বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে
মোঃ নাসির, বিশেষ প্রতিনিধি :
করোনা মহামারিতে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের আঘাত লেগেছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তার প্রভাব শুরু হয়ে গেছে। আগামী মাসগুলোতে এ ধাক্কা আরও প্রবল হবে। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, সর্বগ্রাসী এ ধাক্কা সামলাতে না পারলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় তিন ভিত্তি হলো কৃষি, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। করোনার ধাক্কা থেকে কৃষিকে মোটামুটি সামাল দিয়ে রপ্তানি আয়কে মূল ধারায় ফেরানোর চেষ্টা করা হলেও প্রবাসী আয়ে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে ১০টি দেশ থেকে শ্রমিক ফেরত পাঠানোর কথা বলা হয়েছে। এরমধ্যে সব চেয়ে বেশি প্রবাসী কাজ করা দেশ সৌদি আরব থেকে লোক ফিরিয়ে আনার খবরে প্রবাসী আয়ে বড় ধরনের সংকটের আভাস মিলছে। কিছু কিছু দেশ থেকে মানুষ ইতোমধ্যে ফিরেও এসেছে। যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে আপাতত বন্ধ আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এটি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এদিকে প্রবাসী আয়ে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও ফুটে উঠেছে। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার মাসেই আগের মাসের চেয়ে ১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার বা এক হাজার ৩৮০ কোটি টাকা কম এসেছে। পরবর্তী মাসগুলোতে এ অবস্থা আরও প্রবল হবে। যদিও চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ ৯ মাসে কিছুটা কমেছে। এ সময়ে দেশে মোট প্রবাসী আয় এসেছে ১২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরগুলোর প্রায় কাছাকাছি। কিন্তু বছরের এপ্রিল-জুন তিন মাসে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
বিশ্বব্যাংক মনে করছে, করোনাভাইরাসের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্স কমবে ২২ ভাগ। রামরুর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকীর মতে, বাংলাদেশের রেমিট্যান্স হ্রাসের হার আরও বেশি হবে।
পিআরআই’র নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ হার নির্দিষ্ট করে বলেন, করোনাভাইরাসের অভিঘাতে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স কমছে ৩০ থেকে ৩৩ ভাগ।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের রেমিট্যান্স প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতিবছর প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে এসেছিল ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৫ বিলিয়ন ডলার এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরের এসেছিল ১২ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহের বলে পল্লী অঞ্চলে বড় ধরনের অর্থের প্রবাহ তৈরি হয়; মানুষের ক্ষয়ক্ষমতা বাড়ে। এ ভোগের ওপর নির্ভর করে দেশে বড় ধরনের উৎপাদন যজ্ঞ চলে। ফলে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। প্রবাসীরা ব্যাংকের মাধ্যমে এ রেমিট্যান্স পাঠানোর ফলে ব্যাংকগুলোও বড় ধরনের আমানত হিসাবে পায়। যা ঋণ হিসাবে উৎপাদনে যায়। আহসান এইচ মনসুর বলছেন, করোনাভাইরাসের কারণে প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৩০ ভাগ। যা একই সঙ্গে পল্লী অঞ্চলে ভোগ কমাবে ও ব্যাংকগুলোর আমানত আঘাত করবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ কর্মরত আছে। করোনাভাইরাসের অভিঘাতে এসব দেশের অবস্থা খারাপ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এসব দেশের মানুষ নিজের কাজ নিজে করতে চাইবে। এ বিষয়ে ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সে ক্ষেত্রে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা হয়তো দ্রুত স্বাভাবিক হবে। কিন্তু সমস্যা হবে মধ্যপ্রাচ্যে। আর মধ্যপ্রাচ্যেই বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকের ৬০ ভাগ কর্মরত আছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতি তেলনির্ভর। করোনাকালে তেলের দাম কমে যাওয়ায় তারা বিদেশি শ্রমিকদের ফেরত পাঠাবে। সৌদি আরব ইতোমধ্যে ১০ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিককে ফেরত পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে।
করোনার প্রভাব পড়েছে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রেও। ফলে দেশে স্বজনরা খরচ কমানো শুরু করেছেন। রামরুর পর্যবেক্ষণে এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে জানান অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, দেশে প্রবাসীদের পরিবারগুলো ৮৫ ভাগ রেমিটেন্সের ওপর নির্ভরশীল। ১৫ জন নির্ভর করে কৃষির ওপর। করোনা দুর্যোগ দীর্ঘায়িত হলে পরিবারকে আরও খরচ কমাতে হবে।
রেমিট্যান্স অর্জনে বড় ধরনের কোনো বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। অন্যদিকে তৈরি পোশাক শিল্প কর্মসংস্থান করলেও অর্জিত আয়ের প্রায় ৭০ ভাগই কাঁচামাল কিনতে বিদেশে চলে যায়। ফলে আমদানি ব্যয়সহ সব ধরনের বৈদেশিক আয়ের যে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন, তা সরবারহ করে এ খাত। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে প্রবাসী আয় কমে গেলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হবে। এক্ষেত্রে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করতে হবে। তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সৌদি আরব একসঙ্গে ১০ লাখ মানুষ ফেরত পাঠালে বাংলাদেশের অর্থনীতি সহ্য করতে পারবে না।
আস্তে আস্তে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ থেকে বলা হয়েছে। আহসান এইচ মনসুর বলেন, আলোচনার মাধ্যমে এসব দেশে শ্রমিকদের কীভাবে রেখে দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।
শ্রমিককে ফিরে আসতে হলেও সব প্রাপ্য নিয়ে আসতে সরকার সহায়তা করলে দুর্যোগের মধ্যেও রেমিট্যান্সে প্রবাহ ইতিবাচক ধারায় রাখা যাবে বলে মনে করেন ড. তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, শ্রমিকের স্বাস্থ্য বীমা ও এরিয়া বাবদ যে টাকা প্রাপ্য আছে, তা না নিয়ে যেন শ্রমিককে দেশে ফিরতে না হয়। এজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও মিশনকে এখনই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এদিকে প্রায় প্রতিদিনই প্রবাসী বাংলাদেশিরা বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসছেন। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা থেকে শুরু করে চীন, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসছেন আটকে পড়া বাংলাদেশিরা। আবার মধ্যপ্রাচ্য ও মালদ্বীপ থেকেও প্রবাসী শ্রমিকরা ফিরছেন। এ মাসের মধ্যে আরও প্রায় ৩০ হাজার ফেরত আসার সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এই গোটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় জড়িত এবং বিষয়টি বহুমাত্রিক এবং কয়েকটি স্তরে বিভক্ত বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন।
প্রত্যাবাসনের এই গোটা প্রক্রিয়া নিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘বিষয়টি কয়েকটি স্তরে হচ্ছে এবং সরকার নিজের খরচে প্রত্যাবাসন করছে না।’
ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সচিব বলেন, ‘কয়েকটি দেশে কিছু বাংলাদেশি আটকা পড়ে আছেন এবং সেখানে কমিউনিটির মাধ্যমে তারা ফেরত আসার উদ্যোগ নিয়েছেন এবং সংশ্লিষ্ট দূতাবাস তাদের সব ধরনের সহায়তা দিয়েছে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবার সঙ্গে আলাপ করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সহজ করছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘যারা আসছেন তারা নিজ খরচে আসছেন। কোনও বাংলাদেশি আটকে থাকলে তার ফেরত আসার বিষয়টিতে সহায়তা করছি এবং আমাদের দূতাবাসও তাদের সংগঠিত বা সহায়তা করার কাজটি করছে।’
মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতি তেলনির্ভর এবং বর্তমানে এ প্রয়োজনীয় পণ্যটির দাম শূন্যের কোঠায়। এরফলে ওই অঞ্চলে বিদেশি শ্রমিকের চাহিদা কমছে। এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে প্রায় প্রতিদিনই, সেখান থেকে শ্রমিকরা ফেরত আসছেন।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে অনেকে চাকরি হারিয়েছেন এবং তারা যেসব কোম্পানিতে কাজ করতো তারা উদ্যোগ নিয়ে বিশেষ ফ্লাইটে তাদের পাঠিয়ে দিচ্ছে।’
বাংলাদেশের কাছে যখন ফেরত পাঠানোর অনুরোধ আসে তখন স্থানীয় কোয়ারেন্টিন ব্যবস্থা বিবেচনা করে তাদের ফেরত আসার অনুমতি দেওয়া হয় বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব।
সচিব বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের বিষয়টি পরিষ্কার না। সেখানকার অর্থনীতি তেলনির্ভর। আগামীতে তেলের দাম যদি ৫০ বা ৬০ ডলারে যায় তবে গোটা চিত্রটা অন্যরকম হয়ে যাবে। কিন্তু ২০ বা ৩০ ডলারে থেমে থাকলে ফেরত আসার সংখ্যা অনেক বাড়তে পারে।’
আরও কিছু বাংলাদেশি স্ব-স্ব দেশের সরকারের মাধ্যমে ফেরত আসছেন বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, ‘ওইসব দেশে অবৈধভাবে যারা অবস্থান করছিলেন, তাদের ক্ষমা ঘোষণার মাধ্যমে বৈধতা দিয়ে বিশেষ ফ্লাইটে সরকার পাঠিয়ে দিচ্ছে নিজেদের খরচে।