সংকটে মার্কেটিং-৩
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
বিক্রয় মানুষের আদিমতম পেশা। আমরা প্রত্যেকে কিছু একটা বিক্রয় করেই বেঁচে আছি। ব্যবসায় এবং অব্যবসায়ী সকল প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় কর্মী কাজ করে। পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে ছোট পরিবারের ধারণা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী নিয়ে। কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজাররা যাচ্ছে ফসল বৈচিত্র্যকরণ কর্মসূচির আওতায় ভুট্টা চাষে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করতে। বিভিন্ন নামে তারা বিক্রয় কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিক্রয়ের সাথে জড়িত লোকদের বিভিন্ন নামে ডাকা হয় যেমন- বিক্রয়কর্মী, বিক্রয় প্রতিনিধি, এজেন্ট, বিক্রয় উপদেষ্টা, বিক্রয় প্রকৌশলী, মাঠকর্মী ইত্যাদি। বিক্রয় কর্মীর একটা চিরায়ত রূপ আছে যা অনেক বিক্রয়কর্মীই ধারণ করেন। বিক্রয় কর্মীর কথা মনে করতেই মনে পড়ে যায় আর্থার মিলারের “ডেথ অফ এ সেলসম্যান” এর নায়ক উইলি লোমান অথবা Meredith wilson এর “দা মিউজিক ম্যান” এর নায়ক হ্যারল্ড হিলের কথা। আমরা প্রতিদিন বিক্রয় কর্মীর সাহায্য নেই কিন্তু তাদেরকে সমাজে আমরা যথোপযুক্ত স্থান দেই না।
করোনার যুদ্ধে বিক্রয়কর্মীদের ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে অবহিত করলে অন্যদের কোনোভাবেই হেয় করা হবে না। যেমন ডাক্তার,নার্স , স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সেনাবাহিনী বা মিডিয়াকর্মী সবাই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে করোনা মোকাবেলায় ভূমিকা রাখছে। বাড়িতে আবদ্ধ হয়ে থাকাও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ হিসেবে বিবেচিত হয়। হাসপাতালে, রাস্তায় অথবা বাড়িতে যে যেখানেই থাকুক তাদের খাবার, ত্রাণ সামগ্রী , মাস্ক, ঔষধ, পিপিই সবকিছু ঠিকমত পৌঁছে যাচ্ছে বিক্রয়কর্মীদের নিরলস প্রচেষ্টায়। সব মিলিয়ে বিক্রয় কর্মীদের সংখ্যা ৪০ লক্ষ হবে বলে আমার ধারণা। শুরুতে বিক্রির যে সংজ্ঞা দিয়েছি তা ধরলে তো আমরা সবাই বিক্রয় কর্মী। আপাতত আমরা যাদের অংশগ্রহণের চূড়ান্ত ফলস্বরূপ আমাদের আরাধ্য জিনিসটা পেয়ে যাই তাদের কথাই এই নিবন্ধের বিষয়বস্তু। করোনা পরবর্তী সময়ে যে মন্দাবস্থা দেখা দিবে তার সরাসরি আঘাতে কিছু ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাবে, কিছু ব্যবসায় টিকে যাবে এবং আস্তে আস্তে ফিরে আসবে, তবে ভিন্ন চরিত্র নিয়ে। কিছু ব্যবসা আগের চেয়ে শক্তিশালী হবে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উপযুক্ততা অর্জন করবে। বিক্রয়কর্মীরা এই তিনটির যেকোনো একটি শ্রেণীতে পড়তে পারে। চাকরি হারিয়ে ভিন্ন পেশায় চলে যাওয়া বা বেকারত্ব, নতুন অবস্থানের সাথে উপযুক্ত হয়ে টিকে থাকা, অথবা নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আসন্ন সুযোগ গ্রহণ করে বিক্রয় পেশায় আরো উন্নতি করা। যারা দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দলভুক্ত হতে চায় তাদের জন্য সুপারিশ হচ্ছে: যতটা সম্ভব অনুগত ক্রেতার এডভোকেসি গ্রহণ করা। করোনা পরবর্তী সময়ে চমকপ্রদক বিজ্ঞাপনের প্রভাব কমে যাবে। এমনিতেই McKinney Research বলছে, আমাদের মতো দেশে প্রায় ৫০% ক্রেতা অন্যের মুখের কথায় বিশ্বাস করে পণ্য কিনে। বিজ্ঞাপনের বার্তা অনেকের কাছে পৌঁছে না। যাদের কাছে পৌঁছে তারাও আবার বিশ্বাস করে না। বেশিরভাগ আবেদন আবেগী হওয়ায় বিজ্ঞাপনের কার্যকারিতা আরো কমে যাবে। এমনিতেই বিজ্ঞাপনের মডেলরা যা বলে তা যে টাকার বিনিময়ে বলে তা ক্রেতারা জেনে গেছে। অবশ্য এটাকেও বিজ্ঞাপনের বিষয়বস্তু করতে দেখেছি। এক মডেল বাথটাবে শুয়ে গায় একটি ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় ঢেলে বলছে,” এই হচ্ছে আমার রুপ-লাবণ্যের রহস্য “। দূর থেকে আরেক মডেল বলছে,”পয়সা পেয়ে কত কিছু বলছে,বিশ্বাস করো না খেয়ে দেখো”। এ ধরনের আবেগীয় বিজ্ঞাপন টানাটানির অর্থনীতিতে তেমন কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। মানুষ যৌক্তিক প্রমাণ পেতে চাইবে। সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ হচ্ছে অন্যের “মুখের কথা”। বিক্রয়কর্মীদেরকে সন্তুষ্ট ক্রেতাদেরকেই রেফারেল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। সন্তুষ্ট ক্রেতাদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করে তাদের মাধ্যমেই নতুন ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে হবে।
বিক্রয়কর্মীদের বর্তমান ক্রেতাদের ধরে রাখার জন্য বেশি সময় দিতে হবে। পড়তি বাজারে নতুন ক্রেতার পেছনে হন্যে হয়ে না ঘুরে পুরনো ক্রেতাদের প্রতি বেশি মনোযোগ দিতে হবে। এই কৌশল কোম্পানির বিক্রয় ধসকে আটকে দিবে। কোম্পানির বিক্রয় কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে “লস্ট কাস্টমার” অর্থাৎ যারা আগে এই কোম্পানির পণ্য কিনত এখন কিনছে না। একই পণ্য অন্য কোম্পানির কাছ থেকে কিনছে। ক্রেতারা কেন কোম্পানি বদল করে এ নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে ১৫% ক্রেতা চলে যাওয়ার কারণ তারা কম দামে জিনিস পেয়ে চলে গেছে। ১৫% আরো ভালো জিনিস পেয়েছে। ৭০% চলে যাওয়া ক্রেতার অভিযোগ হচ্ছে , “আমাদের প্রতি যথাযথ মনোযোগ দেয়া হয়নি”। মন্দার সময় বিক্রয়কর্মীর তাড়াহুড়ো না থাকায় হাতে কিছু সময় বাঁচবে। হাতের সময় ক্রেতা সন্তুষ্টির মানোন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা পরিহার করে কিভাবে ক্রেতা সেবা পদ্ধতির আরো উন্নয়ন ঘটানো যায় সে চেষ্টা করতে হবে। সন্তুষ্ট ক্রেতাই হবে কোম্পানির আয়ের প্রধান উৎস।
শিল্পপণ্যের বিক্রয় কর্মীদের নতুন শিল্প খুঁজে বের করতে হবে। অনেক শিল্প করোনা পরবর্তী মন্দা মোকাবেলায় কাঁচামাল, উৎপাদন প্রক্রিয়া বদলে ফেলবে। পুরনো প্রবাদ “প্রয়োজনই হচ্ছে উদ্ভাবনের মা”। অনেক কোম্পানি তাদের ব্যয় সাশ্রয় ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য ভিন্ন কিছু খুঁজবে। বিক্রয়কর্মীকে তার পণ্য নতুন কোন শিল্পে ব্যবহৃত হতে পারে তা খুঁজতে হবে। অর্থনীতি ভালোর দিকে যাত্রা শুরু করলে তারাই হবে কোম্পানির বড় ক্রেতা। যারা বলতো আপনার পণ্য আমাদের কোনদিনই লাগবেনা এই ‘মাইন্ডসেট’ থেকে তাদের বের করে আনতে হবে। বিচারপতি বা উকিলরা আমাদের দেশে অনলাইনে বিচারকার্য পরিচালনা হবে তা ভাবতে পারে নাই। জমির দলিলের কম্পিউটার প্রিন্ট পাওয়া যাবে, রিক্সা ভাড়া বিকাশে পরিশোধ করা যাবে অথবা রিক্সা চলবে ব্যাটারীতে, ফুটপাতে ভুট্টা পোড়ানোর জন্য ব্লোয়ার ব্যবহৃত হবে এটা কেউ ভাবেনি। চেষ্টা করলে দেখা যাবে অনেক শিল্পে নতুন বাজার খুঁজে পাওয়া যাবে।
নগদ প্রবাহকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ব্যবসায়কে টিকিয়ে রাখার জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর দ্বারা কোম্পানি তার সরবরাহকারীর নিকট সুনাম ধরে রাখে। এ সময় ক্রেতারা টাকা ছাড়তে চাইবে না। কিন্তু বিক্রয় কর্মীও তার সাথে তাল মিলালে ব্যবসায় চোরাবালিতে আটকে যাবে, ওঠা যাবে না। অলাভজনক ক্রেতাকে বিদায় করতে হবে। লাভজনক ক্রেতার প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে। যারা নির্দিষ্ট সময়ে পাওনা পরিশোধ করবে তাদের বিশেষ আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে।
মন্দা চলাকালে আগের ধাঁচের কর্মকাণ্ড অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়। যে সকল কোম্পানি আগে থেকেই মন্দা মোকাবেলার প্রস্তুতি নেয় তারা মন্দার সময় ভালো করে। দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গায় গতি কমিয়ে সাবধানতার সাথে গাড়ি চালিয়ে যেমন অন্য ধাবমান গাড়িকে অতিক্রম করা যায় তেমনি প্রতিযোগীকে অতিক্রম করা যায়। তবে সোজা পথে গাড়ি চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার চেয়ে দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকায় বা রাস্তায় গাড়ি চালানোর জন্য অতিরিক্ত দক্ষতা প্রয়োজন হয়। দক্ষতা দিয়েই মন্দার সময় প্রতিযোগী কোম্পানিকে টেক্কা দিতে হবে। যা আছে তা নিয়ে সোজা না হেঁটে ভবিষ্যতের পণ্যের দিকে নজর দিতে হবে। মন্দার সময় বেঁচে থাকাই যথেষ্ট নয়, আরো শক্তিশালী হিসেবে বাজারে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করতে হবে। নিজের লোকদেরকে টেক কেয়ার করতে হবে। এসময় সবাই আতঙ্কে থাকে, চারিদিকে লো-অফের খবর আসে, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে সকলে। কোম্পানির নেতৃত্বকে সবাইকে চাকরি বেঁচে যাওয়ার অভয় দিতে হবে। বিক্রয় কর্মীদেরকে ভবিষ্যতের জন্য প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। প্রেরণামূলক আশার কথা বলতে হবে। কর্মীরা যখন নিরাপদ ভাববে তখন তারাও ব্যবসায়কে নিজের মতো করে দেখভাল করবে।
অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান
উপাচার্য, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।