফলন দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার ঐক্য ও আত্মত্যাগ ছিল মানব ইতিহাসের এক বিরল দৃষ্টান্ত। এই গণঅভ্যুত্থানের ফলে দেশের শাসক ক্ষমতার আকস্মিক পরিবর্তন ঘটে। ফলে, বাংলাদেশ এখন একটি অন্তর্বর্তী সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে।

সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কারের বিষয়ে আমাদের স্পষ্ট অভিমত হলো বর্তমান সংসদীয় ব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। সংসদে ৩০০টি নির্বাচিত আসন এবং ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসনের বিধান পরিবর্তনের জন্য একটি নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সর্বোচ্চ বিবেচনা করা উচিত।

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার সহ অন্তর্বর্তী সরকার যে সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কার বিবেচনা করছে সে বিষয়ে আমরা এখানে কিছু মতামত উপস্থাপন করছি।

এক. বিদ্যমান সংবিধানের ৬৫ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাংলাদেশের সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি সংরক্ষিত আসন রয়েছে। তারা সরাসরি জনগণের ভোটে নয়, বরং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর মনোনয়নে পরোক্ষ ভোটে ‘নির্বাচিত হন। সংবিধানে উল্লেখিত নারী সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত ৫০ আসনের বিধান সম্পূর্ণ বাতিল ঘোষণা করা।

দুই. বর্তমানে, বাংলাদেশে মোট ৪৯৫টি উপজেলা রয়েছে। বিদ্যমান উপজেলা কাঠামো পর্যালোচনা করে এর মধ্যে থেকে ৫টি নতুন উপজেলা গঠনের সুপারিশ করা হয়, যাতে উপজেলার সংখ্যা ৫শতে উন্নীত হয়।

তিন. এই ৫০০ উপজেলাকে সংসদীয় কনষ্টিটুয়েন্সিতে রূপান্তর করে ৫০০টি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকা হিসাবে ঘোষণা করুন।

চার. বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের মতামত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট (Bicameral) সংসদ প্রতিষ্ঠা করুন, যা উচ্চকক্ষ (Upper House) হিসাবে বিবেচিত হবে।

নারী কিনবা পুরুষ, যে কেউই যোগ্যতার ভিত্তিতে ৫০০ সংসদীয় নির্বাচনী এলাকায় প্রতিদন্ধিতা করতে পারবেন। এখানে নারী বা পুরুষের প্রতি বৈষম্যের কোনো সুযোগ থাকবে না। ক্যান্ডিডেট বাছাইয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যেকটি তাদের নিজ নিজ দলের অভ্যন্তরীণ ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে ব্যবস্থা করতে পারে।

এখানে একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে বলে মনে করি। যুক্তরাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ মিলিয়ন (ওয়ার্ল্ডোমিটার অনুসারে ৬৯.৩১ মিলিয়ন – বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪)। ইউকে পার্লামেন্ট বা হাউস অফ কমন্সে মোট আসন সংখ্যা ৬৫০। যুক্তরাজ্যে পার্লামেন্ট নির্বাচনে, নারী এবং পুরুষ উভয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন এবং members of parliament হতে পারেন। তবে হাউস অফ কমন্সে মহিলাদের জন্য আলাদা বা সংরক্ষিত আসন নেই।

এখানে লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা হল প্রায় ১৮ কোটি (ওয়ার্ল্ডোমিটার অনুসারে ১৭৪.৪২ মিলিয়ন – বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪)। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের মোট আসন সংখ্যা হল ৩৫০টি। তবে ৩০০টি আসনে সংসদ সদস্যরা (নারী ও পুরুষ) সরাসরি ভোটের মাধ্যমে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হন। এছাড়া বাকি ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত বা অনির্বাচিত আসন। স্পষ্টতই, এখানে দুই ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা কি এক ধরনের বৈষম্য নয়?

আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে সাংবিধানিক ও নির্বাচনী সংস্কার কমিশন ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিটকে ধারণ করে বিদ্যমান ও সম্প্রসারিত উপজেলাগুলোকে সংসদীয় আসনে রূপান্তর করে নতুন বাংলাদেশে ৫০০ আসনের একটি কার্যকরী সংসদ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে। আমরা আশা করি সম্মানিত কমিশনাররা দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ গঠনের জন্য সুপারিশ করবেন। যদি একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হয়, এই উচ্চকক্ষ নির্বাচিত সরকারের আইনগুলি যাচাই-বাছাই করবে, সরকারকে জবাবদিহি করবে এবং পাবলিক পলিসি সম্পর্কে রিপোর্ট করবে। এতে দেশে একটি প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পথ সুগম হবে।

 

লেখক: প্রাবন্ধিক, লন্ডন প্রবাসী
২৯ নভেম্বর ২০২৪